Skip to main content
 
 
 
 
আজ অবধি যতপ্রকার ত্রুটি নিয়েই মানুষ জন্মাক না কেন, মন ছাড়া জন্মেছে, এমন উদাহরণ নেই। রবি ঠাকুর গাইছেন, মন রে ওরে মন/ তুমি কোন্ সাধনার ধন / পাই নে তোমায় পাই নে/ শুধু খুঁজি সারাক্ষণ।।
       ভালো কথা, এ খোঁজারই বস্তু। কিন্তু খুঁজলেই আর মেলে কই? তবু একেবারেই কি আর মেলে না? তা বললে হবে কেন? তো সেই মনের খোঁজের পাড়ায় অনেক রথী-মহারথীর ভিড়। মাঝে মাঝে একাজে সেকাজে আমায় সে পাড়ায় ঢুঁ মারতে যেতে হয়। যেতে যেতে কিছু কথা আমার কানে এসেছে। সেই কথাগুলোই আমি আপনাদের সাথে একটু ভাগ করে নিতে চাই। শুনবেন? তবে আসুন।
       তবে তার আগে একটা কথা বলি। আপনারা যদি সেই রথী-মহারথীদের মধ্যে হয়ে থাকেন, কিম্বা গভীর জিজ্ঞাসু হয়ে থাকেন, তবে আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আমি জ্ঞানের জগতে নিতান্তই ভারবাহী গর্দভ বলতে পারেন। ভার বইতে বইতে কিছু উপাদান গায়ে মাথায় লেগে আছে, সেই সব নিয়েই বসা। কেমনভাবে বসা? এই যেমন ধরুন না কেন বাংলার একটা গ্রাম। সেই গ্রামের একটা মেঠোপথ। সেই মেঠোপথের বাঁকে, গ্রামের বাইরের দিকে একটা বড় বটগাছ। যার নীচটা গোল করে বাঁধানো। সেখানে আমি আপনি বসে আছি, দূরে সূর্য অস্ত যাবে যাবে করছে। গরুর গাড়িগুলো ধুলো উড়িয়ে গ্রামে ফিরছে। সেই ধুলোয় সূর্যের সোনা রঙ টলটল করছে। কেমন? এই হল আমাদের প্রেক্ষাপট। তবে শুরু করা যাক?
       তো সেই পাড়ার এক মহারথী বলে কি জানেন? আমাদের মনের চিন্তা করার নাকি দুটো দিক আছে। ও হ্যাঁ, সেই মহারথী আবার নোবেলও পেয়েছিল, অর্থনীতিতে। আমি পড়েছি। কি নাম তার? আমি টুকে এনেছি, একদম শেষে নাম বলে দেব। এখন নাম মনে করতে গেলে কথার খেই হারিয়ে ফেলব। তো সেই মহারথী বলে কি জানেন? বলে আমাদের মনের নাকি দুটো দিক। মানে চিন্তা করার দুটো দিক। এক, যে চিন্তা আপনা আপনিই হয়ে যায়, অনেক সময় আমি বুঝতেই পারি না, কখন করে ফেললাম এরকম চিন্তা, সে এক রকম। যেমন ধরেন, আপনি একটা মোটর গাড়ি চালাতে চালাতে পাশে শিবেনবাবুর সাথে এ মাসে কত বীজ তুলবেন সেই গল্প করছেন। কিম্বা সাঁতার কাটতে কাটতে আপনার ছেলেকে নামতা শেখাচ্ছেন – এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই... আপনি ডুবেও যাচ্ছেন না, আবার নামতাও ভুলে যাচ্ছেন না। এই ধরণের চিন্তাকে বলে কিনা 'আপনা আপনি চিন্তা'। দাঁড়ান, এর একটা ইংরাজি নামও আমি জানি -- ইনট্যুইশান। এ চিন্তা আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে তৈরি হয়েছে। একে আমরা চাইলেই থামাতে পারি না।
       তবে এই 'আপনা আপনি চিন্তা'র একটা গোল আছে জানো তো? এই যা, তুমি বলে ফেলেছি, কিছু মনে করবেন না... কি তুমি চলবে? আচ্ছা। তাই বলি। তো কথা হচ্ছে, এই 'আপনা আপনি চিন্তা'র একটা গোল আছে। কেউ কেউ নাকি এক অদ্ভুত ব্যামোয় ভোগে, তার নাম আমি বাংলায় করেছি 'বাগড়া চিন্তা'। ইংরাজি নামটায় ওরা বলে, অটোমেটিক নেগেটিভ থট। মানে ধরো তুমি একটা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছ, অমনি তোমার মন বলবে, ওরে আমার কেষ্টবিষ্টু এলো রে, পরীক্ষা দিয়ে যেন উল্টে দেবে, ওরে ফেল করে মরবি... যা যা...
       এরকম আনখাই চিন্তা। সারাক্ষণ ওদের মনের মধ্যে চলে। তা দাদা মিথ্যা বলব না, এ রোগ আমারও একটু আধটু নেই যে তা নয় কো। এই যেমন ধরো ট্রেন ধরব, ট্রেন সাতটা বারো-তে, আমি একটু দেরি করে বেরিয়েছি, অমনি ওই 'আপনা আপনি বাগড়া চিন্তা' বলতে শুরু করল, ওহো বাবু এখন বেরোলেন, আজ তুমি আর ট্রেন পেয়েছ... ওকি তোমার শ্বশুরের ট্রেন যে তোমার জন্য হাত-পা ছড়িয়ে ড্রাইভার, গার্ড বসে থাকবে? হল তোমার, কিস্যু হবে না... যাও যাও...
       যেই না ওসব চিন্তা মনের মধ্যে আসা, অমনি আমি ধাঁই ধাঁই করে দৌড়াতে শুরু করি। টেনশানে বুক ধড়ফড়, এত্ত এত্ত কিলো কিলো ঘাম। কি যন্ত্রণা বলো দেখি দাদা! কিন্তু একে তুমি থামাবে কি করে? তবে একটা কথা বলি, একে থামানোর উপায় আছে। সেই মহারথীরা একটা এয়সান ব্রহ্মাস্ত্র বার করেছে না? শুনেছি নাকি তার নাম সিবিটি -- কগনিটিভ বিহেভেরিয়াল থেরাপি, মানে 'বোধগম্যি আচরণের চিকিৎসা' বলতে পারো।
       এখানে একটা গপ্পো আছে, এ বি সি থিয়োরি, মানে 'ক খ গ তত্ত্ব'। মানে হল, এই ধরো কোনো একটা ঘটনা ঘটল। সেটা হল 'ক'। সেই ঘটনায় তুমি যা চিন্তা করলে সেটা হল 'খ'। সেই চিন্তায় তোমার যে অনুভব হল সেটা হল 'গ'। যেমন ধরো তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছ, হঠাৎ তোমার উল্টোদিক দিয়ে বলাইদা যাচ্ছে, তুমি ডাকলে, সে তাকালোও না, সাড়াও দিল না। এই ঘটনাটা হল 'ক'।
       এইবার তুমি ভাবলে, কেন ও সাড়া দিল না, আমি কি কিছু খারাপ কথা বলেছি কাল আড্ডা মারার সময়? এই ভাবনাটা হল 'খ'। অমনি তোমার মনে দুঃখু হল, সেটা হল গিয়ে 'গ'। আবার ভাবলে, শালা আমায় এড়িয়ে গেল? অমনি তোমার রাগ হল। কিম্বা ভাবলে, হয় তো আমায় দেখেনি, কিছু একটা চিন্তা করছে, যাকগে রাতে আড্ডার সময় জেনে নেব। অমনি তোমার মনটা শান্ত হয়ে গেল।
       দেখলে তো, 'বোধগম্মি ব্যবহার চিকিৎসা'য় কেমন করে 'ক খ গ তত্ত্ব' এলো। আরো আছে। এ-ও ওদের কাছে শুনেছি। ধরো একদিন রাতে বেশ কয়েকটা লুচি আর মাংস খেয়ে শুতে গেলে আর তোমার খুব অ্যাসিড হয়ে বুকে ব্যথা করছে। এটা 'ক'। অমনি তুমি ভাবলে, এই কেলো, হার্ট অ্যাটাক হবে নাকি? এই চিন্তা হল 'খ'। অমনি তুমি ভয়ে বিছানায় চিমসে গেলে, এই হল 'গ'। এখন যেই না ভয়ে ঘাবড়ে একশা হলে অমনি বুকের ভিতর জোরসে ধুক ধুকানি গেল বেড়ে। তোমার ঘাবড়ানি প্রায় বিকার ওঠার মত হল, তুমি 'ও পিসি! ও শিবুদা', বলে কেঁদেকেটে পাড়ার লোক জড়ো করলে। তবে দেখেছ, 'ক খ গ তত্ত্ব'তে কেমন করে 'গ' আবার 'ক'-কে উস্কে দিয়ে আবার একটা চরকি তৈরি করে?
       তো 'আপনা আপনি বাগড়া চিন্তা'কে থামাতে হলে আগে আমাদের এই ধরণের চিন্তা মনে উঠলেই তাকে চেপে ধরতে হবে। আমরা করি না? দুর্গাপুজোর আগে যখন গ্রামে চোরের উৎপাত বেড়ে যায়, তখন আমরা রাত্রে পাহারা দিই না? কেউ গ্রামের রাস্তায় সন্দেহজনক এলেই বলি না, ওই তুই কে রে? কেন মুখে গামছা ঢেকেছিস, খোল...
       এও সেরকম দাদা, যেই না 'আপনা আপনি বাগড়া চিন্তা' আমার অজান্তে আমার মধ্যে আসতে শুরু করল, অমনি টুক্ করে তাকে ল্যাং মেরে ফেলে বলতে হবে, কে? তাই বটে? এইসব বলছিস? কথা কি সত্যি? মিথ্যা মিথ্যা যুক্তি সাজাচ্ছিস? আমি ট্রেন মিস করব? বলি আমার হাতে ঘড়ি নেই? তুই যা বলবি তাই শুনব? কক্ষনো না। এই শুরু হল 'আপনা আপনি বাগড়া চিন্তা'র বিষদাঁত ভেঙে ফেলার প্রথম ধাপ দাদা। বাকিটা যেটা ঘটনা, যেটা বাস্তব সেটা নিজেকে বলতে হবে। জোর করে, না শুনতে চাইলেও শক্ত করে বোঝাতে হবে।
       আবার শুরুর কথায় আসি দাদা। তো বলা হচ্ছিল যে আমাদের দু'রকম চিন্তা। এক, 'আপনা আপনি চিন্তা', যা কিনা ইনট্যুশান; আর একটা হল গিয়ে 'সচেতন চিন্তা'। যেমন ধরো, তোমায় যদি বলি, পাঁচ দু'গুনে কত হয়? তুমি না ভেবেই বলে দেবে। ধর্মতলায় অফিস টাইমে ট্রাক চালাতে চালাতেও বলে দেবে। কিন্তু যদি বলি, বলো তো সাতশো পঁচানব্বইয়ের সাথে দুশো আশি গুণ করলে কত হয়? তুমি ট্রাক থামিয়ে খাতায়-পেনে করে বলবে, যদি না তুমি শকুন্তলা দেবী হও। একে বলে 'সচেতন চিন্তা' দাদা। কিন্তু জানো তো দাদা মানুষ চট জলদি সব বিষয়ে ওই 'আপনা আপনি চিন্তা'র থেকেই একটা ধাঁ করে সিদ্ধান্ত টেনে বসে। একটুও ভাবে না। এই যেমন ধরো একটা বাঁশ যখন আমাদের পুকুরে ডুবে থাকে, দেখলে মনে হয় না বাঁশটা জলের তলায় বেঁকে গেছে? প্রাথমিকভাবে আপনা আপনি তাই মনে হয় তো? কিন্তু আমি ভেবে জানি, আমার স্মৃতি থেকে জানি যে ওটা আসলে জলের খেলা, তাই অমন ভুল দেখাচ্ছে। তবু মানুষ কেন বলো তো 'আপনা আপনি চিন্তা'কেই এত গুরুত্ব দেয়? এক, শ্রম করতে হয় না; দুই, সহজ হয়ে যায়। আরে ভাই যে কোন কাজ করতে করতেই তা অভ্যাস হয়ে গেলে না ভেবেই সেরে ফেলা যায়। এই যেমন ধরো আমরা ঢেঁকিতে ধান পিষতে পিষতে কত গল্প করি, আগে আগে পারতাম? কিন্তু সেটা কাজের বেলায় ঠিক আছে। যদি তা সবক্ষেত্রেই ধাঁ করে মনে চলে আসা চিন্তাকেই ধরে চলি তবে আজীবন ঠকতে ঠকতে আর ঠকার শেষ থাকে না, তাই না?
       মেলা কথা বলে ফেললাম দাদা। কিছু মনে কোরো না। বইটা হল গিয়ে (নামঃ Thinking, Fast and Slow) একজন ইজরায়েলের মনোবিদ অধ্যাপকের লেখা, নাম ড্যানিয়েল কানামান। আসলে দাদা এখন এই 'বোধগম্মি বিজ্ঞান' বা 'কগনিটিভ সায়েন্স' বেশ কিছু আশার কথা বলছে। আর দাদা কি বলব, এরা দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, নৃবিদ্যা আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি – এই ষড়দিক নিয়ে এমন একটা কাণ্ড ঘটাচ্ছে না? যেন আবার সেই প্রজ্ঞার অন্বেষণ শুরু হচ্ছে দাদা নতুন করে। বুদ্ধ থেকে স্পিনোজা, দেকার্ত, কান্ট ইত্যাদি কার না ডাক পড়ছে গো দাদা ওদের কর্মশালায়!
       যাই উঠি, মনটা ভারি হয়ে যায় দাদা, এমন একটা কাণ্ডতে আমার মূর্খামি দেখে লজ্জায় মরে যাই। কিছুই হল না গো দাদা জীবনে। এখান ওখান থেকে কিছু এঁটোকাঁটা নিয়ে জীবনটা চলে গেল। আসি গো দাদা, অন্ধকার হয়ে গেল। শুকতারাও উঠে গেল।