১
---
তো হল কি, অনেকে বলছেন কাল কেমন বেড়ালুম সে বিষয়ে কিছু লিখতে। প্রথমে ভাবলাম লিখব না, কারণ গন্তব্য (কামারপুকুর-জয়রামবাটি) কিছু নতুন জায়গা নয়, আগেও গেছি, আর যাঁদের উদ্দেশ্যে যাওয়া তাঁরাও ঘরের মানুষ। তবে আর লেখার কি থাকতে পারে?
কিন্তু স্বভাবের দোষ বলে একটা কথা তো আছেই না! হাত যে নিশপিশ করতে থাকে। গল্প বলার ইচ্ছাটা ভিতরে ভুড়ভুড়ি কাটতে থাকে। অকম্মের ঢেঁকি হলে যা হয় আর কি! তাই ভাবলাম শুরু তো করি, না হয় কোনো গভীর তত্ত্বকথা নাই বা লিখলাম, ক’টা প্রাণের কথা লিখতে দোষ কি?
তো প্রায় রাতারাতি ঠিক হল - হৃদি কামারপুকুরে চলো মন। সাতসক্কালে পাড়ি দিলাম (সে খবর তো আপনাদিগের জানা, নইলে অত ভোরে কোবতে লিখে স্টেটাস দিতে কে যায়!)। ন’জন বন্ধু। নানান গল্প, লেগ পুলিং, সৎ প্রসঙ্গ, ইতর প্রসঙ্গ ইত্যাদি নিয়ে সাড়ে তিন ঘন্টার পথ। অবশ্যই উল্লেখ্য অসাধারণ রাস্তা! আমার পূর্বের অভিজ্ঞতায় রাস্তার অবস্থা খুব করুণ ছিল। এবারে দেখলাম পুরো ঝাঁ চকচকে, মসৃণ রাস্তা।
পৌঁছালাম কামারপুকুর হয়ে জয়রামবাটি। তখন দশটা। দুপুরে প্রসাদের জন্য কুপনের ব্যবস্থা থাকে। আগেই গেলাম সেই লাইনে। কুপন দেওয়া হচ্ছে। ছোট একটা ঘরে সন্ন্যাসী বসে, পাশে জনকয়েক টকটক করে লিখে ফেলছেন নানাবিধ ক্ষুধার্ত ভক্ত তথ্যাবলী। একজন ভদ্রলোক, কালো মোটা বেঁটেখাটো চেহারা, উদগ্রীব মুখে বললেন, “মহারাজ (সন্ন্যাসীদের এই নামে ডাকা হয়। নিশ্চয় কিছু গভীর আধ্যাত্মিক কারণ থাকবে। সে জানি না। তবে চেহারা ও মেজাজ- দুই মহারাজাজনিত হওয়ায় সে তত্ত্ব আর ঘেঁটে দেখার কারণ দেখি নে।), আমার পাঁচটা কুপন লাগবে।” মহারাজ গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “তা তারা কই?” ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, “এই আশেপাশে আছে আর কি।” মহারাজ সাতিশয় বিরক্ত হয়ে উঠলেন, সাথে তার পার্ষদরাও (পুরো রাজসভার মতই আর কি!), বললেন, “আনুন দেখি আগে।” (আমি ভাবলাম, হয়তো চেহারা বুঝে চালের মাপ নেবেন, অ মা! তা না গো। পরে শুনলুম, এনারা অদৃশ্য দ্যাবতাকূলে যে ভরসা রাখেন, দৃশ্য মনুষ্যকূলে সে ভরসা রাখতে পারেন না, মানুষ এতই দুষ্ট হয়েছে; তার কারণ অবশ্য নাকি কলি। কথাটা অস্বীকার করারও উপায় নেই। আমার সব পূর্বপুরুষেরাই এই কলিকালেই জন্মেছিলেন, তাই কলির আদিঅন্ত আজও ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। আর দুষ্ট মানুষ যে আছে সে আর জানিনে! এত কষ্টে উপার্জিত অর্থ এঁদের, সেও যদি বারোভূতে লুটেপুটে খায়, তো দেশোদ্ধারটা কে করবে শুনি?) তো হল কি, একঘর গিজগিজ করছে ভক্তের দল, তায় আবার এতক্ষণ লাইনে দাঁড়াবার পর তিনি যখন শুনলেন মহারাজ সক্কলকে দেখতে চান, তার তো কাঁদোকাঁদো অবস্থা। তিনি কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন; উঁহু, এ বৈরাগ্যের প্রাণ বাছাধন, ওতে গলবেনি, অগত্যা তিনি সক্কলের উদ্দেশ্যে বাইরে এলেন।
আমি ইতিমধ্যেই আমাদের গ্রুপের সক্কলরে তলব দিয়ে বাইরের জানলায় দাঁড়াবার অনুরোধ জানালাম (অমনটাই রীতি আর কি, মহারাজ তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে তাদের ক্ষুধার সততার মান বিচার করে কুপন দেবেন, অবশ্যই প্রণামীর বিনিময়ে হলেই ভালো)। তা কুপন নিয়ে বাইরে আসতেই দেখি সে ভদ্রলোক কোলে পিঠে দু’জনকে নিয়ে, পিছনে পিছনে তিনজন অবগুণ্ঠিতা রমণী সমভিব্যাহারে চলেছেন পরীক্ষালয়ের দিকে, থুড়ি মহারাজের ঘরের দিকে।
এবার মন্দিরে এলাম। সারদাদেবীর প্রস্তরমূর্তির সামনে সব চোখ বন্ধ করে বসে। ভাবলুম বসে কি হবে, চোখ বন্ধ করলেই তো সব সমান, সে আমার ঘরই হোক, কি এই মন্দির। বাইরে এলাম। উদ্দেশ্য আমোদর নদ। চড়া রোদ। একটা ভ্যান পেলাম। সাথে বেশ লম্বা খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা মাঝবয়েসী ভ্যানচালক। মুখটা দেখে বেশ লাগল। একটা নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা আবার একটা কিছুর তৃষ্ণাও যেন। বললুম, “আমোদর নদ যাবে?” সে বলল, “ক’জন?” বললাম, “নয়জন, কত নেবে?” বলল, “নব্বই।” ওর বলার ধরণটা বেশ লাগল, যেন ওর ভাবতে পারা সবচাইতে বড়দরটা হেঁকেছে। বলেই সে আমার মুখের দিকে কুতকুত করে তাকাতে লাগল। আমারও মজা করার ইচ্ছা চাপল, বললাম, “দেব না নব্বই। একশো দেব।”
সে ক্ষণিক চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকালো। তাকাবেই তো! আরে বাবা সংসারে তার আর আমার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক সেটা অর্থ ছাড়া আর কে বুঝিয়েছে অমন করে? তাই সে ভাবল - ইয়ার্কি। যেই তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ডাকি সক্কলরে?” সে হেসে বলল, “তাইলে তো ভালোই হয়!” চড়লাম। সুমন ক’টা কলা কিনেছিল, বললুম, “খাও।” সে নিল। আমাদের ভ্যানের তলায় যন্ত্রের আওয়াজ- ভটভট... ভটভট... উপরে আমাদের হইহট্টগোল... সেও হাসছে... নিজের গ্রামের কথা বলছে... আমরা যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, সেও বেশ মজছে। আমিও এতক্ষণে একজন অভক্ত পুরোদস্তুর মানুষ পেয়ে খুব স্বচ্ছন্দ অনুভব করছি। একটা গাছের গুঁড়িতে বসে তার সাথে গ্যাঁজাচ্ছি, একবন্ধু এসে বলল, “আপনার একটা ছবি নেব?” চালক প্রথমে ঘাবড়ে গেল, তারপর একগাল হেসে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “দাড়িটা যে কাটা হয়নি।” আমি বললুম, “নাই বা হল, হোক ছবি।”
ছবি হল, ফিরে এলাম। প্রসাদের লম্বা লাইন। একজন সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরা মাঝবয়েসী ভদ্রলোকের পায়ে আমার এক বন্ধুর পা লাগতেই তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “আপনি মায়ের লোকের গায়ে পা দিলেন!” বন্ধুটি অবশ্য বলল যে সে ওই ‘মায়ের লোকের’ মাহাত্ম্য আগে জানত না, তাছাড়া ইচ্ছাকৃতও নয় ঘটনাটা।
যা হোক, লাইনে উৎকৃষ্ট সব আলোচনা চলছে। কোন মহারাজের সাথে কার ঘনিষ্ঠতা কত বেশি। কে কতবার মঠে যায়, কত জপ করে, কোন নক্ষত্রে কতবার জপে কি কি ফল... বলছেন, আর লাইনের মুখটা এগোচ্ছে কিনা খেয়াল রাখছেন। আমার সামনে একজন পঞ্চাশের কাছাকাছি উন্নাসিক ভক্ত দাঁড়িয়েছিলেন। তার সঙ্গীর সাথে হাইফাই গল্প করছেন, আর আড়চোখে আমাদের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন; বুঝছি উনি ইম্প্রেশান জমাতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমাদের ভক্তিহীন প্রসঙ্গে বারবার নিজের উচ্চ প্রসঙ্গ ব্যর্থ হওয়ায় চটেমটে নিজের সঙ্গীকেই বকাঝকা শুরু করলেন। আমার একটা ঘটনা মনে পড়ল। বেলুড় মঠে একটা বই কিনছি। দু’জন ভদ্রলোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে ক্যাসেট দেখছেন (তখনও সিডি আসেনি বাজারে), একজন বললেন, “এই বেদপাঠের ক্যাসেটটা নাও, আমি রোজ সকালে অফিস যাওয়ার আগে চালাই।” তার সঙ্গীটি বললেন, “আরে আমি তো সংস্কৃত কিছু বুঝি না।” তার সঙ্গীটি বললেন, “আহা, তুমি না বোঝো, তুমি চালালে পাশের বাড়ির লোক বুঝবে, হুঁ হুঁ কিছু একটা চলছে।” সঙ্গীটি ক্যাসেট কিনলেন। বুঝলাম পুরোদস্তুর ভক্ত হয়ে গেলেন।
মেয়েদের লাইনে অন্যকরম গল্প। ঘর গেরস্থলির নিত্যকার পরিচিত গল্প, আমার মনে হয় মেয়েরা বেশিক্ষণ ভান করতে পারে না, তাই যত উচ্চমার্গের আলোচনা দিয়েই শুরু করুন না কেন, একটু রান্নাঘরের গন্ধ কথাতে পেলেই ঢুকে পড়েন নির্দ্বিধায়, আর মনে মনে নিশ্চই বলেন, আঃ দিদি বাঁচালেন, ব্রহ্ম আলোচনা করতে করতে শুনতে শুনতে আরেকটু হলেই পা পিছলিয়ে সে ব্রহ্ম পোড়ারমুখোর ঘাড়ে পড়েছিলুম আর কি!
২
---
খাবার ঘরে ঢোকার সুযোগ হল। বিশাল হলঘর। মেঝেতে লম্বা মাদুর মতন কিছু একটা পাতা। সার দিয়ে বসানো হচ্ছে। পাশের লোকের থেকে আমার তিলমাত্র ফাঁক হলেই রে রে করে ভলেন্টিয়াররা তেড়ে আসছেন। আন্তরিক বকাঝকার সাথে সবটা ম্যানেজ করা হচ্ছে। সেই ভদ্রলোক আমার কয়েকজনের পরেই বসে। ইতিমধ্যে আমার উপর বেজায় চটেছেন, কারণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “এটা ছাড়া কুপনের আর লাইন হয় কি?” উনি ভর্ৎসনার ভঙ্গীতে বললেন, “কুপনের না, প্রসাদের লাইন বলুন।” বুঝলাম কুপনের ব্যাপারটা প্রসাদের মাহাত্ম্যে অযথা টাং অ্যাড়াক ওনার পছন্দ না।
যা হোক সক্কলে কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে খাওয়া শুরু করলেন (আবার ইতর শব্দ, প্রসাদ গ্রহণ করতে শুরু করলেন)। সাথে আন্তরিক হম্বিতম্বি যারা শিবজ্ঞানে জীবসেবা করছেন তাদের। তারা খাইয়ে কৃতার্থ করছেন এমন ভাব, আর এরা খেয়ে ধন্য হয়ে যাচ্ছে এমন ভাব। মনে হচ্ছিল যেন কয়েদীদের খাওয়ানো হচ্ছে। মৃদু ব্যবহার নেই, ভালোবাসা নেই, সম্মান জানানো নেই। আসলে থাকবেই বা কি করে? সব তো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে খরচ হয়ে গেছে, ভাঁড়ার তো শূন্য। আর সবই তো কর্মচারীরা করছেন, একজন সন্ন্যাসী শুধু দূরে দাঁড়িয়ে তদ্বির করে চলেছেন কর্তব্যজ্ঞানে।
এলাম কামারপুকুর। দরিদ্র মহিলারা আশেপাশে ঘুরতে লাগলেন, “দাদারা চলুন না ঘুরিয়ে নিয়ে আসি ঠাকুরের সব জায়গাগুলো, নিজেরা চিনতে পারবে না গো!” (‘গো’ - কথাটা একটা বিশেষ টানে উচ্চারণ করেন সব্বাই)। চেনা পথ, তাই নিলুম না কাউকে। হালদার পুকুরে সাপ দেখলাম, লাহাদের বাড়ির কিছুদূরে আকণ্ঠ মদ্যপানে দাঁড়াতে না পারা মাতাল দেখলাম, মাছের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকা পুচকে পুচকে ছেলের দল দেখলাম, ভাঙ্গা পরিত্যাক্ত দোতলা বাড়ি দেখলাম, ঠাকুরের পাঠশালায় সেলফি তোলা নরনারীর ভক্তিমহিমা দেখলাম। সব ঘুরে মন্দিরে যখন এলাম- সাড়ে তিনটে। দরজা খুলল। ঠাকুরের প্রস্তরমূর্তির সামনে দাঁড়ালাম।
মনটা টাটাতে লাগল। “কি চাই তোমার?” ঠাকুর না, আমি জিজ্ঞাসা করলাম। বললাম, “হ্যাঁ গো, তুমি কি তবে একটা পাথরের সাদা মূর্তি হবে বলে এত কিছু করলে? পুরো পৃথিবীটা যখন অর্থ আর বিকৃত কামনায় জর্জরিত হচ্ছে, তখন তুমি একটা সহজ রাস্তা বাতলে গেলে। ‘ভালোবাসো’ এই একটা প্রাচীন মন্ত্রকে নানান উপাচারে সাজিয়ে মানুষকে পূজা করে গেলে। জগতের মাকে নিজের মা বলে ভালোবাসতে বললে। সেই মায়ের একটা জলজ্যান্ত রূপও জয়রামবাটি থেকে আনালে। তারপর? কি হল? কি হচ্ছে? তোমায় ঘিরে এই মহারাজ কালচার শুরু হয়ে গেল কি করে গো? এত শাসন, এত নিয়ম, এত আড়ম্বর, এত ভেদাভেদ... তোমার পোষাতো এগুলো? প্রেমের বাণী তো বই খুললে আর ভাষণে, কিন্তু কাজে কই?”
“তবু তুমি থাকো। এই অসম্পূর্ণতার মধ্যেও থাকো। তুমি গেলে সব্বনাশ। ঘোর অন্ধকার।” অফিসঘরের বাইরে দেখলাম, এক প্রতিবন্ধী ভদ্রমহিলা, হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, সিঁড়িতে উঠতে চেষ্টা করছেন। এক পা তুলে আরেক পা তুলতে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, মুখের বিকৃতিকে হাসিতে ঢাকতে ঢাকতে নিজের থেকেই বলছেন, “ও কিছু নয়, ও কিছু নয়।”
রক্ষী একজন এসে বলল, “আপনি টাকাটা দিন, আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসছি”, উনি বললেন, “না। আমি নিজে যাব।” গেলেনও, আমার কেবল মনে হতে লাগল, ওই বিশালবপু গেরুয়াধারী এমন কি অর্জন করেছেন যে নেমে এসে ওনার হাত থেকে প্রণামীটা নিতে পারলেন না! উনি নিশ্চই সাশ্রুনয়নে সে উপকারটা মাথায় করে রাখতেন। না কি আমার বন্ধুর কথাটাই সত্যি, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হ্যাঁ রে মঠের চারদিকে এমন কাঁটাতারের বেড়া কেন রে?” সে বলল, “আরে অনেক দামী দামী মহারাজেরা থাকেন না! যদি কেউ উঠিয়ে নিয়ে চলে যায় তো!”
ফিরবার পথে পা বাড়ালাম। মনের কোণে একটাই কথা গুনগুন করতে লাগল, তবু তো এই সেই মাটি, যেখানে এমন দু’জন জন্মেছিলেন যাদের কিছু প্রয়োজন ছিল না নিজেদের জন্য - না অর্থ, না বিলাস, না নাম, না খ্যাতি। যারা মানুষের কাছে স্বর্গের না, মানুষের ঈশ্বরকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন, প্রতিদানে কিছুই না চেয়ে। বললেন, জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। জিজ্ঞাসা করলাম, সেটা কি? বললেন, হৃদয়টাকে মাঠ করে দেওয়া, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া না। ওতে নিজে বেরোতেও খোঁচা, অন্যের আসতেও খোঁচা।