যে সমাজ সুখ আর নিরাপত্তার বাইরে হাঁটার মনুষ্যত্বের পুঁজিটুকু হারিয়ে ফেলেছে, সে সমাজে একটা ছ বছরের নাবালিকাকে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারার ঘটনা, নিতান্তই চাঁদে জল পাওয়া যায় কিনা ধরণের ঘটনা। তার ওপরে যখন সে মেয়েটা দিনমজুরের মেয়ে। আমার চারপাশ ভীষণ শান্ত। সব ব্যাপারে অত প্রতিক্রিয়াশীল হও কেন? এরকম ঘটনা এতবড় পৃথিবীতে ঘটতেই পারে। এত বিষাদের কথা কেন? এত নেগেটিভ ভাবার কি আছে? তেলের দাম কি বাড়ল? আইপিএল এর খবর বলো।
নাটকীয় উপস্থাপনা দরকার। খবরের কাগজ, টিভির নিউজে বেশ দৃশ্যমান বর্ণনা প্রয়োজন। তবে গিয়ে আমরা হুজুগে মাতব। বেশ কিছুদিন সমস্ত আবেগকে কেন্দ্রীভূত করে ঝাঁপিয়ে পড়ব, পাড়ে গামছা তোয়ালে সাবান রেখেই ঝাঁপাব, যাতে সবাই যখন উঠবে তখন আমিও উঠে গা হাত পা মুছে আবার সেঁধিয়ে যেতে পারি ডেরায়।
এত সভা সমতি, এত স্লোগান, এত লেখালেখি, এত চীৎকার...সব কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। তার কারণ সবই ভীষণ সুপারফিসিয়াল স্তরের। একদম নীচের তলা অবধি গিয়ে কাজের, সচেতন করার মানুষ কই? শিক্ষা কই? হাত বাড়ানোর হাত কই? যে সমাজ দুর্বল, পিছিয়ে পড়া স্তরকে অনুগ্রহ করে সাহায্য করে, সে ক্ষীণধারার নদীর মত কিছুদুর প্রবাহিত হয়েই শুকিয়ে যায়। মানুষের অনুকম্পার স্বাস্থ্য অতটা উন্নত হয়নি এখনও। অনুগ্রহ না, কর্তব্য, দায়িত্ব। যে সুবিধাটা আমি শুধুমাত্র জন্মসূত্রে পাচ্ছি, তা আরো নীচের স্তর অবধি নিয়ে যাওয়টা আমার কর্তব্য, দায়িত্ব। কিন্তু সে গুড়েবালি। সমাজের উন্নতির জন্য আমাদের করণীয় ভোট দেওয়া আর প্রতিদিন নিন্দা-সমালোচনা করা। আর নৈতিক পথে চলার ভার সাধু-সন্ন্যাসী নামক ব্যাচেলার ব্র্যান্ডের। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য - সুখ ও নিরাপত্তার গোড়াকে শক্ত করার প্রচেষ্টা পাওয়া। তার জন্য আস্তিক, নাস্তিক, নীচু হতে, যুক্তির ধোঁয়া সৃষ্টি করতে, যা বলো তাই করব। শুধু দেখো আমার গাড়ির দরজা যেন চলতে চলতে খুলে না যায়, মাঝপথে টায়ার না ফেটে যায়।
এটা ঠিক যে সমাজ সতীদাহ থেকে বাল্যবিবাহ সব কিছুর সমর্থন যোগ্য শাস্ত্র বানাতে পেরেছে, যে সমাজ জন্মসূত্রে মানুষে মানুষে প্রভেদ সৃষ্টির জাত নামক অভিনব বৈজ্ঞানিক কৌশল আবিষ্কার করতে পেরেছে, সে সমাজকে স্বাভাবিক মনুষ্যত্বে সাড়া দিতে অনেকটা গভীর আলোড়ন, চীৎকারের প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান দ্বন্দ্বের বিষয় ধর্ম। আমরা ভীষণ ব্যস্ত রাম-রহিমের মধ্যে একটা বোঝাপড়া সেরে নিতে। নিজের স্বভাবে স্বাভাবিক উদারতার অনুভব না থাকলে বাইরে তা প্রদর্শনের একটা উত্তেজনা চেপে ধরে। আর যে সমাজে স্বর্গপ্রাপ্তির চেয়ে বড় পুণ্য আবিষ্কৃত হয়নি, সে সমাজে ইহকালটা রাবণের বংশধরদের হাতেই চলতে থাকে আর থাকবেও। ইহলোকের সুখের গোড়াপত্তন হলে চাই দিব্যলোকে অর্থাৎ পরলোকে সুখের গোড়া মজবুত করার তাগিদ। যা কিছু অদৃশ্য, তাই অদৃষ্ট। সেটা যখন যুক্তির দ্বারা, শুভবুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রণে আনা গেল না, তখন দেবতা আর জ্যোতিষীরাই ভরসা।
এ হেন সমাজে মনুষ্যত্বের আশা? যেখানে আধুনিক হওয়া যায় পোশাক বদলালেই, নিজের ভাষা ছাড়তে পারলেই, সেখানে আধুনিক হওয়ার অর্থই তো ওদের মত হওয়া। ভিসা পাসপোর্টএর হ্যাপা ছাড়াই যারা নিজের দেশেই যারা বিদেশকে অনুভব করতে চান, তাদের সংখ্যাও মা ষষ্ঠীর কৃপায় কম নয়। তারা বেশি চীৎকার করে, স্বদেশের উপর রাগ যে কোনো ইস্যুতে উগরে উগরে বার করে, ওদের মত (পাশ্চাত্যদের) লেখে, ওদের মত জন্মগতভাব এমন ধারা বিশ্বাস করে, অন্যকে বিশ্বাস করাতে চায় ফলে কোনো জলই আর নিম্নগামী হওয়ার মত বলিষ্ঠ ধারায় বয় না, নীচুস্তরে যারা তারা সে অন্ধকারকেই আঁকড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
অনুকরণশীল আর সংরক্ষনশীল সমাজের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে, সেখানে স্বাস্থ্যবান মনুষ্যত্বের বিকাশ, মননের বিকাশ স্বাভাবিক গতিতে হবে, এমন আশা করাটাই বাড়বাড়ি। এর মধ্যে যারা আপন চরিত্রবলে বলীয়ান হয়ে সোজা দাঁড়াবার জোর দেখাতে পেরেছেন, বা পারছেন তারাই আগামী ভবিষ্যতের ভরসা। সত্যার্থী মহাশয়দের মত মানুষদের কাজ নিয়ে তেমন উৎসাহ আমাদের ভারতীয়দের তেমন একটা নেই। নোবেল না পেলে তার নাম তথা কাজের সম্বন্ধে না জেনেই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে হত, আর তাতেও আমাদের কোনো ক্ষোভ হত না, কারণ ওসব অকাজের কাজ। আমাদের মিডিয়া ধনঞ্জয়ের দিনপঞ্জিকা ছাপে, সত্যার্থীদের মত মানুষদের খোঁজে গেলে ব্যবসায় ঘাটতি হবে। আসলে আজগুবি দর্শন আর বিশ্বাস আর অনুশীলনের ফলে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছিয়েছি যে কোনো কিছুই একটা বাড়াবাড়ি মাত্রায় না পৌঁছালে নড়ে উঠিনা। তাই দেশকে 'মা' বলে না ভাবলে স্বাভাবিক দেশপ্রেম জাগে না, প্রতিটা জীবকে নাকি শিব হিসাবে না দেখলে তাকে ভালোবাসার বা সেবা করার তাগিদটুকুও মনে স্থির জন্মায় না।
অর্থাৎ মানুষের যখন নিতান্ত শুধু মানুষ হয়ে থাকার মানটুকুও সমাজ দিতে পারে না, তখন ছ বছরের মেয়ে ধর্ষণের পর পুড়ে মরল আর না মরল...আত্মার তো কিছু হল না...আর স্বদেশী বিদেশিরা দেখল আলোড়নকারী নিউজ বানানোর তেমন কোনো রসদ নেই যখন …
ইতিহাস যতই জাগাতে চাক আমাদের...সে তথ্যের থেকে অমোঘ অস্ত্র আমাদের আছে, 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...'...ঘুমিয়ে পড়ুন...কোত্থাও কিচ্ছুটি হয়নি...স্বর্ণযুগ এলো বলে...