মানুষের সব চাইতে বড় গুরু কে? তার শুভবুদ্ধি। শুভবুদ্ধি, ভালোবাসা, অনুকম্পা, কৃপা, উন্মুক্তমনা, সহজতা… এ সব সমার্থক শব্দ। শুভবুদ্ধি থাকলেই আত্মনিয়ন্ত্রণ আসবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকলেই সুখ শান্তি আসবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে কোথায় থামতে হবে জানা। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মেরেছে মানে সে থামতে পারেনি। এই তো!
এখন এই শুভবুদ্ধির উদয় কিসে হয়? এর উত্তর কোথাও নেই। একটা ভিডিও খুব ফেসবুকে ঘুরছে। রামকৃষ্ণ মিশনের বরিষ্ঠ পণ্ডিত সন্ন্যাসী স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ বলছেন ভাষণে, এত যে দীক্ষা হচ্ছে সমাজে তার ছাপ কোথায়?
খুব সঙ্গত প্রশ্ন। দীক্ষা হলেই যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে এমন আশা খুব অসঙ্গত না হলেও, বাস্তব অভিজ্ঞতা সে সাক্ষ্য দেয় না।
অগত্যা শুভবুদ্ধির উদয় হয় না কেন? রবীন্দ্রনাথের একটা গানে আছে, "থেকেও সে মান থাকে না যে, লোভে আর ভয়ে লাজে/ ম্লান হয় দিনে দিনে যায় ধুলাতে ঢেকে ঢেকে"।
শুভবুদ্ধিকে আবৃত করে রাখে ভয়, লোভ আর কুণ্ঠা। আসলে শুভবুদ্ধিকে যা-ই আবৃত করে রাখুক, তাকেই বলি রিপু। মানুষের আসল শত্রু। আজকাল যাকে বলা হচ্ছে নেগেটিভ ইমোশান।
প্লেটো তার যুগান্তকারী গ্রন্থ, 'দ্য রিপ্লাবিক' এ লিখছেন চারটে মানুষের প্রাথমিক সদগুণ - সাহস, সংযম, ন্যায়পরায়ণতা ও প্রজ্ঞা। আবার গীতাতেও বলা হচ্ছে সমস্ত সদগুণের প্রথমটি হল - অভয়। আধুনিক কালের কবি মায়া অ্যাঞ্জেলিউ বলছেন তোমার যদি সাহস না থাকে তবে বাকি কোনো গুণই নেই। স্বামীজির সেই বাণী, দুর্বলতাই পাপ।
তবে আমার এই দুর্বলতাই আমার শুভবুদ্ধির জাগরণের প্রধান বাধা। যুগান্তকারী দার্শনিক, ইমানুয়েল কান্ট মহাশয় তাঁর 'এনলাইটেনমেন্ট' বইতে লিখছেন তুমি চাইলেই সৎ হতে পারো, কিন্তু হচ্ছ না কারণ তুমি ভয়ে বা লোভে নিজেকে হতে দিচ্ছ না। সবাই জানে ঠিকটা কি, কিন্তু ভয়ে সে অবশ।
এখন এই ভয়কে "যাও" বললেই তো যায় না। অমন বীর অর্জুনের দুর্বলতা কাটাতেই শ্রীকৃষ্ণকে টানা আঠারোটা অধ্যায় বলতে হয়েছিল শুধু না, বিশ্বরূপটুপ দেখিয়ে তবে কাজ হয়েছিল। তবে আমাদের উপায় কি?
না, আমাদের কাজটা অত কঠিন তো নয়। আমাদের তো আর কুরুক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে না রে বাবা! আমাদের ভয় দূর করতে হবে ভয়কে দূর করেই। শারীরিক ভয় থাকবেই। সেটা আমাদের আত্মরক্ষার জন্য একান্ত আবশ্যক। আগুনে হাত না দেওয়া, রেললাইনে কম্বল পেতে শুয়ে না পড়া ইত্যাদি। কিন্তু মানসিক ভয়? সে-ই থেকেই তো জগতে এত এত বিকার।
মানসিক ভয় কাটানোর একটাই উপায়, প্রতিদিন একটা একটা করে অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া। সত্যের দিক থেকে পিঠ ফিরিয়ে থাকাকে বলে মোহ। একটা একটা করে মোহকে ঝেড়ে ফেলা। যেমন যার সঙ্গে কথা বললেই ঝগড়া, তার মুখোমুখি বসে একবার সাহসের সঙ্গে দেখা, সমস্যাটা কোথায়? না, বিশ্লেষণ না। ওসব বিশ্লেষণ ভুলভুলাইয়া। যে ঢুকেছে সে আর বেরোয়নি। বিশ্লেষণ না, সরাসরি দেখা। আসল বাস্তবটাকে দেখা। আমার কোথায় বিঁধছে, আসলে আমার অহংকার বা ইগো বলতে যা বলি, সেটা কি? এইরকম ভাবে যদি নিজের একদম মুখোমুখি হওয়া যায়, তবে জীবনে চলতে আর ট্রাফিক পুলিশ বা বাহ্যিক গাইড লাগবে না। নিজের জিপিএসই ঝাক্কাস একদম। শুধু কাঁচটা পরিষ্কার রাখতে হবে। নিজের প্রতিফলনে নিজেকে নিয়ে যেন কোনো আবছায়া না জন্মায়। আবছায়া মানে মোহ। নিজেকে নিয়ে মোহ কাটলে জগতকে নিয়ে মোহ কাটে। তখন মানুষ সন্ন্যাসী হয় না, বাস্তববাদী হয়। যে যত বাস্তবের কাছে সে তত শান্ত, নির্ভীক। যে যত বাস্তবের থেকে দূরে, সে পার্থিব সুখ নিয়েই হোক, কি অপার্থিব, আসলে একই কথা, সে মোহতে। অনুপ্রেরণা বাইরে থেকে হাজার একটা আসতে পারে। কিন্তু আসল কাজে তো কাউকে দিনমজুরি খাটানো যাবে না। সেখানে নিজেকেই নামতে হবে। তাই বাণী তো ওই একটাই -
"সত্যেরে লও সহজে"