ইন্টেলেকচুয়াল অ্যারিস্ট্রোকেসি আর সোশ্যাল অ্যারিস্ট্রোকেসি - দুই-ই যত গর্জায় তত বর্ষায় না। সত্যজিৎবাবু হয় তো হাঁপিয়ে উঠেই 'আগন্তুক' সিনেমার স্ক্রিপ্টটা লিখে ফেলেছিলেন। সিনেমা মানে তো আদতে স্ক্রিপ্ট। স্ক্রিপ্টটাই তো ভাবনা। সেই ভাবনাটা নিশ্চয়ই কোনো এক যন্ত্রণা থেকেই উঠে এসেছিল। নইলে শেষ দুটো সিনেমায়, 'শাখা-প্রশাখা' আর 'আগন্তুক'-এ এমন দুটো চরিত্রকে দাঁড় করাতে চাইলেন কেন? যেখানে একজনকে বাইরে থেকে দেখলে মানসিক ভারসাম্যহীন আর একজন মনেপ্রাণে জংলী হতে চেয়েও না হতে পারার আক্ষেপ বুকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। কেন?
শাখা-প্রশাখা’র চরিত্র খাবার টেবিলে উন্মাদের মত আচরণ করে। কেন করে? কখন করে? যখন তার প্রতিষ্ঠিত দাদারা একে অন্যের দিকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করল, তখন। কিভাবে প্রতিবাদ শুরু করল? বিনা ভাষায়। আদিম আচরণে। কি সুক্ষ্মভাবে সত্যজিৎ ভাষাকে ত্যাগ করলেন সত্যকে সামনে আনার জন্য! ভাষা মনের ভাব প্রকাশের উপাদান না এখন, ভাষা চাতুরীর উপাদান। সক্রেটিসের ভাষায় আমরা সফিজ্ম-এর জন্ম দিয়েছি। মনের ভাবকে গোপন করে বাক চাতুরীতে সত্যকে ঢাকার জন্য। শঙ্করাচার্যও বুঝেছিলেন। তাই বলেছিলেন, শব্দজাল মহারণ্যং - শব্দজাল মহা অরণ্যের তুল্য। পথ হারাবে। শাখা-প্রশাখা’র সেই চরিত্র পথ হারায়নি। মানুষের জীবনে দুটো সত্য হয়, বস্তুগত আর মানবিক। সত্য আর ঋত। সে চরিত্র কোনো সত্যই হারালো না। সে ভাষাহীন অস্তিত্বে শুধু সুরের মধ্যে জীবনের প্রাণকেন্দ্র খুঁজে যাচ্ছে। অথচ সে-ই ছিল সব চাইতে প্রমিসিং। কিসের জন্য? অ্যারিস্ট্রোকেসির মোড়কে মোড়া আরেকটি কৃত্রিম জীবন হওয়ার জন্য। সে হল না। জীবন তাকে নিজেকে নগ্ন করে দেখার সুযোগ দিল। সেই ছেলে, প্রশান্ত, শেষ দৃশ্যে যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো, বাবার প্রতি উদ্বেগ, ভালোবাসা আর যন্ত্রণায় ভরা মুখ - সে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ডাকল - বাবা! বুকে এসে বেঁধার মত সে ডাক। সে ডাক আদিম মানবিক জগত থেকে ভেসে আসা মৃতপ্রায় এক মানুষের কাছে শান্তির ডাক। তাই বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে বলছেন, তুই আমার শান্তি রে প্রশান্ত। সত্যজিৎ ব্যবহার করছেন এক রাগ, কণ্ঠসঙ্গীতে। বাবা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে উপনিষদের শান্তিপাঠের মত উচ্চারণ করছেন - শান্তি, শান্তি, শান্তি...
মানুষের সব সত্য মানবিক সত্য। কে এই প্রশান্ত? একি আধুনিক যন্ত্রদাস, অ্যারিস্ট্রোকেট সভ্যতার মধ্যে হঠাৎ এসে পড়া রবীন্দ্রনাথের নাটকের ঠাকুর্দা? নাকি ফকির? কে এই প্রশান্ত, যে বিনা ভাষায় নিজের অস্তিত্বে গর্জে ওঠে - তোরা সব কাজের মানুষ!
কিসের কাজ? স্বার্থপরতা, আত্মপরতার কাজ। আমাদের বিত্ত নিজের জন্য, আমাদের বিদ্যা অন্যকে ঘায়েল করে নিজেকে জেতানোর জন্য, আমাদের সাধনা নিজের বায়বীয় মূর্তি বানিয়ে সংসারে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠার লোভে।
বাইরে থেকে দেখতে অমন সাহেবী মানুষটার প্রাণে তবে কি যন্ত্রণা জন্ম দিয়েছিল প্রশান্তকে? একি শুধু আর্ট? শুধু সিনেমা? না। তার থেকে অনেক বেশি। এই আদিম দর্শন। মানুষকে মানুষের কাছে ফিরে আসতে বলার দর্শন সহজ বেশে। সমস্ত আভিজাত্য, পাণ্ডিত্যের অভিমান ত্যেজে।
এবারে ছুটদাদুর কথা। ছুটদাদু জংলী হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে বাঁচেন। তিনি সভ্যতাকে প্রশ্ন করেন। উত্তর পান না। তর্কে জিতেও সুখ পান না। বাদ বিতন্ডা। বাদ হল সত্যের অন্বেষণ আর বিতন্ডা হল আত্মপ্রতিষ্ঠার লোভ। ছুটদাদু সত্যকে সামনে আনতে চান। নিজেকে না। সারা বিশ্ব ঘুরতে ঘুরতে, আদিবাসীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজের আভিজাত্যপূর্ণ অহং নিঃশেষপ্রায়। জীবনটাকে আদিম প্রাণের আয়নায় দেখেন। আদিম বলতেই যদি হিংসা, লোভ, অসভ্যতা বুঝি - সে ভুল। ছুটদাদু ধাক্কা দিয়ে বলেন। সে ধাক্কা আভিজাত্যপূর্ণ অহং সহ্য করতে পারে না। সে অহং কৃত্রিম সভ্যতার মুখোশ খুলে বর্বর হয়ে আক্রমণ করে। সন্ত কবীর বলেন, মানুষের সব চাইতে ধারালো অস্ত্র জিহ্বা। সেই জিহ্বার অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে সেই উন্মুক্তমনা জাগ্রত মানুষটাকে। একজন আভিজাত্যপূর্ণ অহং হার স্বীকার করতে পারে না। আর ছুটদাদু মেনে নিতে পারেন না নিজের জিতকেও। তিনি তো জিততে আসেননি, এসেছিলেন নাড়ির টানে। ভালোবাসা খুঁজতে। সে ভালোবাসায় এত জটিলতা জমেছে বুঝবেন কি করে? তাই যাওয়ার আগে পরামর্শ দিয়ে যান, কি হবে না দাদুভাই? কূপমণ্ডূক।
আরেক গল্প। রামকৃষ্ণদেব দেখা করতে এসেছেন দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে। দেবেন্দ্রনাথ ভালো ব্যবহার করেননি। রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতেও লিখেছেন সে কথা। তার জন্য রবীন্দ্রনাথ বলছেন তাঁর বাবার ধর্মবিশ্বাসে আর চরিত্রে একটা আভিজাত্যবোধ ছিল। তিনি বৈষ্ণব-শাক্তদের ধর্মীয় উচ্ছ্বাসে ঠিক সাড়া পেতেন না।
হয় তো বা। তাই। কিন্তু সেই রামকৃষ্ণ আভিজাত্যের মোড়ক থেকে বাঁচলেন কই? আজ রামকৃষ্ণ স্টেটাস সিম্বল। নানা মহারাজের দীক্ষিত হওয়া, তাদের ছবি টাঙিয়ে শেয়ার করে নিজেকে রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত প্রমাণ করা স্টেটাস সিম্বল। তার মানে কি সত্যিই তারা কামকাঞ্চন ত্যাগী হতে পেরেছেন? রামকৃষ্ণদেবের মূল শিক্ষা ছিল ঈশ্বরের ভালোবাসায় অন্তর থেকে সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে সরল সহজ জীবনযাপনের। সে ভীষণ কঠিন কথা। তাই সে আদর্শ থেকে সরে এসে রামকৃষ্ণদেবকে ঘিরে যে অ্যারিস্ট্রোকেসি, আজকে সেই জোয়ারে গা ভাসানো অনেক সোজা।
সত্যজিৎ রায়ের যে ইমেজ আমাদের তৈরি হচ্ছে আজকে, সেও সেই শাঁস ছেড়ে আঁশ নিয়ে মাতামাতি। সমস্ত কিছুর গভীরে যে প্রাণের স্পন্দন থাকে, তার রূপ হল দর্শন। মানুষের ইতরতম কাজেও থাকে ইতর দর্শনের প্রভাব। বিপরীতে থাকে উচ্চ দর্শনের প্রভাব।
কিছু উদ্ভিদ আছে যারা নিজেদের পাচকরসে জারিয়ে প্রাণীদের নিস্তেজ নিস্প্রাণ করে তোলে। অথবা মিউজিয়ামে রাখা নিষ্প্রাণ অবয়বগুলোর কথাও ভাবতে পারা যায়। রামকৃষ্ণ আমাদের আধুনিক সমাজে ইতিমধ্যে তা হয়ে গেছেন। এবার সত্যজিতের পালা। মাঝখানে শুরু হয়েছিল বাউল নিয়ে এই খেলা। এখন সে হুজুগ কিছুটা হলেও কমেছে। আভিজাত্যবোধ ছেড়ে মাটিতে না নেমে দাঁড়ালে গতি নেই। "দুঃখ কিসে যায়? প্রাসাদেতে বন্দী রওয়া বড় দায় / একবার ত্যাজিয়া সোনার গদি রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায়! / তবে রাজা শান্তি পায়"
সত্যজিৎ সাহেবিয়ানার মোড়কে এক অদ্ভুত সংবেদনশীল মানুষ একজন। তার মনের মধ্যেও এক বাউল, এক ঘরছাড়া আছে বলেই তিনি "কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়" গাওয়া বাউলকে খুঁজে পান। আমাদের সস্তার আদেখলাপনা আভিজাত্যের মোড়কে যেন সত্যজিৎকে সেই বাউলের থেকে দূরে না ফেলি।