“আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।”
রবীন্দ্রনাথ এ লাইনটা লিখছেন ১৯১১ সাল নাগাদ। ছেলেটা মারা গেল কদিন আগে। আত্মহত্যা করল। একটা চিঠি লিখে আত্মহত্যা করল। বাবা, মা সবার কাছে ক্ষমা চাইল। কেউ কেউ হয় তো পড়েছেন। না, কোটা সিন্ড্রোমে আত্মহত্যা না। সেটা সমাজের আরেকদিক। আরেক ব্যাধির দিক। এ আত্মহত্যা সে ধরণের আত্মহত্যা নয়। ছেলেটা স্নাতকস্তরে পড়ছিল। গভীর অবসাদে চলে যাচ্ছিল, চারদিকে এত দুর্নীতি, ধর্ষণ, ধর্মীয় খেলায় রাষ্ট্র থেকে নাগরিকের উন্মাদনা, বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা ইত্যাদি এই সব নিয়ে।
না, খুব একটা আলোচনা আমাদের এই সমাজমাধ্যমেও আমার অন্তত চোখে পড়েনি। কারণ এ প্রশ্ন, “হার্ড কোয়েশ্চেন”, “আনকম্ফোর্টেবল কোয়েশ্চেন” এর মুখোমুখি হতে আমরা অস্বচ্ছন্দ বোধ করি। ভাইরাল হতে গিয়ে, খবরের কাগজে প্রথম পাতায় থাকতে হলে যে ক'টা “ইজম” এর আওতায় পড়তে হয়, এ আত্মহত্যা সে ধরণের কিছু নয়। ফলে ফেমিনিজম থেকে নানা ধরণের রাজনৈতিক-ইজম তেমন মাথা ঘামায়নি।
কদিন আগে “টাইমস অব ইণ্ডিয়ায়” একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। বিষয় ছিল আত্মহত্যার পরিমাণ কমানো। সেখানে বলা হয়েছে, আমাদের মধ্যে একটা ধারণা হল, আমরা ধরে নিই যারাই আত্মহত্যা করছে তারাই মানসিকভাবে দুর্বল। ফলে সে নিয়ে গভীরে আলোচনা করতে আমরা অনীহা বোধ করি। সংসারে হিরোদের নিয়ে যে আলোচনা সম্ভব, “লুজার”দের নিয়ে সেই মাত্রায় সিরিয়াস আলোচনা কি সম্ভব? না। অবশ্যই না।
কিন্তু ছেলেটা মারা গেল। একজন মেধাবী ছেলে সমাজের অবক্ষয়ে অবসাদে ডুবে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। কারণ সে দুর্বল ছিল বলে নয়। ভীষণ সংবেদনশীল ছিল বলেই। না, এই সিদ্ধান্ত আমি টানতে চাইছি না যে সংবেদনশীল হলেই আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিতে হবে। আমি কাম্যুর অ্যাবসার্ডিজমে আদৌ বিশ্বাসী নই যে জীবনে প্রতি মুহূর্তে আত্মহত্যা না করার কারণ খোঁজাটাই একটা বড় কাজ। না, আমি এ সবে বিশ্বাসী নই। যে ছেলেটি মারা গেছে তার প্রতি আমার হৃদয়ের গভীরতম অংশ থেকে সমবেদনা থাকলেও আমি তার সিদ্ধান্তকে কখনওই সমর্থন জানাই না।
এখন স্ট্যাটেসটিকস অনুযায়ী এ মৃত্যুকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দেখাই যায়। কিন্তু যদি না দেখতে চাই? মৃত্যুর থেকেও কম ভয়ংকর নয় - মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে, সম্পূর্ণভাবে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকা। তার নিদর্শনও কি কম চারপাশে?
ব্যক্তিগত জীবনে নানা চ্যালেঞ্জ, ব্যর্থতা আর অসাম্য-দুর্নীতিতে ভরা সমাজ, কোনোটাই নতুন নয়। কিন্তু অবসাদ কেন বাড়ছে এত? আমাদের শিক্ষায়, আকাঙ্খায়, বেড়ে ওঠায় কোন জিনিসটার অভাব আমাকে এমন দুর্বল করে দিচ্ছে?
আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষায়, বেড়ে ওঠায় একটা নির্মম ইনসুল্যেশান ফ্যাক্টর ভীষণভাবে দায়ী এর জন্য। আত্মকেন্দ্রিকতা চিরকাল আছে আমাদের মনের গঠনে। কিন্তু তাকে ড্রাইভিং ফোর্স হতে বাধা দিয়েছে আমাদেরই নানারকমের সামাজিক, ধর্মীয় শিক্ষা। হ্যাঁ, ধর্মীয় বলতে আমি বলছি সেই উপাসনা গৃহের কথা, যেখানে বসে এক গভীর তত্ত্বদর্শী, মরমদর্শী কবি গাইছেন “বসিয়া আছ কেন আপনমনে, স্বার্থ নিমগন কি কারণে? চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয়প্রসারী/ ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি/ প্রেম ভরিয়া লহ শূন্য জীবনে”। যে অবসাদ ক্লিনিকাল, আমি তার কথা বলছি না। তার জন্য চিকিৎসা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু যে অবসাদ আমার ভুল বিশ্বাস, আমার ভুল আকাঙ্খা, আমার ভুল ভালোবাসা তৈরি করে, আমি তার কথা বলছি। ভুল সফলতার, ভুল শিখরকে ছুঁয়ে যে গর্বোদ্ধতভাব, আর ভুল বিফলতা আর তার ভুল আত্ম-ধিক্কারের যে অবসাদভাব, আমি তার কথা বলছি।
একটা সময়ে পাশ্চাত্য দর্শনে মন টেনেছিল। ফরাসি দার্শনিকদের আধুনিকোত্তর দার্শনিকতা মনকে নানা কৌতুহলে আবিষ্ট করেছিল। একদিন সে মোহ কাটল। ভারতীয় নানা দর্শনের আবেশও কাটতে শুরু করেছে ততদিনে। সদ্য কলেজ পেরিয়ে উপার্জনক্ষম হওয়ার লড়াই শুরু হব হব। শুরু হল আমার পরিবারে একের পর এক দুর্যোগ। আত্মজীবনী লেখার কোনো ইচ্ছা নেই আমার, কিন্তু আমার নিজের উপলব্ধ সত্যকে জানাতে হলে এটুকু ভূমিকা দরকার। আমায় ক্ষমা করবেন যদি মনে হয় আত্মকথনের ছুতো খুঁজছি।
সেদিন আমার বাইরের জগতে চূড়ান্ত দু:সময়, আর আমার অন্তরের জগতে গভীর শূন্যতাবোধ। ওই যে বললাম, মোহ আর আবেশ দুইই কেটেছে তখন। জীবনবোধের গভীর জিজ্ঞাসা পাগল করে দিচ্ছে। কিন্তু বাইরের নানা ঝঞ্ঝায় সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটা সময়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা আমিও ভেবেছিলাম। আমার সেদিনের সে সব ডায়েরি আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে। মনে হয়েছিল গোটা জীবন একটা প্রহসন বই কিছু নয়।
এমনই একটা দিনের বিকেলে আমি উত্তরপাড়া স্টেশানে বসে। ট্রেনের অপেক্ষা করছি। সঙ্গে নিজের জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নেওয়ার উপযুক্ত সময়েরও অপেক্ষায়। এমন সময় চোখে পড়ল এক বুড়িকে। আমি ইচ্ছা করেই বুড়ি লিখলাম, বৃদ্ধা নয়। ভিখারি সে। তার বোঁচকাবুচকি নিয়ে ঘুমাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে উঠে বসল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল। তার আচার আচরণে কোথাও পাগলামি নেই। শান্ত স্থিরভাবে চারদিক তাকিয়ে দেখছে। কি প্রসন্ন দৃষ্টি। একটু পর উঠল, উঠে চায়ের দোকানের সামনে এলো। এক ভাঁড় চা নিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে গেল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে কি সন্তোষে চারদিক দেখতে লাগল।
আমি যে সে বুড়িকে এতক্ষণ ধরে খেয়াল করছি, আমি নিজেও জানতাম না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। স্টেশানের মধ্যে যে পাখিদের বাসা তারা হইহই করতে করতে ফিরে আসছে, আমার ট্রেন অ্যানাউন্স হল। হঠাৎ আমার মনে হল, আমি কি এতই দরকারি? আমার স্বপ্ন, আমার কেরিয়ার যা সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, ওগুলো ছাড়া কি আমার অস্তিত্বের কোনো মূল্য নেই? এই বুড়িটার চাইতে কি আমি খুব কিছু মূল্যবান? কিছু বই পড়েছি বলে আর কিছু ডিগ্রি আছে বলে?
বিশ্বাস করুন, সব বদলে গেল। সব। আমার চারদিকে আবার সব কেমন নিজের জায়গায় এসে স্থির হয়ে গেল। মন বলল, যাই ঘটুক, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মত কিছু ঘটেনি। আর হা হুতাশ করে বাঁচার মধ্যেও কোনো মানে নেই। শান্তিতে বাঁচব। সুখ আসুক, চাই না আসুক জীবনে।
প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল। কিন্তু সেদিনের সে বিকেল আমার কাছে আজও স্পষ্ট। স্বচ্ছ। তারপর থেকে আরো আরো দুর্যোগ, দু:সময় পার করেছি। এটুকু বুঝেছি, ঘরে খিল টেনে, অন্যকে তাড়িয়ে, শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচা এক বিশুদ্ধ আত্মহত্যা বই কিছু নয়। বাঁচতে গেলে নিজের বাইরে আসতেই হবে। আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার গল্পে শুধু এক বিশেষ শ্রেণীর মানুষের কথা আসে কেন? কারণ একটাই, ওখানেই আমি আমার বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাই। পোস্টমডার্নিজম দর্শনে না, মিস্টিসিজমের মধ্যেও না। মহাত্মা গান্ধী একটা রক্ষাকবচ দিয়েছিলেন, ইংরেজিতে যাকে বলে, talisman, সেটি হল -
"I will give you a talisman. Whenever you are in doubt, or when the self becomes too much with you, apply the following test:”
"Recall the face of the poorest and the most helpless man (woman, child) whom you may have seen and ask yourself, if the step you contemplate is going to be of any use to him (her). Will he be able to gain anything by it? Will it restore him to a control over his own life and destiny? … Then you will find your doubts and yourself melting away.”
এই কথাই স্বামীজির বিখ্যাত কবিতা “সখার প্রতি” তে আছে। যে কবিতাটা কাশীর সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল। যে কবিতাটা স্বামীজির উপলব্ধির প্রধান সুর বলা যায়।
“পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম—অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?
দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
‘দাও’, ‘দাও’—যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।”
এ কথাগুলো ভীষণ ক্লিশে মনে হতে পারে। কিন্তু দর্শনের হাজার লক্ষ শব্দের ঘানি টেনে সুস্থ বেঁচে থাকতে, এই উপলব্ধিতেই ফিরতে হয়। “স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ/ বৃহৎ জগত হতে, সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে”, রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধিই কি সারা জীবনের তপস্যা ছিল না?
আমি যা পেয়েছি, তা হারাতে মুহূর্ত লাগে না। স্বাস্থ্য, সম্পদ, সম্পর্ক - ভেঙে যাওয়ার আগে কোনো আগাম নোটিস দিয়ে আসে না। জীবনের বাঁচার পরিসর কমিয়ে এনে, সঙ্কীর্ণ করে নিজেকে যতই সুরক্ষিত সফল ভাবি না কেন, সে উপলব্ধি ভুল। ভ্রম। কোনো জটিল তাত্ত্বিক দর্শন না, কোনো মিস্টিসিজমের আলোছায়া রাস্তা না, যুগে যুগে এই একটা রাস্তাই সুস্থ, স্বাভাবিক বেঁচে থাকার উপায়। নান্য পন্থা বিদ্যতে।
মাঝে মাঝে আবারও ঘোরে পড়ি। তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল জগতের হাতছানি, নামযশের জগতের হাতছানি, নানা ব্যর্থতার, অবসাদের কুহেলিকার কুটিল পরামর্শ কানে এসে বাজে। “আবার এরা ঘিরেছে মোর মন, আবার চোখে নামে আবরণ” দশা হয়। আবার বেরিয়ে আসি সে ফাঁদ কেটে। যেখানে জীবন, যেখানে উৎসাহ, যেখানে মহাজীবন সাগরে লক্ষ-কোটি ঢেউ উঠছে পড়ছে সেখানে এসে দাঁড়াই। আবারও বেঁচে যাই।