সৌরভ ভট্টাচার্য
9 May 2019
সাজিয়ে কিছু মিথ্যা কথা আনিনি। সাদা পাতাটা সামনে থাকে যখন, তার পাশে তুমি, মনে হয় কিছু ভালো কথা লিখি। বিশ্বাসের কথা, আশ্বাসের কথা। আজ ইচ্ছা করছে না। আমার ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া আমার পুঁজি বলতে কিছু নেই। বড় ভাব, বড় আশা, বড় স্বপ্ন, বড় চিন্তা – নেই। ফুরিয়ে গেছে। টিকতে পারেনি। কোনো মহামানব আসবে না, আমরা বুঝে গেছি। ভান করাটা থামাইনি যদিও। তুমি কবি ছিলে। আজ কবিতা নেই, কবি আছে। আজ শুধু গদ্য। তুমি যে বিশ্লেষণ পছন্দ করতে না, মানুষের চরিত্র ঘেঁটে তার থেকে গভীর সত্যের অন্বেষণ যে তোমার বিশ্রী লাগত, আমরা সেই করি রাতদিন আজ। কারণ আমাদের কল্পনাশক্তি মৃত আজ। তার জায়গায় বিভীষিকা, আতঙ্ক, ভয়।
আমার নিজের লেখা অক্ষরগুলো দেখে ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, কেন লিখছি এসব? অনেকেই তো নিন্দামন্দ করবে। বলবে “তবুও কি শুভ নেই? তুমি কেন শুধু শুধু অমঙ্গল দেখে কষ্ট পাচ্ছ?” আমি জানি যারা এ কথা বলে, তারা নিজেরাও তা বিশ্বাস করে না। দ্বিধায় তাদের বলার ভঙ্গীতে আর শব্দের উচ্চারণে পার্থক্য টানে। আমি চুপ করে থাকি। আসলে তুমি এখন নেই। এখন তুমি একটা অভ্যাস। এই মহান বিশ্বে আমরা আমাদের ক্ষুদ্রপ্রাণের জন্য বিস্মিত হই না, তবুও গাই... 'আকাশ ভরা সূর্য তারা'... অভ্যাস। আমাদের কারোর একলা চলার জো নেই আজ, দলে নাম না লেখালেও হাজিরা দিতেই হয়, তবুও গাই... 'যদি তোর ডাক শুনে'... অভ্যাস। আমাদের সবটাই অভ্যাস এখন। ভাব নেই। রক্তে জোর নেই, সুগার-কোলেস্টরল আছে। মাথায় সংশয়, সন্দেহ, ভড়ং-এর অভ্যাস।
আসলে আমরা ভালো নেই। তোমার ভারত পরাধীন ছিল। তুমি জন্মেছিলে, মারাও গিয়েছিলে একটা পরাধীন দেশে। যদিও তোমায় পরাধীন করবে কার সাধ্যি। তুমি সে স্বাধীনতা খুঁজেছিলে চিত্তের নানা ভাবে, শিক্ষাদানের নানা চিন্তায়, নানা সৃষ্টিতে। আমরা জন্মেছি মরছি - স্বাধীন দেশে। আমাদের নতুন কোনো স্বপ্ন দেখার সাহস নেই আর। কারণ আমাদের হাত-পা বাঁধা আমাদেরই মোহভঙ্গের অভিজ্ঞতায়। আমরা স্বাধীন দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তা আমরা প্রতিদিন দেখছি। একটু একটু করে বুঝতে শিখছি, আসলে আমরা সৎ হতে শিখিনি। আমরা নকল করতে জানি, ভান করতে জানি, হয়ে উঠতে জানি না। আমাদের সমস্ত কিছুর সার্থকতার সীলমোহর আসে পাশ্চাত্য থেকে এখনও। আমরা যদ্দিন না পুরোপুরি পাশ্চাত্য হয়ে উঠছি তদ্দিন আমাদের মুক্তি নেই – এ আমাদের সার্বজনীন বিশ্বাস। তোমার আশ্রম ক্রমে টুরিস্ট স্পট হয়ে উঠছে। তোমার ভাবকে প্রতিস্থাপিত করছে আমাদের মধ্যমেধার গৌরব - যার মূল কথাটা হল – আমরা অত্যন্ত বাস্তববাদী হয়ে উঠেছি।
তুমি ভাব। আমরা বাস্তব। তুমি আকাশ। আমরা মাটি। তুমি কল্পনা। আমরা বস্তু।
অর্থাৎ আমাদের কোথাও মিল নেই। হতে পারে না। হবে না। আমাদের আবেগ আছে, সত্যানুভবের প্রতিশ্রুতি নেই তোমার মহিমাগানে। আসলে তুমি কোনোদিন আমাদের কাছের ছিলে না। তোমার গায়ের যে জ্যোতি, সেই জ্যোতিতে আমাদের স্বার্থসিদ্ধি হয়েছে খানিক। সেদিন তোমার নিন্দা ছিল প্রকাশ্যে। আজ তোমার কপট বন্দনায় তোমায় অস্বীকার করার কৌশল। কিছু মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যদি তুমি সত্য হয়ে থাকো, সেটুকুই সত্য। বাকিটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এই মিথ্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা কথাই জোর করে বলা যায় – সব মিথ্যা। মিথ্যাকে যদি মিথ্যা বলে না স্বীকার করি তবে তোমার সাথে বেইমানি করা হবে। আমাদের মিথ্যা শব্দের মালা গাঁথা, আমাদের আড়ম্বর – এইসবের মধ্যে একটাই কথা চাপা পড়ে থাকে, আমরা হয়ে উঠিনি। আমাদের শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য – সব কিছুই বড় মধ্যমেধার। যেন বাস্তব হয়ে ওঠাই লক্ষ্য – সত্য হয়ে ওঠা না। যা কিছু লাভের, যা কিছু গণনার, যা কিছু আয়তনের – তাই যেন সত্য। যা কিছু হয়ে ওঠার, যা কিছু সৃষ্টিশীলতার, যা কিছু মরমী – তা ব্রাত্য আজ। তুমি যে দরদিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলে, বলেছিলে “আসন হয়নি পাতা, মালা হয়নি গাঁথা... লজ্জাতে হেঁট মাথা... ও মোর দরদিয়া...” সেই দরদিয়াকে নির্বাসন দিয়েছি আজ। আজ আমাদের সমাজে পঞ্চক, মহাপঞ্চক সব আছে, শুধু ঠাকুর্দা নেই, সেই ফকির নেই। কারণ তারা লাভের হিসাব দেখাতে পারেনি কবি। আমি জানি, যেখানে ফকির নেই, যেখানে ঠাকুর্দা নেই – সেখানে তুমি কোনোদিন থাকতে পারো না। সেখানে যে থাকে সে তোমার ভাষায় – স্যার রবীন্দ্রনাথ, যে নোবেল পেয়েছে, যে বক্তৃতা দিয়েছে, যে হাজার একটা নির্বোধ স্বদেশবাসীর ফরমায়েশ খেটেছে, কিন্তু সে তুমি নও, যে তুমি কালান্তরের দ্রষ্টা, যে তুমি বাউল, যে তুমি মহামানবের আসার আশায় তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে।
আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। আমাদের পেটের মধ্যে গজগজ করা কাগজের টুকরোগুলোতে তোমার রচনাবলীর পাতাও আছে। লজ্জা পেও না। আমরা কবি নই। আমরা ডানা ছাঁটা, ডানা কাটা বাস্তববাদী। আকাশটাকে আমরা নিতান্ত অপচয় বলেই জানি। সে তোমারই থাক। আমাদের থাক লোভ। আরো লোভ। আরো ভয়। আরো শঙ্কা। বাস্তব আমাদের কারাগার, সম্ভাবনা নয়, তাই বাস্তববাদিতার গর্ব নিয়েই বাঁচা। তোমার থাক বৈরাগ্যের মাধুর্য। স্বপূর্ণতার আনন্দ। আকাশের অবকাশ। সৃষ্টির যন্ত্রণা। আমরা প্রণাম করি। দূর থেকে।