চ্যারিটি ভালো জিনিস। সভ্য মানুষ চ্যারিটি করবে এ ভালো কথা। মহাপুরুষেরা বলে গেলেন, সব চাইতে বড় দান হল জ্ঞানদান।
এখন এই জ্ঞান বস্তুটা আজকাল দিনে বড় মাগ্যি। অনেকটা 'ফেল কড়ি মাখো তেল' ধরণের। যদিও নানা ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তবুও আমার মনে হয় আমাদের যুবসমাজের সেদিকে নজর খুব একটা পড়ে না। বেশির ভাগ উত্তর হল গ্র্যাজুয়েশন, তারপর চাকরির পরীক্ষা। নইলে উচ্চমাধ্যমিকের পর ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ কেউ ডাক্তারি। বাকি সব গ্র্যাজুয়েট হবে। কাতারে কাতারে গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে, কেউ পাশে, কেউ অনার্সে। তার মধ্যে অতি অল্প সংখ্যক মাস্টার ডিগ্রীতে। তারপর কেউ কেউ আবার সেই ‘চাকরির পরীক্ষা’, নইলে অতি অল্প সংখ্যক গবেষণা।
কিন্তু এই এত এত গ্র্যাজুয়েট না হয়ে যদি নানা কারিগরি শিক্ষার দিকে আমাদের ঝোঁক হত, তবে কেমন হত? যদি আমরা ‘চায়ের দোকান দেওয়া’, ‘রিকশা চালানো’ ইত্যাদি কথাকে নিন্দনীয়, অপমানজনক মনে না করে বড় হতে শিখতাম তবে কি হত? আমি বহু বহু ছেলেমেয়েকে দেখেছি মূল বই না পড়ে শুধু নোটস মুখস্থ করে গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাচ্ছে। সত্যি বলতে আমাদের এত এত গ্র্যাজুয়েট কি সত্যিই চাই? এত এত সাহিত্যের গ্র্যাজুয়েট, নামমাত্র বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট, কমার্সের গ্র্যাজুয়েট কি সত্যিই আমাদের সমাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় কাজে লাগছে? যারা কোনো একটা বিষয়কে ভালোবেসে পড়ছে তাদের কথা বলছি না। তারা হয় তো সেই বিষয়ে অনেকদূর অবধি পড়াশোনা করতে চায়। সে আলাদা কথা। কিন্তু কতজন আমাদের তাই হয়? “তুই কিসে অনার্স পেলি?” এইতেই তো কত শিক্ষার্থী ওরফে সার্টিফিকেটার্থী গড়ে উঠছে। এরা কতটা কুশলী? কতটা উপযোগী সমাজের নানা কাজে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যা নিয়ে পড়াশোনা করছে তার সঙ্গে তার কর্মজীবনের কোনো মিল নেই। তবে ওই অতগুলো সময় আর অর্থ - অপব্যয় হল না?
হল। কিন্তু আমাদের এগুলো গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে নানা কাজে যখন নানা মানুষ আসেন, যাদের সার্টিফিকেট যোগ্যতা আমার থেকে কম, সত্যি বলতে আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। বাড়িতে নানা কারণে যারা যারা আসেন, ধরুন, ইলেকট্রিকের কোনো কাজ করতে; বা এসি বা ফ্রিজ সারাতে; বা জলের লাইন বা পাম্পের কাজে; বা বাবার বা জেঠিমার রক্ত নিতে --- এনারা কেউ সঠিক পথে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। সবাই “করতে করতে শিখে গেছি”। এটা অপচয় বা অপব্যয় নয়? আমার মনে হয় অপচয় ও অপব্যয়। কয়েকটা প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ টাকা নিয়ে সরকারি চাকরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, এটা হাস্যকর না? আমার কাছে খুব অযৌক্তিক। অর্থাৎ, আমি এত এত সময় ধরে নিজেকে স্নাতক করে নিয়ে, সে সব জলাঞ্জলি দিয়ে আবার একটা প্রতিষ্ঠানে ঢুকলাম যারা শুধু সেই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি দেবে। অর্থাৎ, যা আমাকে আমার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেখায়নি। যদিও এর উপযোগিতা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তবে সরকারি চাকরি পাওয়ার পর তাদের নিয়ে যখন অনুষ্ঠানের ছবি দেখি কাগজে, এবং সেখানে মন্ত্রী থেকে সাধু অনেকের উপস্থিতি দেখি, আমার মনে হয় আমরা বড্ড বেশি চক্ষুলজ্জাহীন হয়ে পড়েছি। অর্থনৈতিক বৈষম্যকে এমন নগ্নভাবে উদযাপন করার মধ্যে একটা পৈশাচিক বর্বর উল্লাস দেখি। গ্যাদগেদে অহংকার।
সে যাক, সে অন্য কথা। সে নিয়ে নানা বিতর্ক হতে পারে আগেই বললাম। কিন্তু যেটা বলছিলাম, এই যে মানুষগুলো নানা কাজে আমাদের বাড়ি এসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ কাজগুলো করে সমাজকে চালু রেখেছে সেদিকে বেশি মনোনিবেশ করা যায় না?
আমরা যদি আমাদের ছেলেমেয়েদের শুরু থেকেই হাতের কাজ, নানা কারিগরিতে উৎসাহ বেশি দিই তবে কি খুব ক্ষতি হবে? হ্যাঁ, প্রথমত আমাদের সংস্কারে, ভাবার গতিতে ধাক্কা লাগবে, এ সত্য। কিন্তু উপকার অনেক হবে জানেন। অন্তত আমার তা মনে হয়।
প্রথমত, তারা এমন কিছু শিখবে জানবে যা তাদের আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। উপযুক্ত সিলেবাসে, যথাযথভাবে, মানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তারা যা শিখবে তাতে তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ আরো বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, 'আত্মনির্ভরতা' শব্দটা নিয়ে যতই হাসাহাসি বা ব্যঙ্গ করি না কেন, ওই শব্দটার একটা মর্যাদা আছে। তাকে কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিতে না দেখে যদি বাস্তব শিক্ষাঙ্গনের আঙিনায় দেখি তবে তার একটা প্রবল সম্ভাবনা আছে শুধু নয়, সমাজে একটা আমূল পরিবর্তন আনার ক্ষমতা সেটা রাখে।
তৃতীয় পয়েন্টটা এই দ্বিতীয় পয়েন্টের হাত ধরেই আসে। সব কাজকে আমরা শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শিখব। কারণ একটাই যে যে কাজই করুক না কেন সে সেটি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পেয়ে আসছেন। এই পরিবর্তন আনাটা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভীষণ জরুরি। পেপারে পড়েছিলাম, কারোর একজন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ছেলে ডেলিভারি বয়ের কাজ নিয়েছিল বলে বাবা-মা আত্মহত্যা করেছেন। দোষটা সেই বাবা মায়ের শুধু নয়। এই গোটা সমাজের। আমাদের মানুষকে ছোটো করার, অপমান করার কৌশলের, উপায়ের অভাব নেই। কত মানুষ যে আমাদের চোখে মানুষই না, সে হিসাব করতে বসলে অর্ধেক ভারতবাসীই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বেন।
“এরপর তো তোকে মোবাইল রিপিয়ারিং-এর কাজ করতে হবে”, আমিই বলেছিলাম, বহুকাল আগে কোনো ছাত্রকে। আজ প্রতিদিন এই কথাটা আমার মনে পড়ে, নিজেকে ক্ষমার অযোগ্য লাগে। একি ভর্ৎসনা করার ভাষা আমি সেদিন উচ্চারণ করেছিলাম! শিউরে উঠি আজ ভাবতে গেলে। অথচ এমন সমাজে বাস করি যে কেউ আমার গালে সেদিন এসে একটা চড় মারেনি, বা আমায় ফিরিয়ে ভর্ৎসনা করেনি যে, স্যার আপনি অত্যন্ত হীন কথা বলছেন একটা। কেউ বলেনি। আমি আজ জানি এত এত সার্টিফিকেট নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় এত এত চাকুরী সন্ধানীরা জীবন পেয়ে যেত, হতাশায় না ডুবে অল্প থেকেই জীবন শুরু করে দিতে পারত, শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদায় ভর করে। কিন্তু আমাদের সমাজ বাড়ি বসে থাকা বেকার স্নাতককে সম্মান করে, কিন্তু একটা খারাপ পাম্প, কি এসি, কি বাইককে নিখুঁত দক্ষতায় ঠিক করে দেওয়া ছেলেটাকে সম্মান জানাবে না। আবাসনের দরজায় লিখে রাখতে লজ্জাবোধ করে না ‘সেলসম্যান আর নট অ্যালাওড”। ওই লেখাটা আবাসনের বাইরে দেখলে আমার কান্না পায় আজকাল। মানুষকে অপমান করার সহস্র কৌশল সত্যিই আমাদের কাছ থেকে শিখতে হয়।
আমাদের ভাবনার পথটা বদলাতে হবে। হাত পাতার অভ্যাসটা ছেড়ে, 'আপনা হাত জগন্নাথ' বানাতেই হবে। নইলে কতদিন আর অন্যদেশের জন্য সস্তার শ্রমিক হয়ে, শুধুমাত্র টাকার দিকে তাকিয়ে নিজের সমস্তটুকু বিসর্জন দিয়ে নির্লজ্জ গ্যাদগেদে অহংকারী হয়ে দিন কাটাব? আমার শ্রমের ক্ষমতায়, নিজেকে কুশলী করে গড়ে তুলে নিজের জীবনের সময় আর নানা শখ ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে বাঁচতে কবে শিখব? অনেক পেয়ে সে হওয়ার নয়, সে সম্ভব শুধু মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বক্ষমতায়, স্বমর্যাদায়।