অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শনে ভয় পেয়েছিলেন। “ভয়েন চ প্রব্যথিতং মনো মে”। আমার মন ভয়ে ব্যথিত হয়েছে। ভয়ে ব্যথা জন্মায় মনে।
সোনার লঙ্কায় সব ছিল। সঙ্গে ভয়ও ছিল। সেদিন নবদ্বীপেও ভয় ছিল, সচ্ছলতা থাকতেও, জগাইমাধাইয়ের ভয়। মুহম্মদ যখন শেষবার মক্কায় গেলেন, তিনি দুই যুযুধান সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটা মিটিয়ে দিতে চাইলেন সেটা হল একে অন্যের প্রতি ভয়। খ্রীষ্ট ধর্মগুরুদের যথেচ্ছাচার থেকে, নানা অমানবিক বিধানের ভয় থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন। বুদ্ধ ধর্মের নামে মানুষকে নানা কৌশলে, আচারে-অনুষ্ঠানে মানুষকে পিষে ফেলার যে সব কায়দাকানুন চলছিল তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন।
রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা নাটকের কথা যদি মনে করি, রক্তকরবী। অচলায়তন। মুক্তধারা। সেখানেও সেই একই কথা ঠাকুর্দা, ফকির, বাউলের মুখে। ভয়ের থেকে বেরিয়ে আসার কথা। ভয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা।
ভয় মানুষের অভিব্যক্তির একটা আদিম আবেগ। তার আগে যতটা কাজ ছিল, এখন ততটা নেই। নানা বিপদজনক, ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপের হাত থেকে বাঁচিয়েছে ভয়। শিকারী প্রাণীর হাত থেকে বাঁচিয়েছে ভয়। আজও শারীরিক অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সচেতন করে ভয়ই। অতিরিক্ত অ্যালার্ট হয়ে যাই আমরা। ফলে বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ক্ষিপ্র তৎপরতায় নিজের সবটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করে বেরিয়ে আসতে পারি।
কিন্তু এই আদিম ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সভ্যতায় আরেকটা ভয়ের আমদানি হয়েছে। ভয়কে ব্যবহার করার ভয়। মানুষের আত্মায় স্বাধীনতার জন্য স্পৃহা আছে। সে বিশাল বাড়িতে, সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও অন্যের অধীনে থাকতে চায় না। নিজের নিতান্ত ছোটো একটা ঘরে, নিজের ইচ্ছামত থাকতেই সে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এটাই মানুষের প্রকৃতি। কয়েকজন যে এর ব্যতিক্রম নেই তা নয়, কিন্তু তাদের নিয়ে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস লেখা হয় না। তাদের নিয়ে মানুষের কোনো গৌরবও নেই।
রক্তকরবীর নন্দিনী রঞ্জনের অপেক্ষা করেছিল। রাজা তাকে নিজের মত করে ভালোবেসেছিল। রাজার সব দিকে নজরও ছিল। রাজাকে মানুষ ভয় পেত। সে ভয় শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয় নয়। ক্ষতির আশঙ্কাজনিত ভয়।
ভয় শব্দটার তাই ভালো খারাপ দুটো ব্যবহারই আছে। রাশভারি মানুষকে দেখে যে ভয়ের কথা আমরা বলি, সে শ্রদ্ধা মিশ্রিত সমীহ। এখানে সমীহ করাকেই ভয় বলছি। কিন্তু একজন প্রবল ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের যথেচ্ছাচারের সামনে যে ভয় পাচ্ছি, সে নিজের ক্ষতির আশঙ্কার ভয়। সে সমীহ নয়। নিজের কাছে নিজে যদি স্পষ্ট, স্বচ্ছ উত্তর চাই, আমি কি তাকে সমীহ করছি? না। আমি তাকে পাতি ভয় পাচ্ছি।
সমীহ চাইলেই করা যায় না। সমীহ জন্মায়। সমীহ যার প্রতি জন্মায় সেখানে তার কৃতিত্ত্ব আর তার কৃতিত্বকে অনুধাবন করার আমার ক্ষমতার সমীকরণে সেটা জন্মায়।
সমীহের বিপরীতে আরেকটা শব্দ আছে। যুক্তিজাত ভয়। সামনে একজন বন্দুক নিয়ে এলে অতি নির্বোধ ব্যক্তিও ভয় পায়। কিন্তু ভুল শিক্ষায় কী ভয়ংকর দিন আসতে পারে সেটা যুক্তিজাত ভয়। সেদিন রবীন্দ্রনাথ ইংরেজের শিক্ষাব্যবস্থায় সে ভয় পেয়েছিলেন বলেই শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোনোভাবেই ইংরেজের অ্যাফিলিয়েশন না নিয়েই করেছিলেন। এই যুক্তিজাত ভয়কে অনুধাবন করতেও তাই একটা নির্দিষ্ট মানের বোধশক্তির প্রয়োজন হয়। চাতুরী ধরতে যে বুদ্ধিমত্তা লাগে তা প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতা না। তা সঠিক শিক্ষার চর্চায় জন্মায়।
ভয়ের ব্যবহার হল অতিক্ষমতা সম্পন্নের সব চাইতে নিকৃষ্ট ব্যবহার। যে শিক্ষকের নিজের শিক্ষার উপর ভরসা যত কম বেতের উপর নির্ভরতা তত বেশি। সে ক্লাসরুমে এসে আগেই বেতটা টেবিলের উপর রাখে। তাতে কাজ হয় না তা নয়, হয়। বেতের ভয়ে চুপ করে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এই সংখ্যা ভীষণ অস্থায়ী। ইতিহাস সংখ্যার ইতিহাস হলে আজও সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরত, আজও ঈশ্বর সাতদিনে পৃথিবী সৃষ্টি করত, আজও সতীদাহ হত, আজও হিটলারতন্ত্র জার্মানকে গ্রাস করে থাকত। সেদিনও বেতের শাসনে শাসিতের সংখ্যাই বেশি ছিল। কিন্তু মানুষের ইতিহাস সংখ্যার ইতিহাস না। সত্যের ইতিহাস। সে সত্য হল, ভয়ের বিরুদ্ধে যে দাঁড়ায়, ঝুঁকি নিয়ে হলেও তার পাশেই মানুষ এসে দাঁড়ায়। নইলে ডাণ্ডি মার্চে ওই নিরস্ত্র মানুষটার পিছনে এত সহস্র মানুষ হাঁটত না। মার্টিন লুথারও আমেরিকার রাস্তায় একাই হাঁটতেন।
ভয় প্রভাবশালীর শেষ অস্ত্র। আর মানুষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মানুষ সব চাইতে বেশি ঘেন্না করেছে এই ভয়কে। মেরুদণ্ডহীন, নেতিয়ে পড়া মানুষ নেই বলছি না। কিন্তু তারা এতটাই নীচে, অন্ধকারে, ধর্তব্যের বাইরে যে তারা মন্দ-ভালো কোনো আলোচনাতেই থাকে না। তাদের যুক্তিবুদ্ধি, হিসাবনিকাশ সব থাকে। কিন্তু এমনই হীন তারা যে নিজের জ্বলে ওঠার সামর্থ্য নেই শুধু না, অন্যের আগুনে জ্বলে ওঠার ক্ষমতাটাও নেই।
ভয়কে যে ব্যবহার করে তার সে ভয়ের অধীন হতে ভয় পাওয়া মানুষের প্রথম কর্তব্য। পরের কর্তব্য হল সেই ভয়ের বাইরে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো। মানুষের বিবেকেরও একটা রুচিবোধ আছে। সে রুচিবোধই তাকে সে শক্তি জোগায়।
রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলো আবার করে পড়ার, ভাবার সময় এসেছে। কেন নন্দিনী রাজার ভালোবাসা, রাজার দাবী এড়িয়ে রঞ্জনের অপেক্ষায় ছিল তা আবার করে পড়ার সময় এসেছে। প্রত্যেক যুগেই আসে এমন একটা সময় যখন রঞ্জনের জন্য অপেক্ষা তাগিদে পরিণত হয়। ভয়ের অধীনে বাস করার থেকে অপমানজনক অভিজ্ঞতা মানুষের আত্মার আর কিছুই নেই। তাই ভয়ের অধীনে থাকা মানুষদের উপর করুণা জন্মাতেও বিবেকের রুচিবোধে লাগে।
সত্য কোনো তত্ত্ব না। সত্য জীবনের গভীরতম আলো। যা অধীন হয় শুধু নিজের। গীতায় মানুষের সদগুণ আলোচনা করতে গিয়ে প্রথম শব্দ বলে, অভয়। অভয় মানে যে ভয় দেখায় তার অধীন হতে অস্বীকার করা। তারপর কী হবে? গানে আছে।
আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান।
দাঁড় ধ'রে আজ বোস্ রে সবাই, টান রে সবাই টান॥
বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী,
ঢেউয়ের 'পরে ধরব পাড়ি-- যায় যদি যাক প্রাণ॥
কে ডাকে রে পিছন হতে, কে করে রে মানা,
ভয়ের কথা কে বলে আজ-- ভয় আছে সব জানা।
কোন্ শাপে কোন্ গ্রহের দোষে সুখের ডাঙায় থাকব বসে।
পালের রশি ধরব কষি, চলব গেয়ে গান॥