Skip to main content
 

তোমার ভালো থাকার প্রধান অন্তরায় তোমার ভাবনা। অথবা তোমার ভাবনারা। সেরকম কিছু ভাবনার কথা বলি। (প্রথমে সমস্যারা, শেষে সমাধানেরা)
 
 
১) দ্বন্দ্ব 
 
----------
        তোমার জীবন জুড়ে নানা দ্বন্দ্ব। প্রথম আর প্রধান দ্বন্দ্ব তোমার নিজেকে নিয়ে। তুমি যা আর তুমি মনে করো যা হওয়া উচিত ছিল - তার দ্বন্দ্ব। তুমি নিজের দিকে সরাসরি তাকাও না। তোমার লক্ষ চোখে লক্ষ জন। তুমি তুলনা টেনে চলছ। তোমার চলতে ফিরতে নানা গুরু, নানা নেতা, নানা শিক্ষক। তাদের নানা উপদেশ। সবার নিজস্ব মত তোমাকে নিয়ে - তোমার কি হওয়া উচিত ছিল। ছোটবেলা থেকে তুমি শুনে আসছো তোমায় কি কি হতে হবে; কেমন করে হাঁটতে হবে, খেতে হবে, শুতে হবে, কথা বলতে হবে, প্রেম করতে হবে, আদর করতে হবে, ঝগড়া করতে হবে ইত্যাদি।
তোমার চারদিকে কত মত, কত ভগবান, কত আদর্শ। সবারই একটা কথা - 'উচিৎ'। এটা হতেই হবে। ধার্মিক ভাবছে ঈশ্বরের প্রেমে জগৎ না ভাসলে ত্রাণ নেই, কম্যুনিস্ট ভাবছে সবার সমান ধনসম্পদ না হলে সংসারে চূড়ান্ত মঙ্গল নেই, পুঁজিবাদী ভাবছে বেশি মুনাফা যদি না মালিকের ডেরায় ঢোকে তবে মালিক অবসাদে ভুগবে, উৎপাদনের হার কমবে। তোমায় একটা পথ স্থির করতে হবে। জগতের মঙ্গলের একটা স্কিমে গা ভাসাতেই হবে যেন। তারপর শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। সায়েন্স ভালো কি আর্টস, কমার্স ভালো কি টেকনোলজি। দ্বন্দ্ব আর দ্বন্দ্ব। কোথায় যাবে?
 
 
২) ভয় 
 
-----------
        তুমি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগো। অহর্নিশি। তোমার মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করার অসম্ভব তাগিদ। রাতদিন নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছ। নিজের কাছে, সবার কাছে। চাপ নিয়ে ফেলছ না? তোমার মধ্যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে প্রতিযোগিতার বিষ। তুমি নিজেও নিজের প্রতিযোগী। তোমার ঘুম নেই। তুমি বিশ্রাম জানো না। তুমি ছুটছ। নিজের ছায়ার সাথে ছুটছ।
        তোমার নিজের মধ্যে একটা অপরিবর্তনশীল ভবিষৎ পরিকল্পনা। তার এক চুল এদিক ওদিক হওয়ার সুযোগ নেই। হলেই তুমি গলায় দড়ি দেবে, শুঁড়িখানায় যাবে, না তো অবসাদে ঘরে দোর দেবে। তোমার নিজেকে নিয়ে মেলা অশান্তি। তুমিই তোমার পোষা কুকুর। তুমি বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছ, সে মুখে করে করে আনছে। তুমি খুশি হয়ে নিজেকে বিস্কুট দিচ্ছ। পিঠ চাপড়ে দিচ্ছ। জগতের কাছে ভাবের, মানে ইমেজের সেল্ফি পাঠাচ্ছ। (এই সেল্ফি তোলার ব্যামো কি মানুষের আজকের গা? সেই কবে থেকে।) মনে মনে ভয় পাচ্ছ, যদি কাল কুকুরটা বলটা না নিয়ে আসে? আমার কি হবে? তুমি মাঝরাতে উঠে উঠে কুকুরটার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছ। নিজেকে ভুল বোঝাচ্ছ, ভাবছ এ তোমার ভালোবাসা। ভালোবাসায় এত ভয়? এত সূক্ষ্ম হিসাব নিকেশ?
        অথচ কুকুরটাকে ছেড়ে দিয়ে একটু নিজেকে মানুষের মত মানুষ হিসাবে দেখবে না। তোমার ঈশ্বর তোমায় ভয় দেখায়, তোমার পুরোহিত তোমায় ভয় দেখায়, তোমার নেতা তোমায় ভয় দেখায়, তোমার ইন্সুয়রেন্সের কোম্পানি তোমায় ভয় দেখায়। তুমি ভয়ের বশ্যতা স্বীকার করেই বাঁচো। কারণ ওর বাইরে গেলে তুমি অস্তিত্বহীনতায় ভোগো। ভয় তোমার অস্তিত্ব, তোমার অভ্যেস। ভয়ে তুমি নিজেকে জীবন্ত অনুভব করো। কারণ সব ভয়ের চূড়ান্ত ভয় তোমার কাছে - স্বাধীনতা। যদিও তুমি মুখে বলো তুমি তাই চাও। কিন্তু চাও না। তাই তোমার এত গুরু, এত নেতার দরকার।
আচ্ছা বলোতো, কাউকে শ্রদ্ধা করা আর তাকে অথরিটি মানা এক? শ্রদ্ধা করতে স্বাধীন মনের অধিকারী হতে হয়। আর অথরিটি মানলে সব স্বাধীনতার সব্বনাশ। তুমি দ্বিতীয়টাই চাও। কারণ তুমি নিজের থেকে চিন্তা করতে ভয় পাও। নিজের সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নিতে ভয় পাও।
 
 
৩) পালিয়ে বাঁচা 
 
-----------------------
        তুমি রাতদিন পালাচ্ছ। কিসের থেকে? বাস্তব থেকে। যা আছে তার থেকে। তোমার ধর্ম, তোমার রাজনীতি, তোমার শিক্ষা ইত্যাদিও সব পালানোর কৌশল। তাই এত কম বৈচিত্র‍্য। তুমি শুধু চাও একটা কল। যে কলের ধাঁচে সবাইকে ফেলে একটা বিশাল কলেবর বানাও। কেউ যাতে আলাদা করে কিছু ভাবতে না পারে। ওদের শিখিয়ে দাও কি উচিত কি অনুচিত। চোখটা এমনভাবে কাপড়ের রঙে বেঁধে দাও যাতে ওরা কাপড় খুলতে গেলে মনে করে চোখটাই বুঝি উপড়ে গেল। পিছন থেকে চাবুক মারো। মিষ্টি চাবুক। উচ্চাকাঙ্ক্ষার চাবুক। আরো আরো পাইয়ে দেওয়ার গল্প শোনাও। লোভ আর ভয় - পুঁজি তোমার। কাজে লাগাও।
        তবে কি আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী? না তো। প্রতিষ্ঠান বলতে যদি পোস্ট অফিস, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, স্টেশন ইত্যাদি হয়, আমি তার বিরোধী নই তো। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বলতে যদি 'আমরা বনাম ওরা' হয়ে দাঁড়ায় তবে তবে তো সমূহ বিপদ। ধর্ম, রাজনীতি, নানা ইজ্‌ম - এরা তাই তো করে।
        আরো সমস্যা আছে। তুমি তোমার স্মৃতিতে বাঁচতে চাও। সেও পালানো। বাইরের জগতে তোমার জীবিকা ইত্যাদির জন্য তোমার স্মৃতিশক্তি ভীষণ জরুরী। কিন্তু তুমি নিজেকে সে স্মৃতির খাঁচায় দেখো। সারা বিশ্বের হাজার তত্ত্বকথা, হাজার নীতিকথায় স্মৃতির কোটর ভর্তি। তুমি পালাচ্ছ। তুমি নিজে বাস্তবে যা অনুভব করছ তার থেকে তুমি বাইরে যেতে চাইছ তোমার অতীতের রূপরেখায় অবগাহন করে।
 
 
 
উপায় 
 
---------
১) তুমি নিজে একটা অপঠিত বই। প্রথমে তাই দিয়েই শুরু করো। নিজেকে পড়া অভ্যাস করো। সে বইয়ের পাতা উল্টাবে কি করে? নানা সম্পর্কে। সম্পর্করাই তোমায় চেনাবে তুমি কে? সব সম্পর্কে সচেতন থাকো। একটা গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে তোমার সামনে, তুমি কি খেয়াল করছ? দেখো। তোমার সাথে সব কিছু সম্পর্কের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হও। নিজেকে চেনার এ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কিভাবে?
২) Passive Awareness অভ্যেস করো। নিষ্ক্রিয়ভাবে সচেতন থাকো। Judge কোরো না, তুলনা কোরো না। সব কিছুকেই বিচার করার, মতামত দেওয়ার অভ্যেসটা ছাড়ো। ওতে তোমার মানসিক স্থিতি নষ্ট হয়। জ্ঞাত থাকো, কিন্তু ঘেঁটে থেকো না। কিভাবে?
৩) ভালোবাসো। ভালোবাসা বিচার করে না। ভালোবাসা দ্রষ্টা আর দ্রষ্টব্যের মধ্যে বিভেদ ঘুচিয়ে দেয়। মা সন্তানকে দেখতে দেখতে নিজেও সন্তানবৎ নিজেকে অনুভব করেন বলেই তার কোন কান্না কিসের তা টের পান। শিল্পী একটা ফুলের মাধুর্যে মগ্ন হয়ে নিজে সেই ফুলের সত্তায় জাগরিত হন, ফুলের মাধুর্য তার চোখে ধরা দেয়। তুমি পরিপূর্ণ হৃদয়ে জীবনটার দিকে তাকাও, জীবনও তার সব মাধুর্য উজাড় করে তোমার সামনে মেলে ধরবে। তুমি নিজেই এই বিশাল মনুষ্যত্ব। কিছুই তোমায় ছেড়ে নেই। হতে পারে না। এই অসীম আকাশ হোক তোমার সীমারেখা। ছোটো হয়ো না, কাউকে ছোটো কোরোও না।