সৌরভ ভট্টাচার্য
3 April 2018
আমার একটা ঘর আছে। তার চারদিকে চারটে দেওয়াল আছে। তার মাথার উপর ছাদ আছে। ছাদে একটা পাখা ঝোলে। কখনও ঘোরে, কখনও হাঁ করে নীচের দিকে তাকিয়ে ঝুলে থাকে। ঘরে চেয়ার টেবিল খাট বিছানা তোষক বালিশ চাদর ইত্যাদি আছে। এখন কথা হল এগুলো তো সবার বাড়িতেই আছে। এ বলার কি আছে?
বলার আছে। আমি এদের যে রাতদিন দেখি, কখনও খেয়ালে রাখি, কখনও রাখি না এরা তা জানে না। জানার কথাও না। কারণ এরা জড়। আমার কিছুটা জড় হলেও পুরোটা ঠিক জড় নয়। জড়ের বোধ থাকলে আর নিজেকে জড় বলি কি করে? আমার জন্য আমার মন কেমন করে। আমার জন্য আমার ভাবনা হয়। আমার উপর আমি উদাসীনও হই। আমাকে নিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা। এও নতুন কথা কিছু নয়। সবারই সবাইকে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা থাকে। কথাটা হল আমি আমার থেকে পালাতে চাই। অন্য আমি হতে চাই। আপনার আমিকে আমি ভালো করে খেয়াল করি রাতদিন। আপনি জানে না। আমি আপনার সাথে আমার তুলনা করি রাতদিন, আপনি জানে না। কারণ আপনি নিজেও তাই করেন। আমরা একটা জালের মধ্যে আটকে রাতদিন লুকোচুরি খেলছি। এটা রূপক। জাল আবার কি? ও একটা তুলনা।
আমার আমার থেকে পালাতে ইচ্ছা করে। সমুদ্র, নদী, পাহাড়, বই, সিনেমা – কিছুক্ষণের জন্যে এ কাজে সাহায্য করলেও সবটা এদের দিয়ে হয় না। আমাদের মধ্যে তাই একটা মৃত্যু বিলাসিতা থাকে। যৌবনে বেশি থাকে। বয়েসের সাথে সাথে সত্য অর্থে মৃত্যু, মানে মেডিকাল ডেথ, যত কাছে আসতে থাকে তত সব গুলিয়ে যেতে থাকে। তখন ওসব রোম্যান্স আর ভাল্লাগে না। তবু পালাতে ইচ্ছা করে। অন্য আমি হতে ইচ্ছা করে। আপনি বলবেন যৌনতার কথা।
বাংলা ভাষায় যৌনতার কথা বলা যায় না। সংকোচ লাগে। বাংলা ভাষাটার আশেপাশে যেন মা-মাসি-পিসী দাঁড়িয়ে। কিন্তু তবু সে যৌনতাও একঘেঁয়ে। শরীরের একটা ভোগের সীমা আছে। মানে স্নায়ুর। একটা স্নায়ু একই অনুভূতি অনেকক্ষণ নিতে পারে না। স্নায়ুর মধ্যে একটা আমি লেগে আছি – চিকিৎসাশাস্ত্র বলে। আমি আপনি বুঝি না। আমি আপনি বুঝি আমি আছি। আমায় নিয়ে লোপালুপি খেলছে সময় আমার পরিবেশ। আমায় ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। নইলে যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে হবে। যদিও একবার পড়ে যেতে হবেই। হঠাৎ একদিন আলো নিভে ভোকাট্টা হবে। সময় আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, বলো তো এরপর কি? আমি আমার দিকে তাকাই। হাতড়াই। কখগঘ থেকে সক্রেটিস ব্যাসদেব সার্ত্রে ডকিন্স হকিং সব আওড়াই। কিচ্ছু বুঝি না। যেই বুঝি মনে হয় অমনি আবার নতুন ধাক্কা। চেনা দেওয়াল, চেনা পাখা, চেনা মুখ, চেনা ভাষা অচেনা। আবার নতুন ডাটা। লোড করো। অপেক্ষা করো নেক্সট আপডেটের জন্য।
আমি তবু পালাতে চাই। নতুন হতে না। পালাতে চাই। নতুন হওয়া মানেই পুরোনোকে মনে রাখার একটা ব্যাপার থাকে কোথাও। আমি সম্পূর্ণ পালটে যেতে চাই। তারপর আবার বদলাতে চাই। আমি মৃত্যুকে না বলতে চাই।
চিন্তার প্রসব যন্ত্রণা এরা। আমি আমাকে ছাড়া কাউকে চিনি না। আমি আমাকে ছাড়া কারোর উপর জোর করতে পারি না। তাও এ শরীরটা না। আমি বলতে যা বুঝি তা এ শরীরটা না। যদিও বেদান্তের ভাষায় আত্মা পরমাত্মার গল্পে যাচ্ছি না। কারণ আমি অমরত্বে বিশ্বাস রাখি না। ঠিক বিশ্বাস না, আমি অমরত্বে ইচ্ছা রাখি না। কারণ আমি নতুন হতে চাই না। আমি অন্য হতে চাই। অমরত্ব মানে বোরিং কিছু। আমার শেষ অবলম্বন কারোর স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করা। তবু এসব মিথ্যা কথা।
রামকৃষ্ণদেব বলছেন আমাদের ‘দাস আমি’ হয়ে থাকতে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বড় আমি’ তে বাস করা। আমি জানি না, আমাদের সে ‘বড় আমি’, ‘দাস আমি’ কে পাব কোথায়? তাদের আমার মধ্যে কালচার করে তৈরি করতে হবে। কিন্তু কার দাস হব? কোন ঈশ্বরের? মাইল বদলালে ঈশ্বরের দাবী বদলে বদলে যায়। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, ‘মা ছেলের পেট অনুযায়ী ঝোল, অম্বল, ঝাল রাঁধেন।‘ আমার পেটে কি সহ্য হয় বুঝি কি করে? কেউ জানে না। আমিও জানি না। আপনিও না। জানে যারা দল বেঁধে নাম লেখায়। তারা চুষি কাঠি চোষে। চুষুক। আমি চুষব না। চুষি কাঠির লড়াইয়ে যাব না। এর চুষি কাঠির সাথে ওর চুষি কাঠির লড়াই। জানে না বলেই এত ঠোক্কর। এত গোলমাল। ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’। সেই আমিকে খোঁজা।
আমি আমাকে খোঁজা ছেড়ে দিয়েছি। আমি দেখছি আমায়। আমায় দেখা। আমায় বোঝা। আমায় ছেড়ে পালাতে চাওয়া। অন্য আমি হতে চাওয়া। “কি সুর বাজে আমার প্রাণে, আমি জানি মনই জানে”...
আমি কোকুন। আপনি কোকুন। গুটিয়েই যাচ্ছি, গুটিয়েই যাচ্ছি। এরপর প্রজাপতি হতে হবে। প্রজাপতি হয়ে যাবে। এ মানুষে সে মানুষ আছে। কই আছে? আছে আছে আছে...পালাতে চাইলেই আছে...