Skip to main content

 

 

আজ ঠাকুরের জন্মতিথি। রামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি। আমি ঠাকুরকে নিয়ে কি লিখব? ঠাকুরকে নিয়ে লেখার যোগ্যতা কই আমার? অভিমানের পাহাড় যে সামনে। বিদ্যা বিনয় দেয়। কিন্তু সে কোন বিদ্যা? আদৌ কি বিনয় আছে? আদৌ কি নম্রতা আছে? নীচু জমিতেই জল জমে, ঠাকুর বলেন। জমি নীচু কি গো, হাজার একটা অভিমানে সে পাহাড়। যে মানুষটা বলে, আমি তোমার লোমের একগাছিও নই, সে মানুষের সম্বন্ধে পাণ্ডিত্য ফলিয়ে লাভ কি? রামকৃষ্ণদেব একটা অনুভব। সেকি তত্ত্ব? সে অনুভব ধারণ করব যে আমি কি প্রস্তুত করেছি নিজেকে? করিনি। হাজার একটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অহংকারে আলাদা আলাদা খোপ বানিয়েছি হৃদয়ে। সেখানে মানের ফাঁদ পেতে বসে আছি। মান সম্মান চাই। খ্যাতি চাই। ধন চাই। আরো কত কি কি চাই। এ হৃদয়ে রামকৃষ্ণ চন্দ্র উঠবে? তৃণাদপি সুনীচেনতরোরপি সহিষ্ণুনাতৃণের থেকে দীন, গাছের থেকে সহনশীল? হয়েছি? হইনি। নিজেকে যোগ্য করিনি। সে মানুষের মুখ জুতো দিয়ে মাড়িয়ে গেল খাঞ্জাঞ্চি। সে চুপ করে সহ্য করল। সে নিজের মাথার চুল দিয়ে পায়খানা পরিষ্কার করে এলো অভিমান যাওয়ার জন্য, সমাজে যাকে নীচুজাত বলেছিল সেদিন, তার বাড়ি গিয়ে। গিরিশ হাত ধরে তুলে দিল। কখন? যখন মানুষটা খেতে বসেছে তখন। সদ্য দুটো লুচি মুখে দিয়েছে কি দেয়নি তখন। গিরিশ মাতাল তখন। ঠাকুরের সঙ্গে কথায় মিল হল না। হাত ধরে দিল তুলে। ঠাকুরের সাঙ্গপাঙ্গরা গেল রেগে। অপমান! ঠাকুরকে!

পরের দিন সকাল। ঠাকুরের ঘরে আলোচনা হচ্ছে। গিরিশকে শিক্ষা দিতে হবে। এমন মানুষকে অপমান! যাকে নিয়ে এত ক্ষোভ, এত উষ্মা, এত আলোচনা, সে চুপ। সবার কথা শুনছে। নিজে কিছু বলছে না। একবার অস্ফুটে বলেছে, কিন্তু মা যে বলেছেন অপমান হয় না!

হয় না তো। কিন্তু সে চেতনার আলো কই আমাদের? রাম এসে দাঁড়ালো। ঠাকুরের ভক্ত। ঠাকুর বললেন, বলো তো রাম, এরা যা বলছে তা কি ঠিক!

রাম হাসল। ঠাকুরের মন বুঝল। ঠাকুরের মন! সে তো হাতে নেওয়া যায় না, সে তো কোনো রঙে রাঙে না! সে মনে আবার অপমান! রাম বলল, কালিয়া যখন বিষ ঢালছিল কৃষ্ণের পায়ে, কালিয়াদমনের সময়, কালিয়াকে কৃষ্ণ বলেছিলেন, কালিয়া আমায় মানুষ কত ননী মাখন দেয়, তুমি বিষ দিচ্ছ? কালিয়া বলেছিল, প্রভু আপনি যা দিয়েছেন তাই তো দেব, অমৃত দিলে অমৃত দিতাম।

ঠাকুর হাসলেন। মনের কথা তো এই। চলো গিরিশের বাড়ি। এখনই চলো।

ওদিকে গিরিশের কি অবস্থা? নেশা ছুটে গেছে মাঝরাতে! কি করলাম আমি! যাকে জলজ্যান্ত ভগবান দেখি! ধুর ভগবান তো তুচ্ছ কথা, যাকে প্রাণের সব মাধুর্য দিয়ে বসে আছি, যে আমার প্রাণকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে, যে আমার সমস্ত সত্তার মালিক, তাকে না খেতে দিয়ে তাড়িয়েছি! গিরিশ সারারাত পায়চারি করছেন!

সকাল হচ্ছে। গিরিশ সকালের আলোয় যেন মুখ দেখাতে পারছেন না। রাতের অন্ধকারে যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, দিনের আলোয় তাই লজ্জা, চরম লজ্জা! ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে গিরিশ ভাবছেন, তবে এ জীবন রেখে লাভ কি! অমন সোনার মানুষকে অভুক্ত তাড়িয়ে দিয়ে বেঁচে থেকে লাভ কি! এ প্রাণ গঙ্গায় যাক।

এমন সময় দরজায় টোকা। "গিরিশ আমি এয়েচি, দরজা খোলো"।

গিরিশ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার রুদ্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিশ্বেশ্বর! হায় হায়, এত করুণা! গিরিশ দরজা খুলে পায় পড়ল। বলল, আজ যদি তুমি না আসতে তবে জানতুম তুমি অনেক বড় সাধক হতে পারো কিন্তু তুমি ভগবান নও!

ঠাকুর হাসলেন।

অহং তো কালিয়া। তার হাজার মাথা। একটা কাটলে আরেকটা জন্মায়। সারা শরীর জুড়ে বিষ। যেদিকে তাকায় সব বিষাক্ত দেখে। তাকে দমন করবে কে? যে নিজে অহং শূন্য। আমি শূন্য।

পাণ্ডিত্যের অভিমান, ধনমানের অভিমান, সাফল্যের অভিমান, সাধনার অভিমান, দীক্ষার অভিমান, মন্ত্রের অভিমানএর কি শেষ আছে ঠাকুর! শেষ নেই। একের জাল ছাড়াই তো আরেক এসে ধরে। জানি কোথায় বাধছে। তবু ছাড়া যায় না। ওই যে, গানে আছে না? "যাহা রেখেছি তাহে কী সুখ, তাহে কেঁদে মরি, তাহে ভেবে মরি".... আরো আছে, "তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা, ফেলিয়া দিতে পারি না যে".... আরো আছে, "আমি জেনেশুনে তবু ভুলে আছি"।

যে বিদ্যায় নম্রতা আসে সে স্কুলে পড়িনি যে ঠাকুর। তাই তোমার পাঠশালায় এসেছি। এই পাঠশালাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষিণেশ্বরের ছোটো একটু ঘর। অনেক লোক। বাইরে বসি। গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া লাগুক গায়ে এসে। তোমার কথা ভেসে আসুক যুগান্তরের পার থেকে। মনের মধ্যে কালিয়ানাগকে পুষেছি দীর্ঘদিন হল। অভ্যাস হয়ে গেছে বিষাক্ত বাষ্পে শ্বাস নেওয়া। ছোবল মারা। ছোবলের আতঙ্কে বাস করা। তুমি তাকাও। তোমার কটাক্ষে আমি পুড়ি। আমি ছাই হই। আমি শূন্য হই। আমার সব যাক। তুমি ছুঁলে আমি চুম্বক। নইলে লোহা। তুমি ছুঁলে আমি বিষহীন কালিয়া, নইলে আমি বিষাক্ত। সংসার মান কেড়ে নিয়ে অপমান দেয়। তুমি মান হরে প্রেম দাও। আমি মনে মনে গাই, তুমি শোনো।

পিপাসা হায় নাহি মিটিল, নাহি মিটিল

   গরলরসপানে জরজরপরানে

       মিনতি করি হে করজোড়ে,

জুড়াও সংসারদাহ তব প্রেমের অমৃতে ॥