ধর্ম রচনা করা যায় না। ধর্ম রচিত হয়। মানুষকে বেঁধে রাখার জন্য ধর্ম লাগে না। মানুষ বোধের স্বচ্ছতায় এসে পৌঁছালে নিজে থেকেই সবার সঙ্গে ধরা পড়ে। একসূত্রে। তাই কোনো আলোকিত, উদারচেতা মানুষ হিংসার কথা বলেননি আজ অবধি, এবং এও সত্য, কোনো বাণী, বা কোনো পবিত্র বই, বা কোনো পবিত্র মানুষ নির্ভরও নয় ধর্ম। ধর্ম স্ব-প্রকাশ। স্বচ্ছ বোধের কাছে একমাত্র।
'স্বচ্ছতা' আর 'স্পষ্টতা'র মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। আমি কিভাবে একটা জাতকে ধ্বংস করে দেব প্রতিষ্ঠিত কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ বিশ্বাসের জন্য, যাকে প্রচলিত ভাষায় ধর্ম বলে, সে বিষয়ে আমার স্পষ্ট ধারণা থাকতে পারে। কিন্তু তা আমার স্বচ্ছ চেতনার মাপকাঠি নয়। অথচ ইংরেজিতে দুটো শব্দেরই অর্থ, 'ক্ল্যারিটি'।
মানুষের মধ্যে সেই বড় আমি'টাই স্বচ্ছতা। তার ছোটো আমি'টা সমস্যা। ছোটো আমি যখন বড় আমি'কে কল্পনা করে, তখন সে ভাবে তার দশটা হাত, তার অমানুষিক শক্তি। সে তখন ‘বিগ ব্রাদার’ সিন্ড্রোমের শিকার। তার একজন বড়দা আছে। যাকে তুষ্ট করে চললেই জগত তুষ্ট হয়। তখন সেই ছোটো আমি যাতে সে নিজে তুষ্ট, তারই পরিমাণ বড় করে, তার কল্পনার বড় আমি'কে তুষ্ট করতে যায়। তাই তার সব কিছুই আড়ম্বরপূর্ণ। সরল, সহজ কিছু নেই।
কিন্তু যদি কোনোদিন, কোনো শুভপ্রেরণার বশে সে নিজের ক্ষুদ্রত্ব সেই বড় আমি'র পায়ে সমর্পণ করতে চায়, তখনই সে অনুভব করে স্বচ্ছতা কাকে বলে। অভয় কাকে বলে। ভালোবাসা কাকে বলে। কারণ সে সব দিক থেকে স্বার্থবুদ্ধিরহিত তখন। একি একেবারে সম্ভব? নয়, কিন্তু যতটা পারি, ততটাতেই আমার লাভ। “তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে” কান্নাও তাই সত্য সেখানে।
আজ ইতিহাস বিজ্ঞানের দরজায় এসে নিজেকে আরো প্রসারিত করেছে। আমি বিজ্ঞান অর্থে বিজ্ঞানই বলছি। যদি পদার্থ বিজ্ঞান অর্থে কেউ বলে যা দিয়ে পারমাণবিক বোম বানানো যায়, কিম্বা কম্পিউটার সায়েন্স মানে যা দিয়ে ডিপফেক বানানো যায়, সে বিজ্ঞান নয়।
ইতিহাসের অন্বেষণ বিজ্ঞানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষ নিজের উৎস খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে পৃথিবীতে সব মানুষই আদতে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে আফ্রিকা থেকে বেরোনো মানুষেরই বংশধর। সবারই উৎস এক। তার ওয়াই ক্রোমোজম আর মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্রোমোজম সেই সাক্ষ্যই বহন করছে।
কিন্তু এই জ্ঞান কি আমাদের হিংসা, দ্বেষ কমাতে বিন্দুমাত্র সাহায্য করেছে? আজও আমার জাত, আমার ধর্ম, আমার শিল্প-সাহিত্য তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার লড়াই চলছে। চলবেও। এর কারণ আমাদের মধ্যে সেই আদিকাল থেকেই একটা ছোটো আমি আছে। আগে লোহায় মরচে পড়ত না, আজকাল পড়ে বলা যেমন অজ্ঞতা, ঠিক তেমন আগে মানুষ সব সভ্য ছিল, আজকাল সব বর্বর হয়েছে বলাও ঠিক তেমন।
মানুষের ক্রোমোজমের মধ্যে নিহিত যে একত্বের সূত্র, তার থেকেও গভীরের সূত্র তাই মানুষের আত্মায় নিহিত একত্রের সূত্র। আত্মা অর্থে কোনো বস্তু না। আত্মা এই চিত্তের স্বচ্ছতা। তাই তাকে আগুন দহন করতে পারে না। অস্ত্র আঘাত করতে পারে না। জল সিক্ত করতে পারে না। কিন্তু লোভ-ক্রোধ তাকে ঢেকে ফেলতে পারে। বিদ্বেষের উন্মাদনা কালবৈশাখীর মেঘ যেমন নির্মল নীল আকাশকে ঢেকে দেয়, তেমন ঢেকে দিতে পারে।
এ স্বচ্ছতাতে উপনীত হতে গেলে কি সাধনা করতে হয়? প্রশ্নটাই ভুল। তাই এর সব উত্তরগুলোও ভুল। স্বচ্ছতাতে উপনীত হওয়া যায় না। নিজের মধ্যের মলিনতা গেলেই সে আপনি নিজেকে প্রকাশ করে। মরমী কবি বলেন চোখের জলে সে আসে। অবশ্যই সত্য। আজ যে যুদ্ধের পৈশাচিকলীলা দেখছি, তা দেখে যাদের চোখে জল আসার কথা আসছে না বলেই এ থামছে না। নইলে যুদ্ধ থামার কত তত্ত্ব, যুদ্ধ চলার কত কারণ পাতার পাতা লেখা হচ্ছে, বই ছাপা হচ্ছে, তার মার্কেটিং চলছে, পুরষ্কার দেওয়া নেওয়া চলছে। কত শক্তিশালী ছোটো আমি'র বোধ ভারতের মাটিতেই বিয়ের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে উল্লাসে মাতছে, যেখানে কয়েক কিলোমিটার দূরে শিশুর রক্তে ভিজে আছে মাটি। হা ঈশ্বর! এতটাই নির্লজ্জ আমরা। আর আমাদের শিক্ষা-সভ্যতার গর্ব।
বড় আমি'তে থিতু হওয়া মানে সমাধিতে যাওয়া না, অতীন্দ্রিয় অনুভবের মাদকতায় ডুবে যাওয়া নয়, নানা অলৌকিক দর্শন আর ক্ষমতার ভুলভুলাইয়ায় হারিয়ে যাওয়া নয়। বড় আমি'তে থিতু হওয়ার অর্থ অন্যের যন্ত্রণা নিজের যন্ত্রণায় অনুদিত হওয়া। তারপর তার প্রতিকারের জন্য সরব হওয়া। এটাই ধর্মের অন্তিম স্টেশান। আত্মলাভ। আত্মসাক্ষাৎকার। সেই স্বচ্ছতায় স্থিতিলাভ করা।
অ্যানার্কিজম একটা বড় কথা। যাকে অনেকভাবে ব্যবহার করা যায়। যার একটা বড় অর্থ, সমাজের এই নানা ভ্রষ্ট অথোরিটি থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস। সত্যজিৎ তার শেষ তিনটে সিনেমায় যা বলতে চেয়েছিলেন। ওই তিনটে সিনেমা আমার কাছে ততটা সিনেমা না যতটা এক দার্শনিক অন্বেষণ। গণশত্রুতে ধর্ম আর তাকে ঘিরে রাজনীতির অথোরিটি। শাখা প্রশাখাতে সমাজের বড় বড় মাথাদের অথোরিটি। আর সব চাইতে চূড়ান্ত তর্ক হল, আগন্তুক, যেখানে আধুনিক সমাজের এক কপট নিরীহতার মুখোশের অথোরিটির বিরোধ। যেখানে শেষ দৃশ্যে আদিবাসীদের কাছে ফিরে দাঁড়াচ্ছে আধুনিক সমাজ। নব্বই সালে একটা দার্শনিক তর্ককে ঘিরে সিনেমা হচ্ছে, হয় তো ভাবা যায় না!
ডেভিড গ্রেবিয়ার আর ডেভিড ওয়েংরোর আলোড়ন জাগানো লেখা, ‘দ্য ডন অব এভরিথিং’ যে অ্যানার্কিজম-এর কথা বলে, নোম চোমস্কি যে অ্যানার্কিজম এর কথা বলে, সে ধ্বংসলীলায় মেতে সব লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া না। বরং নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে যা মিথ্যা, যা তথ্য আর পরিসংখ্যানের চাতুরী তার মুখোশ খুলে ফেলা। সত্যজিৎ রায় অনেকটা এই ধরণের ইঙ্গিতই দিচ্ছেন, কি হবে না দাদুভাই? কূপমণ্ডূক। যত এক্সপ্লয়েটিভ অথোরিটেটিভ অ্যাটিচিউড, তাই এক কূপমন্ডুকতাতেই জন্মায়। কারণ কুয়োর মধ্যে এক তামসি নিশ্চিন্ততা আছে, আশ্বাস আছে। কিন্তু স্বচ্ছতা নেই। স্পষ্টতা আছে। আবারও মনে করিয়ে দিই, দুটোর অর্থই ইংরাজিতে 'ক্ল্যারিটি'। অনেক সময়েই স্পষ্টতা দিয়ে স্বচ্ছতাকে ঢেকে দেওয়া হয়। যেমন বর্তমানের এক পণ্ডিত ব্যক্তি স্টিভেন পিঙ্কার স্ট্যাটেস্টিকস-এর স্পষ্টতা দিয়ে বর্তমান যুগকে সুখের স্বর্গ প্রমাণ করে, যাবতীয় বাকি যা কিছুকে ঢেকে দিয়েছেন।
আমাদের ওয়াই ক্রোমোজমে পিতৃপক্ষের একত্বের সূত্র থাক, আমাদের মাইটোকন্ড্রিয়ায় মাতৃপক্ষের একত্বের সূত্র থাক, কিন্তু বোধের স্বচ্ছতায় না এলে সব অর্থহীন।
আফ্রিকাগত সেই মানবগোষ্ঠীর এক অংশ এই ভারতের মাটিতে একদিন অনুভব করেছিলেন এই সত্যকে। বলেছিলেন,
অয়ং নিজঃ পর বেত্তি গননা লঘুচেতসাম।
উদারচরিতাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম।।
ক্ষুদ্রচিত্তের কাছে 'আমি' আর 'তুমি'র ভেদ। কিন্তু উদার চিত্তের কাছে গোটা বিশ্বই এক আত্মীয়তার সুতোয় বাঁধা।
এর পরের শ্লোকের উপদেশ, সব সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মের মধ্যে পরম স্বাধীনতায় থিতু হও।
ব্রহ্ম অবশ্যই কোনো অতীন্দ্রিয় শব্দ নয় এখানে, একটা বোধের নির্দেশ, যা নিজেকে সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত করলেই পাওয়া যায়।
(ছবি: আন্তর্জালতন্ত্র)