আজ সকালে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। নানা দুর্যোগের ভিতর দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক, পারিবারিক ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। আমরা কথা বলছিলাম, সূত্র খুঁজছিলাম বেরিয়ে আসার। সমস্যাগুলো থেকে নয়। সমস্যাজাত উদ্বিগ্নতা থেকে।
ও চলে যাওয়ার পর একটা শব্দ খুব গভীরভাবে চেপে বসল মাথায় - বিষাদ। ডিপ্রেশানের কাছাকাছি প্রতিশব্দ। বাংলাতে 'অবসাদ' আর 'বিষাদ' নিজেদের মধ্যে পরিবর্তনীয় শব্দ। মন খারাপ আর বিষাদ এক নয় যদিও। তবু বিষাদ যেন দীর্ঘস্থায়ী আত্ম-বিকল অবস্থা। এর কারণ যদি মস্তিস্কের গঠনগত ত্রুটি, জেনেটিক ইত্যাদি কারণ সংক্রান্ত হয়ে থাকে তবে তা আলাদা কথা। সেখানে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। আমার নিজের ক্ষেত্রে সেরকম কিছু বুঝলে অবশ্যই যেমন চিকিৎসার শরণাপন্ন হব, সবার ক্ষেত্রে তাই পরামর্শ দেব।
কিন্তু যদি মনে হয় এটা সেই জাতীয় কিছু নয়, অর্থাৎ ততটা গভীর নয়, তখন? আমার মনে আছে, জীবনের একটা খুব ঘন অন্ধকার সময়ে জ্যোতিষীর দরজাতে দাঁড়াতেও দ্বিধাবোধ করিনি। আজ সেই মূর্খামির কথা স্মরণ করতেও লজ্জা বোধ করছি না, অথবা বলতেও না। কারণ সেদিন যদি সমস্ত আশা-ভরসা নিয়ে জ্যোতিষীর দরজায় না দাঁড়াতাম তবে তার অন্তঃসারশূন্যতা সম্বন্ধে আজ এত নিঃসংশয়ও হতে পারতাম না। অবশেষে শেষ আশ্রয় - প্রজ্ঞা।
আমার সেই সব চেনা-অচেনা বন্ধুদের সাথে কথা বলব বলে এ লেখা লিখতে বসলাম, যারা একটা দীর্ঘস্থায়ী মন খারাপের শিকার হয়ে রয়েছেন, অথচ কি ভাবে সে থেকে বেরোবেন বুঝে উঠে পারছেন না। আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে যদি একজন মানুষেরও অন্তত আংশিক সুরাহা হয় তবে নিজেকে আর আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াসকে ধন্য মনে করব।
আমাদের মন অভিব্যক্তির অনেকটা পথ হাঁটলেও, তার মূলগত কিছু দিক খুব একটা বদলায়নি। প্রথমতঃ, তার সুখান্বেষণের প্রবৃত্তি। সুখ আর ভয়ের খুব একটা নিবিড় সংযোগ আছে। যার সাথে জড়িয়ে শোক তথা মন খারাপের বীজ।
সুখের ধারা বদলেছে, চরিত্র বদলেছে, কিন্তু সুখের প্রতি আকর্ষণের প্রাথমিক তাগিদ কি বদলিয়েছে? না। আর সে কখনো বদলাবার নয়ও। সুখ বলতে কি বুঝি? তাৎক্ষণিক আরাম থেকে বৌদ্ধিক নিশ্চয়তার বোধকে স্থায়ী করার একটা প্রবৃত্তি - এগুলো সব মিলিত হয়ে একটা জটিল প্রেরণা-শক্তি, যাকে অন্যভাবে বলতে পারি বেঁচে থাকার উৎসাহ। উৎসাহ, উদ্যম এরা জীবনের প্রথম সুখ। অথবা বলা যায় বাকি সব সুখের ভিত্তি। তাই এই আত্ম-নির্ভর সুখের অপর একটি নাম হল - আনন্দ। আমি কোনো একটা চেষ্টায় হয় তো ভীষণ রকম ব্যর্থ হলাম, কিন্তু যদি উদ্যম বা উৎসাহ হারিয়ে না ফেলি, তবে সে হারকে পায়ে পিষে আবার এগোতে পারব। সে হার বাধা হবে না, হবে সিঁড়ির একটা ধাপ মাত্র।
আমরা যারা বিবেকানন্দ সাহিত্য পড়েছি, তারা পড়েছি, এক জায়গায় উনি বলছেন, গীতা পড়া হয়ে গেলে, ব্যাধগীতাটা একবার পড়ে দেখার জন্য। কলেজ জীবনে পড়েছিলাম ব্যাধগীতা। অসামান্য একটা গ্রন্থ। আজও এতদিন পর নানান দুর্যোগে সে প্রাচীন স্বচ্ছজ্ঞান প্রস্রবণের কাছে দাঁড়াই। কিছু না কিছু হাতে আসেই। তার কয়েকটা শ্লোকের বাংলা এখানে দিই আগে, পরে আলোচনায় আসছি।
১) প্রজ্ঞা দ্বারা মানসিক দুঃখ আর ওষুধ দ্বারা শারীরিক দুঃখকে নিবৃত্ত করবে।
২) শোক করতে থাকলে কিছুই হয় না, শুধুমাত্র পরিতাপ হয়... মূর্খেরা অসন্তুষ্ট থাকে, জ্ঞানী সর্বদা সন্তোষ লাভ করেন। (তুলনীয়, বিখ্যাত দার্শনিক জে কৃষ্ণমূর্তির কথা - you need enough intelligence to be simple)
৩) অসন্তুষ্ট ব্যক্তির কখনো আত্মতুষ্টি ও পরমসুখ নাই।
৪) বিষাদে মনোনিবেশ করা উচিৎ নয়। কারণ, বিষাদ উত্তম বিষ যা অজ্ঞানী স্বল্পবুদ্ধিকে ক্রদ্ধ সর্পের ন্যায় মেরে ফেলে।
৫) আত্মবমাননা প্রাপ্ত হয়ে কোনও মঙ্গল লাভ হয় না।
একজন মাংস বিক্রেতা ব্যাধের কাছে এক সাধনার অহংকারে অহংমগ্ন যুবক সন্ন্যাসীর জ্ঞানপ্রাপ্তির উপাখ্যান নিয়ে এই ব্যাধগীতা। যে সন্ন্যাসীকে ব্যাধের কাছে আসার পথ দেখিয়েছিলেন এক গৃহবধূ যিনি একান্তভাবে তার অসুস্থ স্বামীর সেবাপরায়ণা ছিলেন। যে গৃহবধূর কাছে এই তরুণ দাম্ভিক সন্ন্যাসীর অহং প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয়।
তবে মূল কথাটা হল বুকের মধ্যে শূন্যতাবোধের একটা কারণ নিশ্চই আছে। তাকে খুঁজে বার করতে হবে। এর প্রথম হাতটা পাওয়া যায় কোনো সহৃদয় বন্ধুর কাছ থেকে। অন্তত একজনের কাছে অভিনয় না করে নিজেকে পুরোপুরি খুলে ফেলতে হবে। প্রথম প্রথম খুব সংকোচ হবে। জড়তা আসবে। কোথা থেকে শুরু করব বুঝে ওঠা যাবে না। সে যদি কিছু মনে করে... সে যদি কাউকে বলে দেয়... সে যদি বিরক্ত হয়... ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কুন্ঠা আসবে। আসুক, তবু বলতে হবে। আমি বিশ্বাস করি না আমাদের চারপাশটা এতটাও খারাপ হয়ে গেছে যে সেরকম আন্তরিকভাবে হাত বাড়ালে একটাও সাহায্যের হাত আসবে না। আসলে নেগেটিভ প্রচার, আলোচনা ইত্যাদি এত বেশি চারদিকে হয়ে আসছে যে বিশ্বাসটা টাল খেয়ে বসে আছে অনেক গভীরে। সেটাকে ছাড়তে হবে। নিজের চারপাশটাকে নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, শুধু নিজেকে নিয়েই এত ব্যস্ত ছিলাম যে চারপাশটাকে 'জানিই তো সব' এর লেবেলে ঢেকে পাশ কাটিয়ে গেছি। কোনোদিন নিজের হাতে নেড়েচেড়ে দেখিনি।
সে যা হোক, নিজের কথা নিজেকে বলতে হবে, না আড়াল করে। বলতে হবে, আমার সকালে উঠতে ইচ্ছা করে না, মনটাকে শান্ত বা রিল্যাক্সড রাখতে ভুলে যাচ্ছি, নিজেকে কি এক অজানা অপরাধবোধে রাতদিন অঙ্কুশবিদ্ধ করে চলেছি। এদিকে ঈর্ষা, তো ওদিকে পরশ্রীকাতরতার ছোবলে ছোবলে জেরবার। সারাদিন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, বিজ্ঞাপন আর মিডিয়ার ভিড়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছিনা। দিন দিন আমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি। এ আমি সে আমি নই, যাকে আয়নায় দেখি। অবশ্য আমার এই বিষাদও এখন বাজারি বস্তু। তাকে নিয়েও নানান ফাঁদ। সবাই নাকি আমার ভালো করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, কিন্তু কি হচ্ছে, আমি নিজের মধ্যেই কোথায় একটা হারিয়েই যাচ্ছি, হারিয়েই যাচ্ছি... বুকের মধ্যে শূন্যতার অন্ধকার। সারাটা মন অবসন্ন, অসাড়। শরীর জড়ের মত অচেতন।
কথা বলতে শুরু করুন। জোর করে, নিজের বিষাদকে আড়াল রাখার কোনো প্রয়োজন নেই আবার মন খারাপকে প্রশ্রয় দিয়ে বাড়িয়ে তোলারও কোনো মানে হয় না। এই 'প্রশ্রয়' শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই ক্ষেত্রে। প্রথম প্রথম কোনো একটা ন্যায্য কারণে মন খারাপ হওয়ার পর যখন মন দেখে যে সে অতিরিক্ত গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে, তখন সে একটা পেন হারানোর মন খারাপকেও স্বজন হারানোর মন খারাপের তুল্য আসন দিয়ে শোকের উৎসব তৈরি করে নেয় নিজের মধ্যে। প্রতি মুহুর্তে অন্যের কাছ থেকে আশ্বাস আর সান্ত্বনা চাওয়ার অভ্যাসটা একটা ব্যাধির মত হয়ে দাঁড়ায়। শেষে সত্যিকারেরই একদিন আসে যেদিন প্রশ্রয় দেওয়ার আর সীমা-পরিসীমা থাকে না, মানুষটা গভীর বিষাদ সাগরে নিমজ্জমান হয়। তলিয়ে যায়।
এই আসল-নকলের ব্যালেন্সটা শিখিয়ে দেয় 'প্রজ্ঞা'। ঠিক কোনটা স্ব-আরোপিত আর কোনটা সত্যিকারের দুঃখ, তাকে চিনিয়ে দেয় প্রজ্ঞা - 'আপনি যে দুখ ডেকে আনি সে যে জ্বালায় বজ্রানলে-- / অঙ্গার ক'রে রেখে যায়, সেথা কোনো ফল নাহি ফলে। / বন্ধু কোনো ফল নাহি ফলে
তুমি যাহা দাও সে-যে দুঃখের দান / শ্রাবণধারায় বেদনার রসে সার্থক করে প্রাণ || / বন্ধু সার্থক করে প্রাণ'
সে যাই হোক, নিজের ভিতর সেই উৎসাহ, উদ্যমের ভিত যে আনন্দ তাকে জাগিয়ে রাখতে হবে। খুঁজে পেতে হবে। পেতেই হবে। এমন একটা কাজ খুঁজে নিতে হবে যাতে সে পথ হতে পারে, কিছুটা হেঁটে আসার। কিছুটা সময় অবশ্যই শারীরিক ব্যায়ামে দিতে হবে, নিদেন পক্ষে হাঁটা আধঘন্টা প্রতিদিন, যখন সময় হোক। শুধুই হাঁটার জন্য হাঁটা, অন্য কারণে নয়। এমনকি 'যাই ফেরার পথে বাজারটা সেরে আসি' - এমন মানসিকতা থেকেও যত দূরে থাকা যায় তত মঙ্গল। হাঁটলে মন ভালো হয় - এ নিজের ক্ষেত্রে দেখেছি। আর জীবনে স্বল্প কিছু বন্ধু থাকুক, যাদের সাথে আহ্নিকগতি আর বার্ষিকগতি - উভয় গতিতেই সাথে থাকা যায়, বিনা অভিনয়ে। সেটা বাস্তব জীবনে হওয়াই বাঞ্ছনীয়, ভার্চুয়াল জগতে না। শ্রী অরবিন্দ বলতেন - depress the depression.
আর একটা কথা বলে শেষ করি; কোনো কিছু, কোনো মুহুর্ত, কোনো মানুষই পার্ফেক্ট না, এমন কি আমিও না - এই নেগেটিভ সূত্রটা, আর সব কিছুই, সব মুহুর্তই আর সব মানুষই পরিবর্তনশীল, এমনকি আমিও - এই পজিটিভ সূত্রটা... এই দুই সূত্র শান্তিতে উড়তে সাহায্য করে, অন্তত আমাকে তো করে। সক্কলে ভালো থাকবেন, সুখী হওয়ার দরকার নেই, পথিক হতে পারলেই হল।