Skip to main content

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার কিছুতেই অবতার মানবেন না। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করছেন, কিন্তু কদাপি মানুষ ভগবান হতে পারে তা স্বীকার করবেন না। ডাক্তারের মত, শ্রীরামকৃষ্ণ - As man I have the greatest regard for him.
        মহেন্দ্রলালবাবু ভক্ত হয়ে আসেননি। তবু শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে কথা বলতে গিয়ে সময়ের হিসাব থাকে না। তর্ক করেন। রাত্তিরে শুতে গিয়ে ঝড় হলে চিন্তা করেন, "মানুষটা জানলাগুলো লাগিয়েছে তো?" তবু তর্ক চলে নানান খাতে। দুর্বোধ্য ইংরাজি ভাষা শ্রীরামকৃষ্ণকে বাংলায় তর্জমা করে বুঝিয়ে দেন আশেপাশের কেউ। ডাক্তারের কথা শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও হাসেন, কখনও উত্তর করেন। উত্তর শুনে মহেন্দ্রলাল সরকার তাজ্জব হন। এ মুখ্যু মানুষ এসব কথা জানলে কি করে? শেষে বলে বসেন, "শুধু বই পড়লে তোমার এত জ্ঞান হত না"। ফের তর্ক শুরু হয়। রামকৃষ্ণকে বলেন, "তুমি অহংকারী, অমন লোকেদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে দাও কেন?"
        শ্রীরামকৃষ্ণ হাসেন। কখনও উত্তর করেন। তবু কেউ কাউকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারেন না। কথাটা কি তবে?
        কথাটা একটাই, একটা অমোঘ ভালোবাসা। মানুষের যুক্তি-বিচার-বুদ্ধি সব আছে। তার পাশাপাশি আছে তার অন্তরে গভীর ভালোবাসার তৃষ্ণা। শুধু পাওয়ার না, ভালোবাসা দেওয়ারও। শ্রীরামকৃষ্ণের একটি তত্ত্বে তাই তার মন মজল - "মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ।"
        তিনি বুঝলেন, এই কথাটি নতুন না। কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গিটি খুব নতুন। যে মানুষ যত শুদ্ধ তার ভিতরে নিঃস্বার্থতা তত মূর্ত। আর নিঃস্বার্থ, নির্ভীক হয়ে বাঁচার যে তৃপ্তি তা মহেন্দ্রলাল সরকার জানেন। মাষ্টারমশায়, মানে কথামৃতকার বলছেন, জলে কিম্বা কাঁচে যেমন সূর্যের আলোর বেশি প্রকাশ তেমনই মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ।
মহেন্দ্রলাল সরকার শুধু না, এ তত্ত্বে স্তম্ভিত হয়েছেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর পর্যন্ত। বিদ্যাসাগর বলছেন, "তবে কি তিনি কাউকে বেশি শক্তি, কাউকে কম শক্তি দিয়েছেন?" শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো? তোমার দয়া, তোমার বিদ্যা আছে - অন্যের চেয়ে, তাই তোমাকে লোকে মানে, দেখতে আসে।"
বিদ্যাসাগর চমকালেন। তাই তো, বিদ্যালয়েও দেখেছেন, সব ছাত্র সমান নয়, সব শিক্ষক সমান নয়, সব কর্মী সমান নয়। সমাজেও আজীবন তাই দেখে আসছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ আরো বলছেন, সব জলই জল, কিন্তু কোনো জল খাওয়া যায়, কোনো জল পূজা পার্বণে লাগে, কোনো জলে শুধুই শৌচকার্য চলে।
        "মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ" মানে কি তবে? মানে আস্তিকতা নাস্তিকতার পারের কথা। যে মানুষ নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবায় আত্মনিবেদন করল সারাটা জীবন, আমরা তাকে বলছি, মানুষ নয়, যেন ভগবান!
        যদি বিদ্যাসাগর শুধু পণ্ডিত হতেন তবে কি শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেখতে যেতেন? নিশ্চই নয়। সেরকম পণ্ডিতের তো অভাব ছিল না তখন, আবার এও নয় যে বিদ্যাসাগর প্রবল ঈশ্বরভক্ত হিসাবে খ্যাত। তাও নয় মোটেই। কিন্তু তিনি তো শুধু বিদ্যাসাগর নন, দয়ার সাগরও। সেই আকর্ষণ রামকৃষ্ণের। 'বজ্জাৎ আমি, ছোটো আমি, কাঁচা আমি' যেই ত্যাগ করেছে, শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সেই সাচ্চা মানুষ। সাচ্চা মানুষে তাঁর প্রকাশ। বেশি প্রকাশ। যেন বাড়ির মধ্যে তাজমহল। যেতেই হবে তার কাছে। সে আসবে কেন? তিনি নিজে কি এমন? "তোমার শরীরের লোমগাছির সমানও তো নই, এমনকি ছোটো লোমের সমানটাও নই"। এই ওর নিজের সম্বন্ধে নিজের উক্তি। তবে তিনি যে এর বাড়ি, ওর বাড়ি অনাহূত হয়েও যাবেন তাতে আর আশ্চর্যকথা কি?

        কিন্তু কথা হল, আমি হঠাৎ এ প্রসঙ্গ নিয়ে পড়লাম কেন? কারণ ইদানীং চারদিকের গুরুদের দেখে। ঐশ্বর্য আর আধ্যাত্মিক বোধ কোনোদিনই পাশাপাশি আসেনি আমাদের সংস্কৃতিতে। একজন পরম আত্মনিবেদিত বিজ্ঞানী, শিল্পী যেই হোন না কেন, বিলাসিতার সাথে আপোষহীন সব দেশে সব কালেই তারা। গ্ল্যামার বলতে যা বোঝায় তার থেকে শতহস্ত দূরেই থেকেছেন। ভারতবর্ষ বলেছিল বহুকাল আগে - সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম। অর্থাৎ তার গভীরতম উপলব্ধিকে সে - সত্য-জ্ঞান-অনন্তের মধ্যে দেখেছিল। এক একজন মহাত্মার চরিত্রেও এই দিকটাই প্রধান ছিল। নিঃস্বার্থ লোককল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। সমাজের তাদের কাছে ঋণের শেষ নেই।
        কিন্তু আজ এটা কি হচ্ছে? এক একজন ভোগ বিলাসের শিখরে থেকে নিজেকে ঈশ্বরের পথ প্রদর্শক বলে দাবী করছেন, আর হাজার হাজার লোক তাকে অনুসরণ করছে? স্বার্থহীনতা, বৃহৎ কল্যাণে উৎসর্গীকৃত প্রাণের বিন্দুমাত্র আভাস নেই যেখানে, শুধু বাকচাতুরী, গ্ল্যামারের চোখ ধাঁধানো আলো, অলৌকিক গল্প সর্বস্বতাতেই সব মিলিয়ে গেল? কোনো আদর্শের খোঁজ নেই? সে আদর্শ যথাযথ প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা প্রবর্তকের চরিত্রে দেখার খোঁজ নেই। যে বোধকে, জ্ঞানকে, নিঃস্বার্থতাকে জীবনের চরম পরিণতি প্রচার করছে তার এত বস্তুনির্ভর জীবন কেন হবে? এত প্রাইভেসির কি দরকার? যীশু থেকে রামকৃষ্ণ অবধি কারোরই তো আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগত না, VIP খাতির তো কেউ পেতেন না তাদের দরবারে? মহাপ্রভুর রাজদর্শন এড়িয়ে চলার গল্প তো অতি প্রাচীন নয়? তবে আজ এ কি মোহের পথে চলেছি। অন্ধকে অন্ধ পথ দেখানোর চেষ্টার কথা উপনিষদ বলেছেন, সাবধান করেছেন। কিন্তু সে সাবধান বাণী উপেক্ষিতই থেকে গেল। মানছি রামকৃষ্ণ, মহাপ্রভু, রমণ মহর্ষির মত মানুষ মুড়িমুড়কির মত আসে না। তা বলে যদি রবিশঙ্করের সেতারের ছড়ের সাথে পাড়ার হাবুদার সেতার গুলিয়ে ফেলি সে অপমান তো আমার বোধের! তারা না থাকুন, সে আদর্শটুকু তো মারা যায়নি। না হয় শূন্যই থাক সে আসন। তা বলে যাকে তাকে বসিয়ে মনের দুর্বলতার তোষণ করব? তাদের দেখানো রাজপথের মত উজ্ব্বল রাস্তায় হাঁটব না? বোধ-জ্ঞান-শান্তির রাস্তার চেয়ে গ্ল্যামার-শক্তি-প্রতিপত্তির দাসত্ব করব? কিছুতেই হতে পারে না। কারণ রামকৃষ্ণের সে অমোঘ দর্শন - "মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ।" কার বেশি প্রকাশ? মানুষের মহত্বের। তার অভাব চিকিৎসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, রাজনীতি, শিল্পী কোনো মহলেই চিরকালের অভাব ঘটবে না। ওইটুকুই তো আমাদের চলার গর্ব, পাথেয়!