সৌরভ ভট্টাচার্য
13 May 2019
ব্যক্তিত্ব – একটা অস্তিত্ব। মানবিক অস্তিত্ব। অর্জিত, আত্মগত সত্তা। কিন্তু ঝিনুক মানেই যেমন মুক্তো নয়, মানুষ মানেই তেমন মনুষ্যত্ব নয়। ব্যক্তি মানেই ব্যক্তিত্ব নয়। পশুপাখির নিজের মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটানোর কোনো দায় নেই। তার জৈবিকস্তরের সমস্ত ক্রিয়াপদ্ধতির একটা মাপ আছে সময় আছে, সর্বোপরি তার মনোজগত বলে কিছু নেই। তাই বিরোধ দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। মানুষের মধ্যে সে দিকটার ভার প্রকৃতি নিজের হাতে নেয়নি বলেই মানুষের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যের প্রয়োজন এসে পড়ে। তার বাইরের জগত আর মনোজগত। সেখানে তার সামঞ্জস্য রক্ষার অবশ্যমম্ভাবী দায়। সে সামঞ্জস্য ফাঁকিতে গোঁজামিলে ভণ্ডামিতেও হয়, আবার খাঁটি সমাধানেও হয়। দ্বিতীয় পথেই ব্যক্তিত্বের রঙ ধরে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সে রঙের পরীক্ষাও হয়। আর প্রথম পক্ষের উদাহরণ চারপাশ ছড়িয়ে। তার সংখ্যাই বেশি। আমাদের ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষানীতি ইত্যাদি যাবতীয় কিছু সেই গোঁজামিলটাকে মজবুত করার জন্য সমাজস্বীকৃত পন্থা। সেখানে প্রথম কথা মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নাও। গুরু, শিক্ষক ও নেতার ভূমিকায় এসো। মানুষকে অনুসরণ করাও। মানুষ অনুসরণ করতে ভালোবাসে। তাকে ঈশ্বরের গল্প শোনাও, নানা তত্ত্বের গল্প শোনাও, সাম্য-স্বপ্নপূরণ ইত্যাদির আফিম খাওয়াও – কিন্তু দোহাই, চিন্তা করতে দিও না। যে চিন্তা করে তাকে - ধর্মে বলো নাস্তিক, শিক্ষায় বলো অবাধ্য, রাজনীতিতে বলো দ্রোহী। তবে নিশ্চিন্তে থাকো, এদের সংখ্যা কম। আদতে সিংহভাগ মানুষ চাইবে তুমি যেন তাদের শাসন করো, পথ দেখানোর ছলে পথ রোধ করে নিজে পথ হয়ে বোসো, মাথায় নিত্যনতুন উত্তেজনা দাও। মানুষ তোমার বশ হয়ে থাকবে। যেখানে মাথা নীচু করতে বলবে, করবে। যাকে পুজো করতে বলবে, করবে। যাকে হত্যা করতে বলবে, করবে। এমনকি আত্মহত্যা করতে বললেও করবে। কিন্তু একটা বিশ্বাস তোমাকে তাদের দিতে হবে – সে সুরক্ষিত, নিরাপদে আছে, সামনে সে বিপদবাধাহীন। ব্যস। মানুষ ধর্মে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে আর কিচ্ছুটি চায় না গো, একটু নিরাপত্তা, একটু আশ্বাস, একটু প্রবোধ চায়। সব চাইতে বেশি করে চায় তুমি তার স্বাধীনসত্তাটার একটা জামা দাও। একটা আবরণ দাও। কেমন বেমানান সংজ্ঞাহীন বিশ্রীরকমের বেয়াড়া হয়ে পিঠের কুঁজের মত সাথে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তুমি এর থেকে আমায় রেহাই দাও। আমায় একটা নাম দাও, পরিচয় দাও, মুখোশ দাও, দল দাও, গোষ্ঠী দাও। এরপর আমরা হইহই করব, শত্রুপক্ষ মিত্রপক্ষ বানিয়ে নেব, বেশ একটা লণ্ডভণ্ড করে নেব। তুমি শুধু একটা পদ্ধতি দাও। একটা মেথড। ধর্ম শিক্ষা রাজনীতি – সেই মেথডের বা কৃষ্টি-পদ্ধতির রূপ। তাই যে কজন স্বাধীন মৌলিকসত্তা এসেছেন মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে তাদের দেখেছি এই প্রথাগুলোকেই আগে উপেক্ষা করেছেন বা নমো নমো করে সেরে নিয়েছেন। কারোর বাধ্য হতে চায়নি। অথবা ঔদ্ধত্যে মত্ত হওয়ার মতও নির্বুদ্ধিতা দেখাননি, কারণ তার বোধে বিশ্বপ্রকৃতির আদিগুরু আসন পেতে বসেছেন। তিনি শিক্ষা দেন ভুলের স্বাধীনতায়, নম্রতার অনুবীক্ষণে সত্যের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে, বিশ্বপ্রকৃতির শাশ্বত নিয়মের আশ্বাসে। সে মুক্ত হওয়ার সাধনা। যুক্ত থাকার অনুকম্পা।
কিন্তু এই সাধারণ মানুষ, মুক্তপুরুষ বাদ দিয়ে আরেক শ্রেণীর মানুষ থেকে যায়, যারা কাপুরুষ। আর যারা আসুরিক? তারাও আছে। কিন্তু তারা আছে শুধু ধ্বংস হওয়ার জন্য, অপঘাতে। আক্রোশ, লোভ, হিংসা, অহংকার – এইসবের দাসত্ব থেকে মুক্তি যার নেই, সে না পারে সাধারণ হতে না পারে মুক্ত হতে। সুতরাং তার কথা থাক।
যে কাপুরুষ, সে কে? আসলে সে কিছুই না। সে ভীতু? না। সে কূট? না। সে ছল? না। সে ভালো? না। সে মন্দ? না। আসলে সে কিছুই না, আবার সব কিছু, সে গিরিগিটির মত। তাই সংসারে আর সবাইকে নিয়ে চলার বিধান আছে, পথ আছে, উপায় আছে – কিন্তু কাপুরুষের সঙ্গের মত দুঃসহ জ্বালা আর কিছুতেই নেই। সেকি সুবিধাবাদী তবে? সেও না। কারণ সুবিধাবাদী অন্তত নিজের সুবিধাটা বোঝে। কাপুরুষ নিজের সুবিধাটুকুও ঠিকঠাক ঠাহর করে উঠতে পারে না। কখনও কখনও নিজের ক্ষতিকেও পরম মঙ্গল ভেবে এমন নিশ্চিত হয়ে বসে থাকে যে তার অতিবড় শত্রুও (যদিও সেও সম্ভব নয়, কারণ শত্রু জোটানোর মত যোগ্যতাও তার নেই) করুণা করে। রামকৃষ্ণদেব এই চরিত্রকে চিঁড়ের ফলারের সাথে তুলনা করেছেন, কিছুতেই আঁট হয় না। কি অসামান্য উপমা! একটা কথাতেই সার কথাটা বলে দিলেন, আঁট হয় না। একটা মানুষ যে সম্পূর্ণ ধৃতিশূন্য। তাকে নিয়ে কোনো ছোটো কাজে হাত দেওয়া যায় না, বড় কাজ তো প্রশ্নই ওঠে না। সে খালি ছেড়ে ছেড়ে যায়, হারিয়ে হারিয়ে যায়, সরে সরে যায়। আবার থেকে থেকে গায়ের সাথে জড়িয়ে যায়, চলার সাথে হোঁচট খায়, ভাবনার সাথে ঘোর তৈরি করে। এমন মানুষকে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তাই এই সিদ্ধান্তেই স্থির থাকা শ্রেয় যে এ মানুষটা অবিকশিত নয়, মানুষটা অসম্পূর্ণ – কাপুরুষ। ব্যক্তিত্বহীন তামসিক সত্তা। সে গুহায় গর্জন করে, লোকালয়ে মহাপ্রভু, যীশুতুল্য স্থির নম্র আচরণ করে, একা নীরব থাকলে স্বপ্নীল হয়ে ওঠে, কথা বললে হাঁ-না এর মধ্যবর্তী নো-ম্যান্স ল্যাণ্ড এর শব্দ খোঁজে। তার প্রতিশ্রুতি নেই, তৎপরতা নেই, উৎসাহ নেই, ভুল নেই, ঠিক নেই, আনন্দ নেই, বিষাদ নেই, সে এক প্রবল শূন্যতা। কিন্তু সেই মানুষটাকে যদি কেউ আছে বলে তার সাথে চলবে স্থির করে, তবে সে একটা অসম্ভব পণ করতে চলেছে। কারণ মনে রাখতে হবে, আমাদের আচরণ ব্যক্তির সাথে না, ব্যক্তিত্বের সাথে হয়। আর কাপুরুষ মানে ব্যক্তিত্বহীন, শূন্যতা। শূন্যের উপর প্রাসাদ বানানো যায়? খড়কুটোই দাঁড়ায় না...প্রাসাদ...?!!
(এই লেখাটা পড়েই অবধারিত আমার মেসেঞ্জার, ফোন ইত্যাদিতে প্রশ্ন আসবে – কে? কাকে বলছ? ফেসবুকের এই এক সমস্যা। আসলে ফেসবুক একটা মঞ্চ তো। কেউ সেই মঞ্চে শুয়ে পড়ে হাত-পা ছুড়ে কাঁদুনি গেয়ে বলে, ও পিসি ও শিবুদা আমায় তোল্লা দাও... কেউ তার দুইঘটিসম বিশাল পাণ্ডিত্যে রাম-শ্যাম-নণ্টেফন্টে-বেদব্যাস-শেক্সপীয়ার-রবীন্দ্রনাথ এক আসনে বসিয়ে, মুড়ি মিছরি এক করে চিত্রহার বানিয়ে বাঁদর নাচ নাচে....হাততালি পেতে অসুবিধা হয় না...কারণ সবার নিজের মঞ্চ আছে...সবাই দর্শক খোঁজে...তাছাড়া ফেসবুকের মঞ্চের বাইরেও অনেক দরকার আছে...তাই কারোর মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়লে যদি আদতে বাস্তবিক জীবনে কিছু সুবিধা মেলে সেই অর্থে কিছু মানুষ লেজ নাড়ার গতি ক্রমাগত বাড়িয়েই রাখে.. আরো আরো কত কি...আবার আমাদের মত যারা শব্দ ভাব চিন্তার সমগোত্রীয় মানুষ খোঁজে তারা সেই মঞ্চে উঠে নিজের সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে মনের মত মানুষগুলোকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করে...
কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ করার জন্য এ লেখা নয়, সে ক্ষেত্রে আমার সেই ব্যক্তিটিকে সামনে পেলেই যথেষ্ট...ফেসবুকের মঞ্চে উঠে গাল পাড়ুম ক্যান...জয়গুরু)