হিন্দীভাষা নিয়ে আমাদের একটা ছুঁচিবাই আছে। আমরা হিন্দী গান শুনব, হিন্দী সিনেমা দেখব। কিন্তু হিন্দী ভাষাটা লিখতে বা পড়তে শিখব না। দক্ষিণ ভারতে এ গোঁড়ামি আরো ভীষণ। হিন্দী আমাদের জাতীয় ভাষা – এ কথাটা ভুল। জাতীয় ভাষা আমাদের সবক’টাই। মানে বাইশটা ভারতীয় ভাষাই জাতীয় ভাষা। সেখানে হিন্দী আর ইংরাজী আমাদের কাজের ভাষা, বা official language.
কেন এই প্রসঙ্গের অবতারণা হল সেটা আগে বলি, না হলে বুঝতে অসুবিধা হবে। আমি জানি আমার এ লেখাটার কোনো মূল্য নেই। এতে কিছুই হবে না। আমার এই লেখাটাই সার হবে। আর আপনারা যাঁরা কষ্ট করে পড়বেন তাঁদের কিছুটা সময় অপচয় হবে মাত্র। আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আর সাথে সাথে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখছি আমায় এই সময়টা দেওয়ার জন্য।
আমার আত্মীয়পরিজন সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে ভারতের বহু জায়গায় বেড়াবার দরুন স্বদেশের সাথে খুব নিবিড় একটা সম্পর্ক অনেকদিন ধরে রক্তে বয়ে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলছেন, “… দেশ কেবল মৃণ্ময় পদার্থ নয়, তা চিন্ময়ও বটে। তা যে কেবল বিশ্বপ্রকৃতিতে আছে তা নয়, তার চেয়ে সত্যরূপে আমাদের চিৎলোকে আছে। মনে রাখতে হবে যে অনেক পশুপক্ষীও বাংলার মাটিতে জন্মেছে। অথচ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হৃদয়ের মধ্যে বাঙালীর সঙ্গে একাত্মিকতার বোধ আত্মীয়তার রসযুক্ত নয় বলেই বাঙালীকে ভক্ষণ করতে তার যেমন আনন্দ…”। বাঙালী হতে গেলে তার মাটি-জল-আবহাওয়ার মত তার জীবনযাত্রা, জীবনদর্শন ইত্যাদিও তার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হওয়ার দরকার। এ কথা অবশ্যই মানি। সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কথাটা বলা। সেই অর্থে ভারতবর্ষ বহুদিন রক্তে ঢুকে এসেছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সাহিত্য হিন্দী আর ইংরাজী ভাষার মাধ্যমে মস্তিষ্কে বাসা তৈরি করেছে। এখানে বলে রাখি, এর অর্থে আমি গেরুয়াকরণের ভারতবর্ষ বোঝাতে চাইছি না কোনো অর্থেই। আবার খুব নম্র হয়ে এটাও উল্লেখ করতে চাই, সত্যজিত রায়ের সিনেমাও কেমন যেন একটা অন্য ভারতের গল্প মনে হয় আমার। সিনেমা হিসাবে তা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের সে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সব চরিত্ররাই যেন কিরকম অন্যভাবে কথা বলছেন, অন্যরকম চলাফেরা করছেন, আবেগগুলোও যেন অপরিচিত। ওনার শিল্পীসত্তার বিরুদ্ধে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমি রাখি না। সে অত্যন্ত উন্নতমানের। কিন্তু আমার কাছে যেন ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহা, তরুন মজুমদার, কি আরো পিছিয়ে গেলে দেবকী বসু ইত্যাদিদের সিনেমায় অনেক কাছাকাছি পরিচিত বাঙালী তথা ভারতীয়দের দেখেছি। এদের সিনেমার চরিত্রদের অভিব্যক্তিগুলো যেন আমার ঘরের লোকের মত। ওনার সিনেমায় আমি সেটা খুঁজে পাই না। হতে পারে আমার বোধের ধারা খুব স্থূল তাই। খারাপ লাগলে ক্ষমা করবেন। কারণ এ নিয়ে তর্ক হয় না। এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশ্ন।
হিন্দী ভাষা প্রসঙ্গে আসি। একটা হলঘরে কিছু গণ্যমান্য লোকেদের মাঝে বক্তব্য রাখছেন ভূতপূর্ব স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী মহাশয়। ইংরাজীতেই বলছেন। হঠাৎ বলতে বলতে থেমে গেলেন, তারপর ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে বলতে শুরু করলেন। সবাই অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাতাকি করছেন। খানিক বাদে কারণটা সবার গোচরে এল। একজন পরিচারক, শ্রোতাদের চা দিতে এসেছিলেন, ফিরে যাওয়ার সময় তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মহারাজের দিকে তাকিয়ে ওনার বক্তব্য শুনতে চেষ্টা করছিলেন। এই মহাপ্রাণের চোখ তা এড়িয়ে যায়নি। তিনি তাড়াতাড়ি তাঁর বক্তব্য হিন্দীতে বলতে শুরু করেন, কারণ এই ভাষাটা বলতে না পারলেও আজ সিনেমা ইত্যাদির দৌলতে অনেকেই বুঝতে পারেন। আমি এটাই বলতে চাইছিলাম।
একটা দেশে শুধুমাত্র একটা বিদেশি ভাষাকে নিয়ে একটা বিভেদরেখা তৈরি হয়ে আছে এটা ভাবতে, দেখতে বড় লজ্জা লাগে। অর্থনৈতিক অসাম্যতা, উপার্জনের অসাম্যতা ইত্যাদি তো আছেই। সে পার্থক্যটার থেকে মর্মান্তিক লাগে যখন দেখি একজন মানুষ তার সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ইংরাজী আয়ত্ত করতে পারেননি বলে হীনমন্যতায় ভুগছেন। একজন মানুষের সামনে তার অবোধ্য ভাষায় কথা বলাটা অপমানজনক। শুনেছিলাম দক্ষিণ ভারতে এই প্রভেদ ভীষণ ছিল। এখন আর ততটা না। ভেলোরে ডাক্তারেরা, চেন্নাইয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেখেছি হিন্দী বলতে সংকোচ করেন না। কথাটা সেখানেই। ইংরাজী শিখতেই হবে রুজিরোজগারের জন্য, আমাদের দৈনন্দিন কথাতেও ইংরাজী শব্দের ব্যবহার হতেই পারে, তাতে দোষের তো কিছু নেই। সেটাই স্বাভাবিক। ওভাবে একটা ভাষার গতিপথ স্থির করা যায় না। ভাষা একটা সজীব বস্তু। কিন্তু হিন্দী ভাষাটাকে যদি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ আরো ভালোবেসে কাছে টেনে নিতেন, আমার মনে হয় নিজের উপর আমাদের আস্থা আরো বাড়ত বই কমত না।
আমি বিজ্ঞান পড়াই। সব পরিভাষাগুলো (Term) সেখানে ইংরাজীতে ব্যবহার করতে আমার ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করি। কারণ উচ্চামাধ্যমিকের পরে আর তো মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ নেই। সে তো অথৈ জলে পড়বে তখন। সেই অথৈ জলে পড়ার অভিজ্ঞতাও বহু ছাত্রছাত্রীর হয়ে থাকে।
আচ্ছা যদি এমন হত, সব উচ্চশিক্ষা হিন্দীতে পড়ানোর পরিকাঠামো তৈরি হত। সে চিকিৎসাবিদ্যা হোক, কি প্রযুক্তিবিদ্যা। মনে হয় ভারতের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে ব্যাপারটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারত। একবার ক্লাসে আমায় একজন ছাত্র বলল, অমুকের আপনার পড়ানো বুঝতে অসুবিধা হয়। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? সে বলল, কারণ আপনি ইংরাজীতে বলেন বেশি বলে। আমার গালে একটা চড়ের মত লেগেছিল। কারণ যে ছাত্রটিকে নিয়ে আলোচনা তার বাবা রিক্সা চালান। স্বভাবতই সে খুব পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে আসছে। আমার অসহায় লেগেছিল একদিকে আমার উচ্চশিক্ষায় তাকে ইংরাজীতে সড়গড় করে তোলার দায়বদ্ধতা এবং অন্যদিকে তার সামাজিক, শিক্ষাগত অবস্থানের বাস্তব চিত্র। তখন আমার মনে হয়েছিল ২২টা ভাষায় হয়তো পৃথক পৃথকভাবে উচ্চশিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও কঠিন। কিন্তু যদি ইংরাজীর জায়গায় এটা হিন্দী হত, তবে তো সে আর আমি শুধুমাত্র ভাষার ব্যবধানে এতটা দূরত্বে দাড়াতাম না। তার নিজের দেশে নিজেকে এত প্রবাসী লাগত না। আমার বাড়িতে আসা যে বাউল, সে গর্বের সঙ্গে বলে, ‘আমি সারা দেশ ঘুরে বেড়াই জানো, তুমিও ঘুরতি পারো যদি হিন্দী কথা কইতে পারো। আমি পারি।’ তার সেই গর্ব আমাকেও স্পর্শ করেছিল। মনে হয়েছিল আসমুদ্র হিমাচলের একজন দেহাতী মানুষের সাথে তার হাসিকান্নার ভাষায় সামিল হতে আমার যেন কোন বাধা রইল নয়া। তাই বলছিলাম একটা দেশের ভিন্ন প্রদেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে একটা ভাষাতেই কথা বলতে পারতেন। একটা ভাষাতেই গরীব ধনী নিজেদের মনের ভাষা লিখতে বলতে পারতেন। যোগাযোগটা আরো নিবিড় হত। কারণ তামিল, তেলেগু, মালায়ালম, কন্নড় ইত্যাদি ভাষার থেকে হিন্দী যতই আলাদা হোক না কেন, অন্তত ইংরাজীর চাইতে তো কাছাকাছি বটেই। সে একই মাটির গুণেই হোক, আর যেকোনো যোগসূত্রের জন্যই হোক। আবেগ এক, বৃহদাংশের ধর্মবিশ্বাস এক, ইতিহাস এক, তবে ভাষায় একটা একত্ব আসলে কি ক্ষতি ছিল? আজ সাহিত্য একাডেমীতে যখন ভারতের নানান ভাষার গল্পের অনুবাদ পড়তে পাই বেশির ভাগই হিন্দীতে, তখন মনে হয় ইংরাজীর চাইতে অনেক বেশি আমার কাছের। আমার বাড়িতে ঝাঁট দিতে দিতে যখন আমাদের কাজের মাসি টিভির দিকে তাকান, তখন যদি বাংলা বা হিন্দী কোনো অনুষ্ঠান হতে থাকে আমার লজ্জা লাগে না, কিন্তু যদি ইংরাজী কিছু হয় আমি চ্যানেল ঘুরিয়ে দিই।
সব শেষে আবার বলি, আমি ইংরাজী শিক্ষার বিরোধিতা করছি না, আমার আপত্তি ইংরাজী নির্ভরতার স্বদেশেই। সেই স্থলে হিন্দী অভিষিক্ত হোক। তবে যারা হিন্দী বলে তারা বেশি সুবিধা পাবে না? পাবে তো, কিন্তু সেই যুক্তিতে তো আমরা ইংরাজী পড়া থেকে বিরত হই না, কারণ পৃথিবীর বহুদেশ তো সেই ভাষাতেই কথা বলে থাকে। সেখানে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছি না। তবে এখানেই বা পিছোবো কেন? বরং যে ভারতবর্ষটা ইণ্ডিয়ার বহু পিছনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, হীনমন্যতায় ভুগছে, তার হাতটা ধরে তাকে তুলে নিয়ে আসি। এক আসনে বসি। ভাষাটা হৃদয়ের বাহ্য প্রকাশ। সেই প্রকাশে কথা প্রকাশিত হয়। স্টেশানে নেমে কুলির সাথে যে ভাষায় কথা বলছি, যেন সেই প্রদেশের উচ্চ আধিকারিকের সাথেও সেই ভাষাতেই কথা বলি। কেউ যেন হাঁ করে আমার বা আর কারোর মুখের দিকে তাকিয়ে না থাকে। কারণ একটা বিদেশী মাটিতে জন্মানো ভাষা তার স্বদেশের মানুষটা আর তার মধ্যে প্রাচীর তুলেছে বলে।
কোনোদিন হবে না জানি। তবু বলতে পেরে মনটা হাল্কা লাগছে। তর্ক চাই না। সহমত হলে খুশী হব, অমত হলে অবাক হব না।