সৌরভ ভট্টাচার্য
30 June 2016
বেশ কিছুকাল আগে আমার এক অত্যন্ত প্রিয়
আলোকচিত্রগ্রাহকের তোলা একটা পলাশের ছবিতে লিখেছিলাম -
ঠোঁটটা অনেক কাছে আনার পর জানলাম,
সামনে ওটা ঠোঁট ছিল না, ছায়া ছিল।
ফেরার পথে কিছু পলাশ কুড়িয়ে ফিরলাম
খেয়াল করিনি কোনোদিন,
পলাশের বুক এত লাল ছিল।
একজন স্বনামধন্য কবির হাতে সে লেখা পড়ল। তিনি বললেন,
‘এ কি করেছ? পলাশকে ঠোঁটের সাথে না, যোনির সাথে তুলনা করো। ঠোঁটের সাথে তুলনা
করাটা সেকেলে হয়ে গেছে যে, বুঝলে?’
চুপ করে থাকলাম। কি বুঝব? ওনার মনের গতি? না তথাকথিত আধুনিক সাহিত্যের রীতি?
'দেশ'-এ 'পার্থিব', 'প্রথম আলো' এইদুটো লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি 'দেশ' নেওয়া
বেশ কিছুকাল বন্ধ রেখেছিলাম খানিক এই কারণেই। অকারণে অযথাই বিছানা আসতে শুরু করল
গল্পে। পুরো লেখাটা পড়ার পর মনের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব করতাম।
আধুনিকতা কি? পুরোনোকে সরিয়ে নতুনকে আনা। পুরোনো ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে নতুন
ধ্যান-ধারণা। পুরোনো মূল্যবোধের জায়গায় নতুন মূল্যবোধকে আনা। মানুষের পরিবর্তনে যা
আসে সে তো মানুষই। আধুনিক মানুষ ও পুরোনো মানুষের মধ্যে 'মানুষ' শব্দটার তো
পরিবর্তন সম্ভব না। তেমনই সম্ভব না মানুষের কিছু মৌলিক মূল্যবোধের পরিবর্তন। যা
দেশ-কাল-নির্বিশেষে চিরন্তন। সত্য, প্রেম, নিঃস্বার্থপরতা, অনুকম্পা ইত্যাদি।
সাহিত্য কি তবে সে জটিল পথ পরিবর্তনের ছবি আঁকবে না? তার মস্তিষ্কের গভীর
তন্ত্রীতে উপতন্ত্রীতে যে আন্দোলন, যে সংশয়, যে উপলব্ধি তার কথা বলবে না?
সে গুরুদায়িত্বকে এড়িয়ে শুধুমাত্র sensual হয়ে উঠলেই কি আধুনিক সাহিত্য হয়ে গেল?
নিজের প্যান্টজামা খুলে সর্বসমক্ষে দাঁড়ানোতেই কি আধুনিক মানসিকতার পরিচয়? সেই
দৃশ্যকে নির্লজ্জের মত উপভোগ করাকেই কি তবে maturity বলে? মানে পরিণত মনের পাঠক?
মস্তিষ্ককে শরীর থেকে ছিঁড়ে নিজের নাভির নীচের সমস্ত খিদে, লাস্য অভিলাষকে জাহির
করাই কি সত্যকারের সাহিত্যের অকপটতা বিচারের একমাত্র মানদণ্ড ভাবতে হবে? সমাজের যে
নিয়ম-শৃঙ্খলা সমাজকে ধরে রাখতে, সুষ্ঠুভাবে চালিত হতে সাহায্য করছে, তার মূলে
কুঠারাঘাত করে, তার সঠিক মূল্যায়নের পথ থেকে সরে এসে শুধুমাত্র অহংবশতঃ তাকে
ভাবাবেগের জোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়ার কথায়, বাহবা আশা করা কি খুব দায়িত্বজ্ঞানহীন,
সস্তা উদ্দেশ্যে চরিতার্থতার কৌশল নয়?
ইংরাজী ভাষার দৌলতে বিশ্বের বহু কালজয়ী সৃষ্টি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। দেখেছি মানুষের
কথাই চিরটাকাল মানুষের প্রাণে গিয়ে স্থির আসন নিয়েছে। কথা হচ্ছে কোন মানুষ?
মানুষের মধ্যে একটা পশু চিরটাকাল আছে। সে যে পশুর অভিব্যক্ত রূপ এ কথা তো আর ঘটা
করে বলার প্রয়োজন নেই। সে জীব। তার আহার নিদ্রা মৈথুন - সব আছে। সব জীবের যেমন
আছে। এখন ব্যাপারটা হল, সাহিত্যের কাজ কি সে সবের খতিয়ান দেওয়া? এ যেন রাজকবিকে
হেঁশেলের দায়িত্বে পাঠানো। আরে সে সব যে আছে সে তো কেউ অস্বীকার করছে না। তবে তার
বর্ণনাই কি উৎকৃষ্ট সাহিত্যের পরিচয়? একটা সুদর্শন প্রাসাদে এসে কি রসিক ইঁটের
হিসাব কষে? অপূর্ব একটা তৈলচিত্র দেখতে দেখতে রসিক তেলের কোম্পানীর খোঁজ নেন? যদি
নেন তবে আর যেই হোন, তিনি রসিক নন।
একটা ঘটনা মনে পড়ল। রেজওয়ানা চৌধুরীর অনুষ্ঠান থেকে ফিরছি। অসাধারণ অনুষ্ঠান ছিল।
তার ঘোর তখনো কাটেনি। কয়েকজন মহিলা সহযাত্রী হলেন, যাঁরাও উক্ত অনুষ্ঠানে ছিলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন আরেকজনকে বললেন, ‘শাড়িটা দেখেছিস? গলার হারটা?’... তারপর
বাংলাদেশ ও ভারতে শাড়ির গুণগত মান, গয়নায় খাদ মেশানোর ধারা ইত্যাদি উচ্চতত্ত্ব
আলোচনায় রত হলেন। আবার এমনও হয়েছে, ট্রেন চিল্কার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সকালের মনোরম
পরিবেশে প্রাণ স্নিগ্ধ। এমন সময় একজন সহযাত্রী বললেন, ‘এই যে চিল্কায় কি কি মাছ
পাওয়া যায় জানেন?’ তারপর কি কি মাছ কি কি রন্ধন পদ্ধতিতে কিরকম লোভনীয় হয়ে ওঠে তার
বিশদ বিবরণের তালিকা শুরু হল।
তাই বলছিলাম সাহিত্যকে স্থূল বাজারের কারবারি করে তুললে আখেরে আমাদের ক্ষতি। তবে
কি সাহিত্যে সে জীবজ বর্ণনার কোনো প্রয়োজন নেই? নিশ্চই আছে। প্রয়োজন পড়লে তার
বর্ণনার দায় নিতে হবে বইকি। তবে কি ভাবে? সেখানেই আসে পাঠক ও লেখকের রুচির শালীনতা
ও সুক্ষ্ম রসবোধের পরিচয়। পুষ্টির প্রয়োজনে খাদ্য অম্ল, কটু, তিক্ত, ঝাল হোক,
কিন্তু শুধুমাত্র রসনার তৃপ্তির জন্য তাকে সেই ধারায় আনতে হলে তো বিপদ! মননের অভাব
sensuality দিয়ে পূরণের প্রথা বহু প্রাচীন। মননের অভাব ঘটলে বিশ্ব সাহিত্যের
আঙিনায় আসি না কেন? লিখতে না পারি পড়তে তো পারি। মননে শাণ তো দিতে পারি। তারপর না
হয় জামাকাপড় পরে ভদ্রস্থ হয়েই সাহিত্যের দুনিয়ায় আসি। খুব কি দেরি হয়ে যাবে?