একটা সময় মন পাকতে শুরু করে সংসারে। পাকা রঙ যা ধরে সে শুধু যে তার নিজের ব্যক্তিত্ব মিশে, তা ঠিক নয়, চারিপাশের মানুষের অবদানই বেশি।
মানুষের উপর প্রভাব ফেলে মানুষ। প্রকৃতি ইত্যাদি যা বলি, তার প্রভাব আর কতটুকু? যেটুকু পড়ে সেও সাময়িক। মানুষের উপর মানুষের প্রভাবই দীর্ঘস্থায়ী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী। মানুষের প্রভাব মানুষ এড়িয়ে চলে, এমন হওয়ার যো নেই। সব ত্যাগ করে যে সন্ন্যাসী হতে চাইছে আদতে সেও পরোক্ষ ভাবে জনমানস দ্বারা প্রভাবিত বলেই সব ত্যাগ করে নিজেকে নিয়ে সরে থাকতে চাইছে, সে নিজের কাছে নিজে আগেই হেরে বসে আছে। যদিও এ পথে ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়, তারা নিজের মধ্যে কিছু একটা উপলব্ধি করে সংসারের সাথে মিশতে চেয়েছে। কিছু একটা জানাতে চেয়েছে। সে অন্য প্রসঙ্গ।
তবে এ কি পরাধীনতা? হ্যাঁও বটে, নাও বটে। আমি কতটা প্রভাবিত হব তা তো আর আগে থাকতে স্থির করে রাখতে পারি না। প্রভাবকে কাটিয়ে ওঠা যায় না, কিন্তু প্রভাবকে বিচারের আওতায় আনা তো যায়। তার মোড় ফেরানো যায়, তাতে নিঃস্পৃহ হওয়া যায় কিছুটা দূর অন্তত। ধীরে ধীরে এক রঙ থেকে অন্য রঙে এসে দাঁড়ানো যায়। সে শুধুমাত্র সম্ভব বিচার আর ধৈর্যর উপর নির্ভর করে।
একের প্রভাব কাটাতে না কাটাতে আরেকের প্রভাব এসে পড়ে। গোলটা বাধে তখন, যখন প্রভাবিত হই অথচ তা বোধের মধ্যে ধরা দেয় না। মনে হয় যেন সেইটাই আমি। একটু শান্ত হলে বোঝা যায়, সারাদিনের মাত্র কতটুকু আমি, আর কতটা বাইরের নানা রঙের তুলির টান, যা অবশ্যই আমার আমির ক্যানভাসেই পড়েছে। সেটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সেই তুলির টানের রেখাকে নির্বিচারে মেখে বসে থাকা স্বাধীন চিত্তের স্বভাব নয়। সে নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে দেখার চেষ্টা করবেই। যেমন বীজ রোদ-জল- বাতাস নিয়ে নিজেকে অঙ্কুরের মধ্যেই দেখে। সবকে সে স্বীকার করে, কিন্তু সে সবিচার, সচেতন স্বীকার। জড়ের মত আত্মসমর্পণ নয়।
মানুষের সব চাইতে কঠিন পরীক্ষা অপমানের পরীক্ষা। অপমান পরুষ বাক্যে কিম্বা উপেক্ষায়, যাই হোক। সে অপমানের বোধ বড় সাংঘাতিক রঙ চড়ায়। কিন্তু মজার কথা হল, আমায় ততটাই অপমান করা সম্ভব যতটার মান নিয়ে আমি নিজে নিশ্চিতরূপে জ্ঞাত নই। আমার যে মান, সে এমন একটা অদৃশ্য বায়বীয় বস্তু যে তার সুনির্দিষ্ট পরিখা নির্ধারণ করা কঠিন। পা যখন স্বাভাবিক থাকে তখন সে আমার কাছে সমস্যা নয়, কোথায় কাঁটা বিঁধল, কোথায় ঠাণ্ডা-গরম অনুভব হল ইত্যাদি বেশ বোঝা যায়। কিন্তু যখন সেই পায়েই ঝিঁঝিঁ ধরে, কিম্বা আহত থাকে - তখন সে হয় নিজেই সে নিজের বোঝা নয় আতঙ্ক - এই বুঝি বিপদ হল।
মানুষ হিসাবে আমার যে মান সে সুনির্দিষ্ট, তা সংবিধান স্থির করে দিয়েছে, তাকে নিয়ে গোল নেই আমার, কিন্তু এই "সৌরভ ভট্টাচার্য্য" নামক জীবটার জন্য যে মানের ব্যবস্থা "সৌরভ" নিজেই করেছে, তার হিসাব? সে বস্তুটা যে কোথাও নেই! তাই অল্প কথাতেই সে অস্তিত্বসংকটে ভোগে, গুমরে মরে, শাপশাপান্ত করে মরে। 'সৌরভ' মরে 'সৌরভ' এর তৈরি জালে।
উপায়? সেই সব কুয়াশা কাটানোর চিরকালীন উপায়, ধৈর্য আর বিচার। পালাবার পথ নাই, কিন্তু আনন্দে থাকার আলো আছে প্রচুর, বাইরে না, ভিতরে।
সৌরভ ভট্টাচার্য
14 December 2018