Skip to main content
marinating-phase

রেপ অনেক বড় একটা কথা। কিন্তু প্রতিদিন অল্পস্বল্প যে অ্যাবিউজমেন্টগুলো ঘটে চলে তার দিকে তাকালে একটা কমোন ঘটনা পাওয়া যায়।

    আমি যতগুলো ঘটনা শুনলাম আজ অবধি, খুব কাছের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিচিত, শিক্ষক ইত্যাদির থেকে, আমার মনে হয় আমি একটা টার্ম বলতে পারি, ম্যারিনেটিং ফেজ।

    যে অ্যাবিউজ করতে চায়, সে প্রথমেই তার শিকারে ছোবল মারে না। শিকারকে নিয়ে সে খেলবে। আমি মনোবিদ নই। কিন্তু দীর্ঘদিন মানুষের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে, কথা শুনতে শুনতে যেটা আমার সব চাইতে দরকারি আর কম আলোচিত অংশ মনে হয়েছে সেটা হল এই ম্যারিনেটিং টাইমটা। আমি আবারও বলছি এটা কোনো মনোবিজ্ঞানের ভাষা নয়, আমি একটু লিবার্টিই নিচ্ছি এই শব্দটার মাধ্যমে আমার কথাটা বোঝানোর জন্য।

    যে অ্যাবিউজ করে আর এক্সপ্লয়েট করে, তার মধ্যে এই একটা ক্ষমতা থাকেই। ম্যারিনেট করার। ম্যারিনেট করার সময় শিকার নিজের অজান্তেই তার শিকারীকে লিড করে। কিভাবে?

    আমি কয়েকটা দিক নিয়ে একটু কথা বলব।

 

১) অতিরিক্ত বন্ধুতাপ্রবণতা

=================

    যে কোনো বিষয়েই এই 'অতিরিক্ত' দিকটা খুব সন্দেহের। আমাদের চলতি কথাতেই আছে 'অতিভক্তি চোরের লক্ষণ' ইত্যাদি। কেউ যখন অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাবে আমার সব কিছুতে তখন বুঝতে হবে কিছু একটা সমস্যা আছে। তবে এই অতিরিক্ত দিকটা বুঝব কি করে? আমার মনে হয় একটা সহজ পরীক্ষা আছে এর।

    কেউ যখন তার নিজের মতামত, ভালোলাগা, মন্দলাগা সমস্ত উপেক্ষা করে শুধুমাত্র আমার হাঁ-তে হাঁ আর আমার না-তে না মিলিয়ে যাচ্ছে, তখনই সাবধান হওয়া। তার নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে।

    এখন কথা হচ্ছে কেউ যদি আমার প্রেমে হাবুডুবু খায় সে-ও তো একই ব্যবহার করতে পারে।

    হয় তো পারে। আমায় ইমপ্রেস করার জন্য সে আমার পছন্দ অপছন্দকে নিজের থেকে বেশি গুরুত্ব নিশ্চয়ই দিতে পারে। সেখানে এ দুটোকে আলাদা করার উপায় হল, অপেক্ষা করা।

    সময় একমাত্র দিশা দেখাবে। ভালোবাসার ডাক সমগ্র সত্তার ডাক। যে ভালোবেসেছে তার কোনো অপশান নেই ভালোবাসা ছাড়া। সে অপেক্ষা করবে বিনা অস্থিরতায়। সে কোনো বিকল্পের দিকে যাবেই না। সে একান্তভাবে অপেক্ষা করবে আমার সম্পূর্ণ সত্তার সাড়া পাওয়ার।

    কিন্তু যে শিকার করতে এসেছে, সে আমার পাশাপাশি আরো চারদিকে নজর রাখবে কাদের জন্য আরো জাল বিছিয়ে রাখা যায়। কারণ শিকারী নিজের জৈবিক প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত। সব জৈবিক প্রবৃত্তিই ভীষণ তীক্ষ্ণ, অধৈর্য আর চাতুরীসম্পন্ন, অতৃপ্ত। ভালো করে খেয়াল রাখলে, নিজেকে নির্মোহ রাখার চেষ্টায় রাখলে শিকারীর কয়েকটা লুজ বল চোখে পড়বেই পড়বে। যদি নিজেকে না ঠকাতে চাই।

    কিন্তু সেটা করা খুব কঠিন। এই প্রেমহীন, স্বার্থকেন্দ্রিক সংসারে কারোর 'মেঘ না চাইতে জল' নিয়ে আসা ছদ্মবেশী ভালোবাসাকে চিনেও না চেনার দুর্বলতা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই। মানুষ মিথ্যাকে দেখতে পায় না তা নয়, মানুষ মিথ্যাকে দেখেও নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে, ছলনার সঙ্গে তাকে সত্য বলে মেনে নেয়। এ মানুষের চরিত্রের বোধহয় সব চাইতে দুর্বল দিক। নিজের সঙ্গে এ ছলনাটা মানুষ নিজের অজান্তেই করে ফেলে। অবশ্যই সব ক্ষেত্রে নয়। অনেক সময়েই একটা জেনুইন ইনোসেন্স এক্সপ্লয়েটেড হয়, অ্যাবিউজড হয়। ইম্যানুয়েল কান্ট তাই হয় তো আক্ষেপ করে বলেছেন যে ইনোসেন্স জিনিসটা অবশ্যই ভীষণ স্বর্গীয়, কিন্তু ভীষণ মিসলিডিং।

    এই দোলাচালেই শিকারীর ম্যারিনেশানের সময় শিকার অজান্তেই লিড করে শিকারীকে নিজের দিকে। শিকারী তাই বলার সুযোগ পায়, "তুমি যেন চাওনি"। আসলে এই "চাওনি" কথাটা ভীষণ জটিল। বহুমাত্রিক। শরীরকে তো অনেকেই ছোঁয়। চিকিৎসক, বন্ধুদের ইয়ার্কি ফাজলামি, রাস্তাঘাটে গুঁতো-ঠেলা, ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু সে ছোঁয়ায় অপমান জন্মায় না। নিজেকে রিক্ত করে যায় না। অ্যাবিউজ মানুষকে রিক্ত করে। আর এই সুক্ষ্ম খেলায় শিকার বুঝে উঠতেই পারে না, তার নিজের এ খেলায় কতটা অবদান ছিল বা ছিল না। তার মনে এই ধোঁয়াশা যে অত্যন্ত সুচতুরভাবে শিকারী দ্বারা সচেতনভাবে সৃষ্ট, সে কথা সে স্বপ্নেও কল্পনা কর‍তে পারে না অন্তত প্রথম দিকে। পরে যখন বোঝে তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। ঘোর কাটতে সময় তো লাগে।

    দেখুন এই হালকা ফুলকা ম্যারিনেট আমাদের অনেকেই করে। কাজটা গুছিয়ে নেওয়ার আগে সবাই মিষ্টি ব্যবহার করে থাকে, সে সেলসম্যান হোক, নেতা হোক, অনেক ভুঁইফোড় টুরিস্ট সংস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি তো আছেই। স্বয়ং রামপ্রসাদ ম্যারিনেশানের বিরুদ্ধে জগদম্বার কাছে নালিশ জানাচ্ছেন, "নিম খাওয়ালে চিনি বলে"। যা হোক এবার দ্বিতীয় পয়েন্টে আসা যাক।

 

২) শিকারের দুর্বলতার খোঁজ

====================

    এই আরেক জায়গা যেখানে তুমি শিকারীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারো নিজেকে শক্ত রেখে।

    ভালোবাসার মানুষ আমার গুণ খোঁজে। আমার পজিটিভি দিকটাকে এনকারেজ করে। সে এমন কিছু সদগুণ দেখতে পায়, যা আমার ছিল আমি জানতাম কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল না। ভালোবাসার মানুষ সে আত্মবিশ্বাসটা তিল তিল করে গড়ে দেয়। আমি অধৈর্য হলেও সে অধৈর্য হয় না।

    শিকারী আমার দুর্বলতা খোঁজে। যেখানে আমি সহানুভূতির মলম চাই সে সেই খাঁজ, ক্ষতগুলো খুঁজে বেড়ায়। সে সারাদিন মলম নিয়ে ঘোরে। সে দুটো খেলা খেলবেই, এক, আমায় বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বে যে তার চাইতে আমায় কেউ ভালো বোঝে না শুধু না, সে আমায় বোঝাবে যে আমায় কেউ বোঝে না এটা নিয়ে সে নিশ্চিত। আর দুই, সে আমায় আমার পরিবেশ থেকে, আমার আশপাশ থেকে আমায় বিচ্ছিন্ন করবে।

    এ দারুণ টোপ। সবাই নিজেকে স্পেশাল ভাবতে চায়। সবাই মনে করতে চায় তাকে কেউ বোঝে না। যদিও এর খানিকটা সব সময় সত্যি কারণ আমরা কেউ-ই কাউকে স্পষ্ট করে বুঝি না। শিকারী এই টোপটায় আমাকে আমার পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চায়। সে আমার পরিবেশ নিয়ে আমার মনকে নেগেটিভ করে তুলতে চায়। সে চায় আমি যেন তার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করি। আমার চারপাশের শিকড়টাকে খুব সুচতুরভাবে কেটে দিয়ে সে শিকারকে নিয়ে গিয়ে বনসাই করে রাখতে চায়। অবশ্যই এ বিশ্বাস জাগানোর ক্ষমতা বা আর্ট সে অত্যন্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে রপ্ত করে। আর তাকে সে ইন্ধন জোগায় তার অতৃপ্ত বিকৃত জৈবিক লালসা।

    শিকারী এইভাবে সব সময় শিকারের দুর্বলতাকে জাগিয়ে রাখে। দুর্বলতাকে নিজের কপট সহানুভূতির মলম লাগিয়েই যায় যতক্ষণ না শিকার অবশ হয়ে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে দেয়।

    এখানে আরেকটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট আছে। যদি সৌভাগ্যক্রমে শিকার টের পেয়ে যায় খেলাটা, তৎক্ষনাৎ যে আক্রমণটা তার দিকে ধেয়ে আসে, "তোমার মত অকৃতজ্ঞ আর দুটো নেই। আমি তোমার জন্য এত করলাম, তোমায় কে চিনত? আমি না থাকলে তুমি কে? কোথায় পড়ে থাকতে?".... ইত্যাদি তীব্র বিষ বর্ষণে শিকারকে বিধ্বস্ত করে তোলা। শিকারের আত্মসম্মানবোধ, শিকারের বিবেকবোধকে যন্ত্রণার চরম সীমা অবধি নিয়ে যায়, যাতে শিকার নিজেকে ঘৃণ্য, ওয়ার্থলেস, অকৃতজ্ঞ, নীচ ফিল করে। এতে দুটো সুবিধা। এক যদি শিকার আবার এই টোপটা খেয়ে যায়। যে কৃত্রিম খাদের ধারে নিয়ে এসে দাঁড় করাতে চায় শিকারী, একবার যদি তাকে সত্যি বলে মেনে নিয়ে ফিরে আসে। অন্যথায় যদি নাও বা ফেরে শিকারী অন্তত নিজের ইগোটাকে তুষ্ট করতে পারে। অবশ্যই ছলনায়।

    এবারে তৃতীয় পয়েন্টে আসি। যা কিছুটা তাত্ত্বিক।

 

৩) অ্যাবিউজ শুধু শারীরিক হয় না

========================

    শরীর আর মনের এমন পৃথক অস্তিত্ব আর কোনো প্রাণী মানুষের মত অনুভব করে কিনা আমরা জানি না। আর ভালো করে ভেবে দেখলে শরীরকে কখনও অ্যাবিউজ করা যায় না। অ্যাবিউজড হয় মন। প্রমাণ, গভীর ঘুমের মধ্যে আমি অনুভব করি না কোনটা ব্যাড টাচ, কোনটা গুড।

    মনের যে শরীরবোধ, সে আত্মসম্মানের। মনের যে আবেগবোধ, সেও আত্মসম্মানের। কথাটা কিন্তু মন নিয়েই। তাই অ্যাবিউজ যে শুধু শারীরিকভাবে হবে তা নয়। আমার আবেগ, আমার বিশ্বাস, আমার অনুভব, আমার অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, সাম্পর্কিক - আমার যে সত্তাই থাকুক না কেন সে আমার মনের সঙ্গে যুক্ত। আমার মনকে যে অন্ধকারে রাখে সে-ই অ্যাবিউজার। আমি যদি আমার যে কোনো সত্তার কাছে কাউকে আসতে দিই, অবশ্যই যা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে, কোনোভাবেই অফিসিয়াল কারণে নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিশ্বাসে, সেখানে প্রথম শর্তই হল দুজনের উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতাবোধ। সেখানে যেন কোনো ধোঁয়াশা বা আড়াল না থাকে।

    মানুষের সব অ্যাবিউজের যন্ত্রণাই হল বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা। সে-ই বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণাকেই এড়িয়ে চলার শিক্ষা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন করে শিখতে হবে। বিশেষ করে এই সোশ্যালমিডিয়ার যুগে নতুন করে।

    তার প্রথম ধাপই হল ম্যারিনেশানের ফেজটাকে চেনা। আইডেন্টিফাই করা। এবং সতর্ক হওয়া। এতে যদি কিছুটা স্কেপটিক হতে হয় সেও ভি আচ্ছা, কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে ম্যারিনেট হতে দেওয়া নয়। কয়েক বছর আগে এক মহাত্মা, স্বামী রামসুখদাসজী দেহত্যাগ করলেন। তাঁর কোনো ছবি পাওয়া যায় না। কারণ তিনি তুলতে দেননি। তিনি বর্তমান ভারতের অধ্যাত্মজগতের মানুষদের উপর এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে বলেছিলেন, "আপনাদের কারোর কাছে, কোনো গুরুর কাছে যাওয়ার দরকার নেই। বিশেষ করে আমি মা বোনদের বলছি। আপনারা বাড়িতে বসেই প্রভুকে ডাকুন। কোনো দীক্ষার দরকার নেই। নিজেকে প্রতারিত হতে দেবেন না।"

    এই উদাহরণ আমি এই জন্যে দিলাম যে, যে জগতটার প্রথম শর্তই শুদ্ধতা, সে জগতই বর্তমানে কতটা কলুষিত বলে তিনি এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার আশঙ্কা যে মিথ্যা নয় সে প্রতিদিন খবরের কাগজে চোখ বুলালেই বোঝা যাবে।

    অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তার পুওর ইকনমিক্স বইতে 'সুগার ড্যাডি'র কথা বলেছেন। অ্যাবিউজিভ বাবার ঘটনা অবশ্যই কল্পনা কিছু না। অর্থাৎ এ যুগই হল কপটতা আর চাতুরীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার। সবটা হবে না। তবু যতটা সম্ভব। নিজেকে ম্যারিনেট হতে যতটা না দেওয়া যায় আরকি। আর কিছুটা হয়ে ফেললেও সঙ্গে সঙ্গে কলের তলায় দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে নেওয়া। যতটা নিজেকে বাঁচিয়ে চলা যায়। আর কি!