ভারত অর্থনীতিতে উন্নতি লাভ করছে শুধু না, ভারতীয়ের প্রতি যে আগে দুর্নাম ছিল, এরা বড্ড পরকালমুখী চিন্তাভাবনা করে দিন কাটাতে ভালোবাসে, একদম ইহকালের ভোগসুখ নিয়ে, জাগতিক উন্নতি নিয়ে ভাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, সে কলঙ্ক ঘুচেছে।
কি করে? দেখুন আমি ওইসব অর্থনীতির গভীর বিশ্লেষণ ইত্যাদির দিকে যাব না। আমি আমাদের বর্তমান অধ্যাত্ম সম্পদের দিকে তাকাতে বলব। আহা, দাঁড়ান, অধ্যাত্ম সম্পদ শুনেই শাস্ত্র খুলে মাথা চটকাবেন না, সে সব অনেক হয়েছে। আমি বলতে চাইছি বর্তমান যুগের গুরুকূলের দিকে তাকান। আজ দেখি বিশাল দামী একটা বাইক চড়ে সদগুরু, কালো চশমা চোখে লাগিয়ে, সাদা দাড়ি হাওয়ায় উড়িয়ে কি চমৎকার ভেসে চলে গেলেন। মুগ্ধ হলাম। যে মানুষ জীবন্মুক্ত, তার কাছে বাইকই বা কি আর হেঁটে যাওয়াই বা কি।
এরপর দেখুন অন্যান্য গুরুদের, তাদেরও মঠ-মিশন, বৈভব কেমন ছড়িয়ে পড়ছে। এ উন্নতির লক্ষণ না? আজকাল যতই 'কামিনী-কাঞ্চন' ত্যাগের শিক্ষা দেওয়া হোক না কেন, তা এসি ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে না বসলে হয়? হয় না। যত যত গুরু দেখবেন এখন অধ্যাত্ম সম্পদ ঝরে ঝরে পড়ছেন দেখতে পাবেন। আগে অধ্যাত্ম সম্পদ বলতে ওই কি সব বিবেক-বৈরাগ্য হাবিজাবি বোঝাতো। রামকৃষ্ণদেব, মহাপ্রভু, শিরডীর সাঁই, রমণ মহর্ষি - কি অদ্ভুত সেকেলে চিন্তাধারার মানুষ! কেউ টাকা দিতে গেলে বাঁশ নিয়ে তাড়া করে, কেউ রাজা দেখা করতে চাইলে সটান না বলে দেয়, কেউ মারা যাওয়ার আগে দশ-কুড়ি টাকাও জমিয়ে যেতে পারে না। কি বোকামি মাগো! বলি হ্যাঁ গা, ঈশ্বরচিন্তা করবে বলে একটুখানি বিষয়বুদ্ধি থাকবে না? তা তাদের শিষ্যেরা সে ভুল শুধরে নিয়েছে। দেখুন আজ ওইসব বিবেক-বৈরাগ্য শুকনো কথায় চিঁড়ে ভেজে না। চারদিকে বৈভব ঝরে ঝরে পড়ছে। ঈশ্বরচিন্তা করে করে আগে মানুষ কেমন শুকিয়ে যেত, মায় লোকনাথ বাবাকেই দেখুন। এখন কেমন সব চকচকে গুরু, চকচকে শিষ্য, দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। তা বাপু যিনি জগৎ সংসারের মালিক, তাঁকে নিয়ে রাতদিন ভাবনাচিন্তা করলে তিনি কি তাঁর সম্পদ থেকে ভক্তকে বঞ্চিত করবেন? কেউ মন্ত্রী হল, আর তার ছেলেমেয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি যাবে? এটা কোনো কাজের কথা হল? তবে? অধ্যাত্ম সম্পদ জমবে না? সেকি শুধুই লোকচক্ষুর অন্তরালে বায়বীয় হয়ে থাকবে? না। সেদিন আর নেই।
অবিশ্যি দেখুন ভক্তের চাহিদাও তো বদলেছে। আগে বেশিরভাগ ভক্তেরা কি খুঁজতে গুরুর কাছে যেত? নানা তত্ত্বের অন্বেষণে। যেমন ঈশ্বর আছেন কি নেই? তিনি সাকার না নিরাকার? তাঁকে ভক্তিতে পাওয়া যায় না জ্ঞানে? যোগাভ্যাস করতে হলে কি কি নিয়ম মেনে চলতে হবে? এই সব নানা হাবিজাবি তত্ত্ব। আর গুরুরাও তেমন ছিলেন, আপনি কথামৃত, কি Talks With Ramana Maharshi, কি চৈতন্যচরিতামৃত খুলুন, পাতায় পাতায় এইসব হাবিজাবি বায়বীয় কথায় ভর্তি। আসলে হবে নাই বা কেন? সেকালে না জেনেটিক্স, না কসমোলজি, না স্ট্রিং থিওরি, না কোয়ান্টাম ফিজিক্স, না বেশ চলনসই অর্থনীতি ইত্যাদি ছিল। তাছাড়া ওটিটি, কেবল্ চ্যানেল, স্মার্টফোন ইত্যাদির কথা তো বাদই দিন। আজকাল মানুষ জেনে জেনে পাগল, তথ্যের ভারে এক একজন ভিসুভিয়াস হয়ে আছে, যখন তখন যেখানে সেখানে ফেটে পড়ছে। 'লেগে যা লেগে যা নারদ নারদ' হয়ে যাচ্ছে। তবে এখনের জন্য দরকার কি? প্রেসার, সুগার, থাইরয়েড কমানো। তার জন্য কি দরকার? শান্তি। কিরকম শান্তি? না গুরুদত্ত শান্তি। কেন গুরুদত্ত শান্তি? যাতে কিনা আমাদের নিত্য সংসারের বাইরের এই গুরুমুখী সোর্সটাকে কেউ আটকাতে না পারে। একটা সার্টেনিটি আছে।
তবে শান্তি কি বললেই পাওয়া যাবে? না। সে আজকাল মহার্ঘ্য বস্তু। আপনাকে তার জন্য সিট বুক করতে হবে। যত গুরুর কাছে বসতে চান তত দামী প্যাকেজ। এ অবশ্য সব জায়গায় নয়। তবে এই গুরুর পপুলারিটিতে আমাদের বাংলা এখন অনেক পিছিয়ে। তেমন পপুলার ফেস নেই কেউ। আসলে এনাদের সমস্যা হচ্ছে এরা না প্রাচীন ত্যাগের বৈভবে ভূষিত, না অত্যাধুনিক শ্রোতাদের চাহিদা অনুযায়ী বাগ্মিতায়। ইস্কনের গৌর গোপাল দাসের ইউটিউব যতবার হিট হয় তা খুব কম মোটিভেটারেরই হয় এখন। স্বামী সর্বপ্রিয়ানন্দ বেদান্তের চর্চাকে কিছুটা জনতার কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টায় আছেন যদিও। তবে সে বড্ড এলিট ক্লাসের জন্য, খুবই বৌদ্ধিক ব্যাপার স্যাপার। ফলে আধুনিক গুরুদের প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে।
এ সব বাদ দিলে উত্তর ভারতের বেশ কিছুটা অংশে কথকের ভূমিকায় আবার অনেকেই ভীষণ জনপ্রিয়। মুরারিবাপু তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তবে সেখানেও আমাদের বাংলায় তেমন কল্কে কেউ পান না। আমাদের কথক ঠাকুরেরাও আজকাল আসর জমাতে অক্ষম।
তবে কি বাংলা যুক্তিবাদী হয়ে পড়েছে ভীষণ? উঁহু, সে গুড়ে বালি। বাংলা না হয়েছে যুক্তিবাদী, না জড়বাদী, না ভাববাদী। বাংলার এখন মতিগতি যে কোন দিকে তা বোঝা ভার। রাজনীতি ভারতে কোথায় আর নেই, কিন্তু তার পাশাপাশি আরো কিছু আছে। আমাদের ওটিটি, লেখালেখি, গান থেকে কবিতা খুব একটা সুদিনের রাস্তায় হাঁটছে না।
যে কথায় ছিলাম, আমাদের ভক্তকূল এখন যা নিয়ে আকুল তা হল চিত্তের শান্তি। তা নিয়েও একটা কথা বলা যায়। দেখুন আগে ছিল এই নশ্বর জগৎ, তার নানা অশান্তি। এখন হয়েছে এই নশ্বর জগতের মধ্যে আরেক নশ্বর চঞ্চল জগৎ, এই সোশ্যাল মিডিয়া। মানুষ যায় কোথায়? আগে শুধু জগতের মায়া কাটাতে পারলেই মোক্ষ করতলাগত। এখন আগে এই সোশ্যাল মিডিয়া নামক উপজগতের মায়া কাটাও। তারপর আসল জগতে কিছুদিন নিজেকে খাপ খাইয়ে নাও। তারপর মোক্ষ হলেও হতে পারে। কিন্তু সে হওয়ার নয়। জগতিক মোহ তবু ছাড়লেও ছাড়া যায়, উপজাগতিক মোহ ছাড়াবার উপায় না আগমে না নিগমে লিখেছে। মায় অত অত অধ্যাত্ম বলে বলশালীরা পর্যন্ত এই মায়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে গা? তা আমাদের মত মানুষদের আর কি গতি?
এখন তাই অলিতে-গলিতে, আকাশে-বাতাসে কান পাতলেই শুনতে পাবেন শান্তির খোঁজ। কোন গুরুর কোন প্যাকেজে কতদিনের শান্তি, সেই খোঁজ চলছে। আর ওদিকে অধ্যাত্ম সম্পদ জমেই যাচ্ছে, জমেই যাচ্ছে, জমেই যাচ্ছে... লোকের নজর যাতে না লাগে তার জন্য আবার হরেকরকম জনহিতকর কাজও করা হচ্ছে, ওই চোখের পাশে মায়েরা যেমন কাজলের টিপ পরিয়ে দেন তেমন আর কি।
তবে এত এত এত প্রাণায়াম করে শান্তি কি পাওয়া যাচ্ছে? উঁহু, খানিক বিরতি, আবার সেই এক। তবে উপায়? হে হে, উপায় কিস্যু নাই। আপনি যতই গুরু খুঁজুন, সাধ্যসাধনায় ঝাঁপ দেন। নিরামিষ খান। প্রাণায়াম করুন। জপ করুন। তীর্থে যান। সব পাবেন, কিন্তু সব হারাবেন। কেন বলেন তো? পাত্র তৈরি হয় নাই যে! পাত্র কি? পাত্র হল চিত্ত। সে চিত্তে শান্তি জল দাঁড়ায় না কেন? দক্ষিণেশ্বরের খুড়ো বললেন, ওরে ও 'আমি' ঢিবিকে নামা, নীচু কর। তবে শান্তিবারি দাঁড়াবে। এখন তাকে নামাই কি করে? ভায়া, উঠল কি করে? কোন গ্যাসবেলুনে ফোলাইসো তারে? সেটায় ছ্যাঁদা করো আপনি নামবে। হুস হুস করে নামবে। যত নামবে তত প্রাণে শীতল বাতাস লাগবে। শেষে বুকের মধ্যে তাকিয়ে বলবে, হঃ... মশায় আপনি এইখানে… আপনার লগে কই কই দ্যাশ না ঘুরে বেড়ালুম কত্তা….'সব নিয়ে শেষ ধরা দিলে গভীর সর্বনাশে'.... এই সর্বনাশটুকু না হতে দিলে যে শান্তি নেই বন্ধু….. বীজ মরলেই যে না গাছ!….