অস্তিত্ববাদের দুই পুরোধা – সার্ত্রে আর কাম্যু। ধরা যাক ওদিকে সার্ত্রের 'নসিয়া', 'বিইং অ্যাণ্ড নাথিংনেস'; আর এদিকে কাম্যুর 'দ্য মিথ অফ সিসিফাস', 'স্ট্রেঞ্জার' ও 'রিবেল'।
যখন এই অস্তিত্ববাদকে খুব কাছ থেকে দেখছি, তখন আদতে শেষে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি কি? সার্ত্রের শেষে কোথাও একটা ভাগ্যের কাছে নতিস্বীকার, চূড়ান্তভাবে মেনে নেওয়া। কাম্যুর 'দ্য মিথ অফ সিসিফাস'-এ লড়াই করার কথা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে, সমস্ত প্যাশন দিয়ে।
আমি জানি না এই দুইজন মানুষ জে কৃষ্ণমূর্তি পড়েছেন বা শুনেছেন কি না। জে কৃষ্ণমূর্তিকে পড়া বা শোনা বিচিত্র কিছু নয় কারণ এনারা প্রায় সমসাময়িক। কিন্তু মনে হয় না, কারণ এনাদের লেখায় তার সেরকম কোনো প্রতিফলন নেই।
তবু কাম্যু ও সার্ত্রের মধ্যে একটা ইউটোপিয়া আছে। সব দর্শনের শেষেই হয়ত তাই আছে। মানুষ তত্ত্বে যা বোঝে জীবনে তা অনুদিত করতে পারে কই? নইলে এ যাবৎ যত তত্ত্ব আলোচনা হয়েছে মানুষের গভীরে তার প্রভাব কতটুকু? গীতাতে যখন বলা হচ্ছে যে 'যখন যখনই ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয় তখন তখনই আমি আসি', তখন এই কথাটাও বুঝতে পারি যে, আমরা যত মহান তত্ত্বের দর্শনই পাই না কেন, আদতে তা হারিয়ে যাবে, আবার বর্বরতা নিষ্ঠুরতা পাশবিকতা আমাদের গ্রাস করবেই করবে।
কোনো মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত ভালো, চূড়ান্ত সত্যকে জানা সম্ভব নয়। তবু সে জানতে চাইবে এ-ও সত্য কথা। জীবনের একটা মানে সে খুঁজতে চাইবে। সমাজের নানা নিয়ম, ধর্মের নানা তত্ত্ব সে একটা সময় ছেড়ে দাঁড়াবে, একটা মানে খুঁজতে চাইবে। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে বলবে, এই সব পুরোনো খেলা আমি আর খেলব না, বড্ড অন্তঃসারশূন্য যেন, আমায় সত্যি সত্যি জীবনের একটা মানে খুঁজে বার করতে হবে। সত্যটাকে জানতে হবে।
একদম গোড়ার কথা দিয়ে শুরু করা যাক। প্রথম কথা, ঈশ্বর আছে? এর সোজা সহজ উত্তর হল, হ্যাঁ আছে। ঈশ্বরের সংজ্ঞা বদলাবে, ঈশ্বরের নীতি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা বদলাবে, কিন্তু ঈশ্বর বদলাবে না। কারণ ঈশ্বরের কতগুলো সমার্থক শব্দ আছে – রহস্যময়তা, উদারতা, শুভময়তা, আনন্দময়তা, সৃষ্টিময়তা, তন্ময়তা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই প্রতিটা শব্দের পিছনে “কেন” শব্দটা অর্থহীন। প্রতিটা শব্দ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেন রহস্যময়তা? উত্তর নেই, রহস্য আছে। কেন উদারতা? উত্তর নেই, উদারতা আছে। এইভাবে সবক'টা শব্দের কোনো “কেন” হয় না। মানুষ যেখানে এই ‘কেন’ শব্দ থেকে ত্রাণ পায় সেইখানে সে মুক্ত হয়। সে তখন যা আছে তাতেই মগ্ন হয়। আমার আশ্চর্য লাগে যখন দেখি সত্যান্বেষী দু'জন সাধক ভূখণ্ডের দুই প্রান্তে দুই সময়ে থেকে একই সত্যে এসে উপনীত হচ্ছেন।
বিবেকানন্দ যখন জিজ্ঞাসা করছেন পাওহারি বাবাকে যে, জীবনযাপনের মূলসূত্র কি? পাওহারী বাবা বলছেন, 'যন সাধন তন সিদ্ধি', অর্থাৎ যাই সাধন তাই সিদ্ধি। আর বহু আগে কান্ট তাঁর নৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন, End theory, অর্থাৎ প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য আর উপায় যেন এক হয়। কোনো মানুষ যেন কিছুর উপায় না হয় তোমার, সে নিজেই যেন উদ্দেশ্য হয়। শুধু মানুষ নয়, তিনি বলছেন এই হল বিশ্বের বিধান যে উদ্দেশ্য ও উপায়কে এক হতে হবে। আমি যদি গান গাইছি, সে গান গাওয়ার উদ্দেশ্য যখন শুধুমাত্র আমার গান গাওয়াই হবে তখন সেই গানের মাধ্যমে আমি মুক্ত। কিন্ত যদি হাততালি হয় তবে আমি ব্যর্থ। প্রতিটা কাজকেই যেন তাতেই সম্পূর্ণ দেখি। মহাত্মা বলছেন যে উদ্দেশ্যের চাইতে উপায় আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোনো সৎ উদ্দেশ্যে যেন অসৎ উপায় না নিই। এ মত রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেকেরই, যা উদ্দেশ্য তাই যেন উপায় হয়।
জে কৃষ্ণমূর্তির শিক্ষায় যখন 'Observer' আর 'Observed' এক হয়ে যায় তখন সত্য নিজেকে প্রকাশ করে। তার প্রধান কথা হচ্ছে সমগ্র মনের এক কেন্দ্রে আসা, যা একাগ্রতা বললে ভুল হয়, যা হল বুদ্ধের ভাষায় Mindfulness, সাধারণ কথায় ঐকান্তিক মনযোগের অবস্থা। আমি যখন খুব attentive কোনো বিষয়ে তখন সেই মুহূর্তে আমার সমগ্র সত্তার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমি চূড়ান্ত সুখের, আনন্দের অনুভব তখন আপনিই পাই।
তবে কোন ঈশ্বর বাদ যাচ্ছে? ব্যক্তি ঈশ্বর। যে ঈশ্বর আবেগপ্রবণ। যে ঈশ্বর নানা ইন্দ্রিয়াভাসে আমাদের সামনে নানা রূপে বারবার উদ্ভাসিত। সে ঈশ্বর বাদ যাচ্ছে। থেকে যাচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক সত্তা – যা আনন্দ, যা রহস্য, যা শুভ, যা উদার। এই অনুভবগুলোকেই নাস্তিক ও আস্তিক নানা মতে নানা আচ্ছাদনে সমাজে কায়েম করতে চাইছে যুগযুগ ধরে। সবাই চাইছে মানুষ তথা সমাজ উদার হোক, সুখী হোক, নীরোগ হোক, শুভময় হোক। বিষাদকে নিয়ে নাড়াঘাঁটা এক বিলাস। সে নিয়ে বহু সাহিত্য দর্শন কাব্য হয়েছে, কিন্তু ধোপে টেকেনি।
তার কারণ মানুষের জীবনের মূল কথা নিজের মধ্যে সংহতি স্থাপন। যে নিজের মধ্যে রাসেলের ভাষায় বিলিয়ার্ড বোর্ডের মত এ গুলি সে গুলি'র ধাক্কায় জর্জরিত হয়ে আছে সে কি করে বিষাদমুক্ত হবে? সে তো থেকে থেকে, দিনে দিনে, মাসে মাসে নিজেকে নিয়ে নাজেহাল হয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রধান ও প্রথম কথা হল নিজের মধ্যে সেই সংহতি স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি জিজ্ঞাসা করি কি করে? তবে সপাটে উত্তর আসবে অ্যারিস্টটল থেকে জে কৃষ্ণমূর্তির – সংহতি স্থাপনের মধ্যে দিয়েই। যেমন বাড়ি বানাতে বানাতে মানুষ স্থপতিকার হয়, যেমন রেওয়াজ করতে করতে মানুষ গাইয়ে হয়, এও তেমন।
আসলে প্রাচ্যের পক্ষে নাস্তিক হওয়ার জো নেই। কারণ বুদ্ধ সে পথ অনেক আগেই হেঁটেছেন। সাংখ্য অনেক আগে সে ব্যাখ্যা করেছে। আত্মা, জন্মান্তর ইত্যাদি না মানলেও বাকি যা পড়ে থাকে সেই আসল। সে কোনো মেটাফিজিক্সের কথা নয়, সে আদতে নিজের মধ্যে এই সামঞ্জস্য গড়ে তোলার কথা। পাশ্চাত্যে ধর্মের বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হয়েছে সে প্রধানত খ্রীষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠিত ভাব-আচার-শিক্ষাকে কেন্দ্র করে। আমাদের তো সে দায় নেই। এত বিচিত্র দর্শন, এত উদার ঈশ্বরের চর্চা তো আর কোনো ভূখণ্ডে হয়নি। তাই আমাদের নাস্তিকতা যখন ওদের অনুকরণে কোনো বিশেষ একটা মতের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া হয় তখন আমার হাসি পায়। মনে হয় এখানে অনুকরণের ঝাঁঝটা যত তীব্র সত্যকে আলিঙ্গন করার আন্তরিকতাটা তত খাঁটি নয়।
ক'দিন আগে কথা হচ্ছিল আমাদের বন্ধু মহলে, সেই কথাটা দিয়েই শেষ করি। আস্তিকবাদের সমস্ত দর্শন শুরু হচ্ছে একটা কথা দিয়ে – ঈশ্বর আছে। আর বুদ্ধের সমস্ত দর্শন শুরু হচ্ছে একটাই কথা দিয়ে – দুঃখ আছে।
জীবন বলল, দুই সত্য। ঈশ্বর আর দুঃখ একই কথা। কি করে? আমি যে দার্শনিককে হয়ত প্রাণের শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছি, সেই স্পিনোজার কথা দিয়েই শেষ করি। তিনি বলছেন, ঈশ্বর অনন্ত সত্তারই আরেক নাম। তোমার সান্ত সত্তা যখন সেই অনন্ত সত্তার দিকে তাকাচ্ছে, সে অনন্তকে অনুভব করতে চাইছে জ্ঞানে, প্রেমে, সে তখন দুঃখ বৈকি। তবে সে দুঃখ দুর্বলের জন্য নয়। উপনিষদ বলছেন, 'নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য।' অনন্তকে অনুভব দুর্বলের সাধ্য নয়। তবে উপায়? সেই সংহতি স্থাপন নিজের মধ্যে। তবেই সেই পরম উদারতা, পরম শুভময়তা, পরম শান্তি আমায় ঘিরে নেবে, আমায় সার্থক করবে।
যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে
মিলাব তাই জীবনগানে ॥
গগনে তব বিমল নীল-- হৃদয়ে লব তাহারি মিল,
শান্তিময়ী গভীর বাণী নীরব প্রাণে ॥
বাজায় উষা নিশীথকুলে যে গীতভাষা
সে ধ্বনি নিয়ে জাগিবে মোর নবীন আশা।
ফুলের মতো সহজ সুরে প্রভাতে মম উঠিবে পূরে,
সন্ধ্যা মম সে সুরে যেন মরিতে জানে ॥