Skip to main content

আজ একটা প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিকে দেখলাম, "Science behind Surya tilak" কথাটা। ধর্মীয় ভাবাবেগ ধর্মের জায়গায়। সেখানে নিশ্চয়ই অন্যের ভাবের প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকবে। আছেও। কারুর ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা অন্যায়, যদি না তা অন্যের ক্ষতি করে। কিন্তু সেখানে জোর করে বিজ্ঞান শব্দটাকে আনা কি খুব যুক্তির?

বিজ্ঞানের শত্রু ধর্মীয় কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস ততটা নয়, যতটা সিউডোসায়েন্স। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস তবু বা ভাঙে। কিন্তু সিউডোসায়েন্স থেকে মুক্তি পাওয়া যে কী দুঃসাধ্য ব্যাপার!

সিউডোসায়েন্সের বাংলা কী? অপবিজ্ঞান? আমার মতে না। আমার মতে চাতুরী বিজ্ঞান, কপট বিজ্ঞান। এই সিউডোসায়েন্স দিয়ে কী না হতে পারে। একজন মানুষের মৃত্যু থেকে শুরু করে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি অবধি। অনেকেই এই চাতুরী বিজ্ঞানের ফাঁদে ফেলে নোংরামি করে মহিলাদের সঙ্গে। সে বেনজির ঘটনা নয় নিশ্চয়ই!

ইমানুয়েল কান্ট একটা অসামান্য কথা বলেছিলেন। দুটো জিনিস আমাকে বিস্মিত করে। এক জ্যোতিষ্কতে ভরা রাতের আকাশ। দুই, মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে ন্যায় বোধের গভীর রহস্যময়তা।

এই দুটোই পাশাপাশি যাওয়া সম্ভব। আমি একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটার জন্য ফুলের স্তবক কিনে নিয়ে যেতেই পারি। কিন্তু তখন ফুলকে আমার উদ্ভিদের জননাঙ্গ মনে হবে না। মানুষের মস্তিষ্কের এই অসামান্য ক্ষমতা আছে। দুটো সত্যকে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পৃথক করে দেখার ক্ষমতা। রসের সত্যকে আর যুক্তির সত্যকে আলাদা করে দেখার ক্ষমতা।

কিন্তু চাতুরীবিজ্ঞান, কি কপটবিজ্ঞান এই দুই পৃথক প্রেক্ষাপটের মর্যাদা রাখে না। গুলিয়ে দেয়। কনফিউজড করে দেয়। আমি যা সত্য বলে মানতে বা দেখতে-শুনতে চাই, তা বাস্তবের কঠোর বিধানে অনেক সময়ে সম্ভব হয় না। সেই জায়গাটাকে অনেক সময় আমরা আমাদের কল্পনায় ভরিয়ে তুলি। সেখানে দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেই শূন্যতাকে যদি আমি বৈজ্ঞানিক ক্ষমতার আয়ত্তে বলে প্রচার করি তবে সেটা মনুষ্যত্বের সঙ্গে ভীষণ বেইমানি করা হয়।

বর্তমানে এই সিউডোসায়েন্স নানাভাবে বিকোচ্ছে। কেউ পুরাণের মধ্যে বিজ্ঞান দেখছেন। কেউ পুরাণের মধ্যে ইতিহাস দেখছেন। আরো কে কে কী কী দেখছেন ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। মাঝখান থেকে পুরাণের মধ্যে যেটুকু সুন্দর, কাব্যময় সেটা নষ্ট হচ্ছে। “শতেক বরষ পরে বঁধুয়া মিলল ঘরে / রাধিকার অন্তরে উল্লাস”। এ গানে “শতেক বরষ” অর্থে নিশ্চিয়ই সংখ্যার একশো বছর নয় সে কাব্য রসিক মাত্রই জানেন। যা কাব্যের রসের বস্তু তাকে যদি রোজ বাস্তবের কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হয় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে, তবে তো মুশকিল। রাবণের দশটা মাথার ডারউইনের সংগ্রহশালায় কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলেও কাব্য সুষমায় কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। বাল্মিকীর আদিকবি হিসাবে মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয় না। কিন্তু তাকে যদি অ্যান্থ্রোপলজির দরবারে সাক্ষ্য হিসাবে হাজিরা দেওয়ার জন্য অহরহ ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে তাকে বিব্রত করা হয় শুধু না, অপমান করাও হয়।

এটাই হয়ে চলেছে চারদিকে। আজব সব নাম দিয়ে ইতিহাস, কি বিজ্ঞানের সঙ্গে কাল্পনিক সব যোগসূত্র বার করার চেষ্টা চলছে পুরাণের। বেস্টসেলার হচ্ছে। মগজগুলো না সাহিত্যের রসে ডুবে চিত্তের স্বাধীনতা পাচ্ছে, না বিজ্ঞানের আলোয় চিত্তের মুক্তি ঘটাচ্ছে।

বিজ্ঞানের আসল সমস্যা তাই বলছিলাম ধর্মীয় কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস নিয়ে নয়। আসল সমস্যা এই চাতুরী বিজ্ঞান বা কপট বিজ্ঞান নিয়ে।