Skip to main content

একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, উচ্চপদস্থ কর্মচারী মন্দিরে গেলেন। রাতে সবার সাথে খেতে বসলেন। খাওয়ার পর নিত্য অভ্যাস অনুযায়ী ধ্যানে বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে পাওয়া গেল নিজের শোয়ার ঘরে, ঝুলন্ত অবস্থায়। লিখে গেলেন, আমার জীবন পূর্ণ হয়েছে, আমি এখন অন্য জীবনে চললাম।

      ভারতীয় দর্শন আর ভারতীয় সমাজব্যবস্থা দু-মুখো। একপক্ষ ব্রহ্মে লিঙ্গ নেই, জাতিভেদ নেই ইত্যাদি বলে বলে সারা বিশ্ব এক সত্তার প্রকাশ বলে হেদিয়ে মরল। অন্যপক্ষ মানুষে মানুষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিভাজন টেনে, নানা নিয়মকানুনে জীবনকে অতিষ্ঠ করে, কারাগারতুল্য করে ফেলল। এর নানা তত্ত্ব, ইতিহাস, পক্ষ-বিপক্ষ বাদানুবাদ তত্ত্ব আছে। কিন্তু মোদ্দা কথা কোথাও একে অন্যের পরিপূরক তো হয়ই নি, উল্টে তুমুল বিপরীতমুখী। সে সব ইতিহাস।

      আর এখন? নানা গুরু, নানা মোটিভেটর। একজন সন্ন্যাসীকে দেখলাম তিনি সারা জগতকে ব্রহ্মময় দেখতে বলছেন। কেউ বলছেন, সমস্ত শ্বাস-প্রশ্বাস ত্যাগের ক্রিয়া শিখে সমস্ত দুঃখ থেকে বেরিয়ে এসো। কিন্তু মোদ্দা কথা হল আমি যদি নানা উপায়ে আমার সমস্ত দুঃখের উপরে উঠে যাই, তবে কি পারিপার্শ্বিকের সমস্ত দুর্দশা ঘোচে?

      এইখানেই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার একটা বড় পার্থক্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রাচ্যের সমস্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক – আমার মুক্তি, আমার ভক্তি, আমার সিদ্ধাই, আমার জীবনের কৃতকৃত্য হওয়া। পাশ্চাত্যে সমষ্টিগত উন্নতির কথা। সাধারণ বোধ ভিত্তিভূমির উপরে দাঁড়িয়ে সত্যকে খোঁজার চেষ্টা। কান্ট, স্পিনোজা, দেকার্তের মত মেটাফিজিক্সের উপর দর্শন দাঁড় করানো মানুষেরাও বলছেন না যে তোমায় এই এই পালন করতে হবে, ঈশ্বরের কৃপা পেতে হবে, এই এই অভ্যাস করলে তবে গিয়ে সত্য দর্শন হবে। আমাদের সেই সত্যের সার কি? – সমগ্র জগতের একত্ব। তোমার আত্মায় ব্রহ্মদর্শন। আর আয়রনি হচ্ছে, এই সমগ্র জগতের একত্বের কথা না হয় বাদই দিলাম, মানুষে মানুষে যে ভেদ নেই, এই তত্ত্বের উপর সমাজ প্রতিষ্ঠা করছে কারা? পাশ্চাত্যেরা। আমরা সতীদাহ থেকে শুরু করে নানা আজগুবি, বর্বরোচিত সিদ্ধান্তকে সমাজে নিয়ম বানিয়ে যখন নিশ্চিন্তে বেদ-বেদান্তের পন্ডিতি আওড়াচ্ছি, তখন যুক্তি আর সাম্যের উপর সমাজব্যবস্থা বানাতে চাইছে কারা? পাশ্চাত্যের সভ্যতা। তার মানে এ বলতে চাইছি না যে তারা নিখুঁত, বলতে চাইছি তারা আমাদের মত অতীন্দ্রিয় বিভাজন অন্তত টানেনি। তাই সমস্যাটা যখন ইন্দ্রিয়জগতের মধ্যে তখন তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও ইন্দ্রিয়জগতের মধ্যেই করা সম্ভব হয়েছে। কালো মানুষের ওপর ঘৃণা, যা তাদের সমাজের একটা গুরুতর সমস্যা, তার সাথে আধ্যত্মিকতত্ত্বজাত বিভেদের কোনো কারণ নেই। সে রাজনৈতিক, সামাজিক, ভৌগলিক। কিন্তু আমাদের উপনিষদ বর্ণিত ব্রহ্মের তত্ত্ব আমাদের সমাজের সাথে কতটা সম্পৃক্ত? সেই সাম্যের কথা, সেই সমত্বের কথা বইয়ের বাইরে এল কই? সেদিন থেকে আজ অবধি সেই ব্রহ্মজ্ঞাত মানুষদের সমাজের এত অন্যায়, এত বর্বরতাতেও শান্ত থেকে, নিরুত্তাপ থেকে যখন ঠাণ্ডা ঘরে বসে লেকচারের পর লেকচার দিতে দেখি বা শুনি, হাসিই পায়। মনে হয় এরা একটা বিশেষ জাতের মনোরঞ্জনকারী ভিন্ন অন্য কিছু নয়। আমার যা বিশ্বাস তা যদি আমার কাজের উদ্দীপক না হয়, তা যদি শুধুমাত্র নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যেই কার্যকরী হয়ে থাকে, তবে সে তত্ত্ব আদতে আমার কোন কাজে আসে?

      পরলোক আর আধ্যাত্মিক শান্তির জন্য যে আকুতি আমার সমাজের শিরা-উপশিরায় বয়ে বেড়াচ্ছে, তার মোহ থেকে বেরিয়ে সত্যকারের যে অবস্থায় এই ব্রহ্মময় জগতকে দেখি, তাকি আদৌ সুখকর? তাকি আদৌ শান্তির? এই সব প্রশ্নের উত্তর হল, এই জগত নাকি সবটাই মায়াময়। আমাদের আত্মাই আসল, দেহ মায়া, ছায়া। এ তত্ত্বে বুদ্ধি ভ্রান্ত হয় শুধু, সত্য অধরাই থেকে যায়। তাই এই ব্রহ্মজ্ঞানীদের দেশের হীনতা, নীচতা, দীনতা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে জ্ঞাত। কয়েকদিন আগে একটা ভিডিও শুনছিলাম। একজন কেউ স্বামীজি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলছিলেন, স্বামীজি আমেরিকা যাওয়ার আগে তারা নাকি নারী আর পশুকে তাড়নার যোগ্য মনে করত। তারপর স্বামীজির বেদান্তের ব্যাখ্যা শুনে নাকি আমেরিকার বুদ্ধিজীবী মহল সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল।

      এ গল্প আমিও ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি। বড় হয়ে নিজে পড়াশোনা করে জানলাম যে কিছুটা প্রভাব নিশ্চয় পড়েছিল, কিন্তু সে দেশের আপামর জনসাধারণের চিন্তাভাবনা বদলিয়ে দিয়েছিল, অর্থাৎ প্রকারান্তরে বলা যে আমরাই শ্রেষ্ঠ দর্শনে ভাবনায় – এ মিথ্যা কথা। গুজব। শোপেনহাওয়ারের মত মাত্র কয়েকজন সেই চিন্তায় অনুপ্রাণিত হলেও, এবং সেই শোপেনহাওয়ারই নিরাশাবাদী দর্শনের প্রবক্তা হয়ে কিছুকাল কাটালেও পাশ্চাত্যের ভাবধারা পাশ্চাত্যের মতই বয়ে চলেছে। যদিও মাঝে মাঝে প্রাচ্যের বক্তাদের কথা তারা শোনেন, এ একটা উদারতা, যেমন ঠিক ঠিক আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সিনেমার মর্যাদা তারা দেন। তেমনই আমাদের দর্শন, সঙ্গীতের মানও তারা দেন। কিন্তু এ মনে করার কোনো কারণ নেই যে আমাদের দর্শন তাদের থেকে অনেক উন্নত। মোটেও না, ভিন্ন। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে আমাদের দর্শনের অতীন্দ্রিয়তা ওদের নেই। বিনা আচমনে, সাধারণ বুদ্ধি দ্বারা বোধগম্য। কোনো আত্মা, অনাত্মা, ইত্যাদি তত্ত্বের ধোঁয়াশা নেই।

      তবে সে দেশের কোনো কোনো রথী-মহারথী আমাদের এখানে কেন আসেন, আমাদের ধর্মের দিকে ঝোঁক? সে ঋষীকেশে গেলে মুড়িমুড়কির মত দেখা যায়, ইস্কনেও দেখা যায়। কিন্তু সে আমাদের দর্শনের তাগিদে নয় অবশ্যই, আমাদের ম্যাজিকাল আধ্যাত্মিক জগতের মোহে। হ্যাঁ, স্পষ্টভাবেই বলছি, মোহে। যা ঘোরে রাখে, জাগিয়ে রাখে না, তা মোহ ছাড়া কি? তারা সমস্ত জগতের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে একটা তথাকথিত অন্তর্মুখী জগতের দিকে ঝুঁকে পড়ে কি সার্থকতা পান তারাই জানেন, কিন্তু আমার কাছে তা উৎকৃষ্টমানের স্বার্থপরতা আর কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

      গীতা অবশ্যই ব্যতিক্রমী। কিন্তু গীতাতে এত বিরুদ্ধমতের অবস্থান যে সেখানে একটা কোনো দিশা পাওয়া ভার। আর রইল আমাদের মহাভারত। তার অবস্থা বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছটার মত। তার যে মূল কোনটা, কোনটা প্রক্ষিপ্ত, তায় ব্যাখ্যার পর ব্যাখ্যা ইত্যাদি তো আছেই।

      তবে আমাদের হাতে পড়ে রইল কি? আমাদের বর্তমান অবস্থা কি? আমাদের সমাজব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, সঙ্গীত, শিল্প, বিনোদন, রাজনীতি, বিজ্ঞান, গবেষণা – সব পাশ্চাত্যের জ্ঞানোন্মুখী। পাশ্চাত্যের কষ্টিপাথরের দিকে তাকিয়ে। আর আমরা তাদের কি দিচ্ছি? আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যোগা। তাতে কি হয়? অন্তর্মুখী হয়ে শান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু সেই শান্তির ব্যবস্থা যদি দুরূহ জটিলতার মুখোমুখি হয় তখন? তখন আসে মনোবিজ্ঞানের চর্চা। মনোবিজ্ঞানের উৎস খুঁজতেও সেই পাশ্চাত্য। চিকিৎসাপদ্ধতিও সেই পাশ্চাত্য। তবে আমাদের বলে রইল কি? শুধুই ভাবের চর্চা? আমাদের মনীষার খোঁজ কি? শুধুই বৈরাগ্যের দ্বিচারিতা? শুধুই আকাশকুসুম? শুধুই কিছু অতিচালাক মানুষের নানা কথার ধাঁধাঁয় সব গুলিয়ে দিয়ে একটা শব্দের ঘোর তৈরি করা? তারপর কাজের বেলায়? এমনকি এই যে সেবা করার আদর্শ? এও কি সত্যিই ভারতীয়? আমাদের তত্ত্বে সে কথা থাকলেও আমাদের বাস্তবজীবনে কি তা কোনোদিন ছিল? না তো। আমরা ধ্যানের কথা বলেছি, ডুব দেওয়ার কথা বলেছি, সমষ্টিগতভাবে সার্থকতার রাস্তা খোঁজার কথা কখন বললাম? তবে কি সত্যিই আমাদের ভাঁড়ারে বর্তমানের উপযোগী কিছু কথাই নেই? এমনকি আমাদের আইনি ব্যবস্থাও তো পাশ্চাত্যর অনুগামী। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত ছাড়া। তবে আমাদের ধ্যান ভাঙলে আমরা কোথায় দাঁড়াই? কল্পনায়, না ধ্যানের বিপরীত কোনো বাস্তব রূঢ়তায়? জানি না। এর উত্তর আমাদের শ্রমের মাধ্যমে, বিনা ফাঁকি দিয়ে খুঁজতে হবে। নইলে মেনে নিতে হবে আমরা ক্রমশ পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে থাকা এক জাতি, যা যত উন্নত হবে তত সে পাশ্চাত্য ভাবধারায় বুদ্ধিগামী হবে, বিচারগামী হবে। আর কিছু ছুটকো ছাটকা ধ্যানের কেন্দ্র থাকবে যেখানে আমরা পশ্চাতমুখী হব, বা জিমে যাওয়ার অভ্যাসের মত অন্তর্মুখী হওয়ার অভ্যাস করব। এর উত্তর কি?