Skip to main content
'মত কিছু ঈশ্বর নয়' - ঠাকুর বলতেন। মত পথ। মতের প্রচার চলে, সত্যের নয়। তবে সত্যের সাথে মতের সম্পর্ক কি? মত হল সত্যের শরীর। ভাবটা রবীন্দ্রনাথের। শরীর জীর্ণ হয়, আত্মা অর্থাৎ সত্য নয়। এই সত্যের প্রকাশ কোনো মতকে আশ্রয় করেই হয়। আলো যেমন কোনো বস্তুতে প্রতিফলিত না হলে আমার চোখে ধরা দেয় না, তেমনই অন্তরজীবনের অনুভূত কোনো সত্য, কোনো দর্শন অথবা মতকে আশ্রয় না করলে দানা বাঁধে না।
শরীরের যেমন একটা স্থূলত্ব আছে, মতের অথবা দর্শনেরও তেমন একটা স্থূল দিক আছে। যত দ্বন্দ্ব, যত বিরোধ, যত অসহিষ্ণুতা এই স্থূল দিকটাকে নিয়ে। একজন রসায়নশাস্ত্রে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে যদি রসায়নের পরীক্ষাগারে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে সে সবকিছুকেই তার সীমিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখবে ও একের সাথে আরেক বস্তুর মধ্যে বিরোধ, অসামঞ্জস্যতা অনুভব করবে। কারণ দুটো আপাতবিরোধী বস্তুর মধ্যে যোগসূত্র গঠন করতে লাগে গভীর জ্ঞান অথবা গভীর উপলব্ধি। প্রথমটা বাহ্যিক বস্তুজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য, দ্বিতীয়টা মনের জগতের জ্ঞানের বিষয়। 
উপনিষদ বলেন, 'সত্য বস্তু এক, জ্ঞানী তাকে নানানভাবে প্রকাশ করেন।' ঠিক কথা। তবে কিসের মাধ্যমে প্রকাশ করেন? ভাষার মাধ্যমে, ভাবের মাধ্যমে। আবার একটা নতুন শব্দ এলো - ভাব। এটা ভাষার থেকে উৎকৃষ্ট প্রকাশমাধ্যম। কারণ এ আরো সুক্ষ্ম। তাই যত ভাবের গভীরে মরমী সাধক পৌঁছেছেন, তিনি তত অনুভব করেছেন সব বিরোধের অসারতা। অনুভব করেছেন, 'সব কা মালিক এক'- সাঁই, কিম্বা 'সবাই সেই এক'কেই চাচ্ছে'- ঠাকুর। এই ভাবের গভীরে ঢোকাকেই সাধন বলে। অনুভবের গভীরে। বুদ্ধ যখন বলছেন, 'বিদ্বেষ দ্বারা কখনো বিদ্বেষ নিবারিত হয় না, তা শুধুমাত্র বিদ্বেষহীনতা দ্বারাই প্রতিহতযোগ্য' - তখন তিনি বৌদ্ধিক যুক্তির কথা বলছেন না, বলছেন অন্তরের গভীরে যে আলোর স্পর্শ অনুভব করেছেন, সত্য বলে জেনেছেন, তার কথা। বার্ট্রান্ড রাসেলও যখন সহিষ্ণুতার কথা বলছেন, সাথে সতর্কও করছেন, যে এই সহিষ্ণুতার বাণী না প্রচারিত পালিত হলে মনুষ্যসমাজের তথা এই পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে না, তখন তিনি সাথে সাথে এও বলছেন, এ হল অনুভূতির কথা, মরমের কথা, ভাবের কথা।
সারদাদেবী কি অদ্ভুত সরলতার সাথে দিকনির্দেশ করছেন - 'ঈশ্বর হল মনের ধন বাবা।' তাই তো। ঈশ্বরের অনুভব একটা অস্তিত্বের অনুভব, চেতনার অনুভব, আনন্দের অনুভব। তাই উপনিষদ বলছেন, তিনি সচ্চিদানন্দ। অর্থাৎ তিনি সত্য - অস্তিত্ব, তিনি চেতন - জ্ঞান, তিনি আনন্দ -প্রেম। কিন্তু কথা হল এগুলো সব আমার মধ্যেও বর্তমান! তবে কি আমিও ঈশ্বর? উত্তর 'হাঁ'ও বটে 'না'ও বটে। আমাতে আর তাঁতে গুণগত মিল আছে, নেই পরিমাণগত মিল। আমার অজ্ঞানতা আছে, নিরানন্দতা আছে। যদি না থাকত তবে আমাতে আর তাঁতে ভেদ থাকত না। যেমন নেই বুদ্ধ, খৃষ্ট, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ ইত্যাদি দেবমানবদের জীবনে। সেখানে সবসময় আলো, সেখানে সবসময় প্রেমের ঠাণ্ডা বাতাস। আবালবৃদ্ধবনিতা, ধনী-দরিদ্র, তাদের শরণাপন্ন হচ্ছেন শান্তির জন্য, আনন্দের জন্য। তাঁরা কি তবে মত? না, তাঁরা এক একটি আলোকস্তম্ভ। সে আলোকস্তম্ভের দৈর্ঘ্য, উচ্চতা ইত্যাদির পরিমাপে যেও না। ঠকবে। আলো'কে নাও দু'হাত ভরে। দেখো কোনো বিরোধ নেই। প্রত্যেকে সত্যের পূর্ণ প্রকাশ। অনুভবে, বিচারে নয়।
তবে সত্যকে অনুভব করব কোন মতে? যে মতে আমার রুচি। ঠাকুরের সেই গল্প। ধোপাঘরের গামলা। যে যে রঙের কাপড় চায়, সেই রঙের কাপড় পায়। একজন এসে জিজ্ঞাসা করল ধোপাকে, 'তুমি নিজে কোন রঙে ছুপেছ?' ধোপা হেসে ফেলল। প্রশ্নকর্তা সেই রঙেই ছুপতে চায় যে!
তাই মতকে অগ্রাহ্য করার যেমন উপায় নেই, তেমন তাকেই সত্য বলে আঁকড়ে ধরারও অর্থ নেই। সত্য স্বপ্রকাশ। মত শুধু সিঁড়ি। ব্যস, এটা বুঝলেই আর গোল নেই।