Skip to main content
শম্ভু মিত্র

মন্দির থেকে ফিরে আসার পর মন্দিরের ধূপধুনোর গন্ধ কিছুটা গায়ের সাথে লেগে আসে। সময়ের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিলেও তাই হয়। সময়ের কিছু অধঃক্ষেপ জমে মনে। সে কার গুণে বলতে পারি না, সময়ের - না মনের; নাকি দুজনেরই মিলিত কোনো রহস্যে।
'শম্ভু মিত্র' নামটাও সেরকমই সময়ের রেখে যাওয়া এক টুকরো খণ্ড মনের অবচেতনে। আমরা যে সময়ে বড় হচ্ছি, সে সময়ে শম্ভু মিত্র'র নাটক দেখার সৌভাগ্য আর নেই। বাবা-কাকাদের মুখে নাম শুনেছি। জ্ঞানীগুণী মানুষজন খুব শ্রদ্ধার সাথে ওনার নাম নেন দেখেছি। পেপারে মাঝে মাঝে ছবিও দেখেছি। আর শুনেছি তিনি অজ্ঞাতবাসে। তিনি আর কাজ করবেন না। কৌতুহল হয়েছে, ক্ষোভ হয়নি। কারণ যাঁর কাজ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই তাঁর কাজ না দেখতে পারার কোনো আফসোস তৈরি হয়নি। তারও আগে থেকে শুনেছি সুচিত্রা সেনও অজ্ঞাতবাসে বা নির্বাসনে, তাই আর কৌতুহলেও বোধহয় কোনো নতুনত্ব ছিল না।শুধু মাঝে মাঝে মনে হত, কেন?
ওনাকে প্রথম দেখা দূরদর্শনের একটা নাটকে – ‘অমল ও দইওয়ালা’তে। তাতে তিনি তেমনভাবে দাগ কাটেননি, আর কাটবেনই বা কেন, সমস্ত মন জুড়ে তো অমল! আহা বেচারা অমল। আর সে ফকিরবেশি শম্ভু মিত্র'কে ভালো লাগার একটাই কারণ, অন্তত সে মানুষটা আর যা হোক অমলের সাথে ঠিক করে কথা বলেছিল। অমলের বন্ধু হতে পেরেছিল। তাই তাকে ভালো লেগেছিল। কিন্তু তখন সে শম্ভু মিত্র কেন হবে? সে তো ফকির! সে এমন দেশে যাওয়ার কথা বলে, যে দেশে গেলে নাকি সবই হাল্কা হয়ে যায়, কোনো কিছুরই আর ভার লাগে না। আর সে দেশে যাওয়ার পথ? সে একটা রাস্তা আছে, সে পথ নিজের ভিতর দিয়ে যেতে হয়।
হায় রে আমার নির্বোধ মন! এমন অনায়াসে, এমন বাচনভঙ্গীতে যে মানুষটা, এমনধারার কথাগুলো এত গভীরে গেঁথে দিতে পারে কিম্বা পৌঁছে দিতে পারে – সে কোন জগতের মনের অধিকারী?
বুঝিনি। বুঝেছিলুম অনেক পরে। হঠাৎ শুনলুম তিনি নির্বাসন থেকে বেরুবেন। তখন আমরা কলেজে পড়ি। বেরুলেন। দূরদর্শন একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিল। তিনটে রবিবার পর পর দেখানো হল। মনে কি একটা ঘোর তৈরি হল। এঁর গায়ে, পোশাকে, চলনে বলনে চিন্তনে কেমন যেন একটা চেনা লোকের গন্ধ না?! হ্যাঁ তো! কে সে? রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্রনাথ, আমার চোরাবালি তখন, আমার আমাজনের জঙ্গল তখন, আমার স্কুল থেকে ফেরা বাড়ির পিছনে নির্জন পুকুরপাড় তখন। এ যে সেই ভাষায় কথা বলে!
সেই সাক্ষাৎকারের কিছু কথা মনে গেঁথে গেল চিরকালের জন্য। এমন নম্রভাবে জীবনের গভীর কিছু সত্য এমনভাবেও বলা যায়!
বললেন, 'দেখো জগতটা গোল। তুমি যখন সোজা দাঁড়িয়ে ভাবছ নিজেকে পৃথিবীর উপরে, ঠিক সেই সময় তুমি যদি পৃথিবীর বাইরে গিয়ে নিজেকে দেখতে পারো, দেখবে তুমি কিছুটা হেলে দাঁড়িয়ে আছো কারণ পৃথিবীটা তো গোল। তাই ওই সময়ে ওইটাই সাম্যাবস্থা। সাম্যাবস্থার কিছু absolute হয় না।'
বললেন, 'মানুষ সৎ হবে। হবে কারণ সেটা তার কর্তব্য। অথচ আমরা কেমন জানো তো? ওই যে প্রভুর কুকুর, প্রভু বলটা ছুঁড়ে দিলেন, অমনি কুকুর গিয়ে দৌড়ে নিয়ে এলো, আর এসেই প্রভুর মুখের দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়তে লাগল – অর্থাৎ আমায় কিছু পুরস্কার দাও এবার! আমরাও ঠিক তেমন।'
মন আটকালো শম্ভু মিত্রে। রেডিওতে পনেরো দিন ধরে সকাল ন'টা কি দশটা নাগাদ বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তিরা ওনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন তার পরপরই। প্রায় প্রতিটা গিলতে লাগলাম গোগ্রাসে। বেশ কিছু মজার ঘটনাও ঘটেছিল সেই সাক্ষাৎকারগুলোতে। একবার এক প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী (মহিলা) তাঁকে আবৃতির যে একটা স্থির পন্থা আছে মানাবেনই মানাবেন, আর উনি কিছুতেই স্বীকার করবেন না। শম্ভু মিত্র'র বক্তব্য হল, 'কোনো একটা কবিতা পড়ে আমার ভালো লেগেছে, মনে দাগ কেটেছে, আমি আমার সেই ভালোলাগাটা সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই, এই তো? এই জন্যেই তো কবিতা বলা। তো তাতে নাটকীয়তা থাকবে, কি না থাকবে, অথবা তা কাটাকাটাভাবে বলতে হবে, সেটা নির্ভর করছে কবিতাটার উপর আর যিনি বলবেন তার মানসিক গঠন, কণ্ঠের প্রকার ইত্যাদির উপর। এর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম থাকবে কেন?'
কিন্তু সেই শিল্পী তো মানতে রাজীই নন, 'তা হলে তো কবিতা শেখানোই যাবে না' ইত্যাদি মতান্তর হওয়াতে সেই শিল্পী রেগেমেগে উঠে পড়েন। রেডিও'র ধার্য সময়ের আগেই অনুষ্ঠান শেষ হল, অগত্যা কর্মকর্তারা সুচিত্রা মিত্র'র গান চালিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণে লেগে পড়েন।
পরবর্তীকালে যখন ওনাকে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংলাপের অসুবিধা নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় (অনেকের মতে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংলাপগুলো মঞ্চে উপস্থাপনার জন্য যথাযথ নয়।), উনি অদ্ভুত একটা কথা বলেন। বলেন, 'রবীন্দ্রনাথের সংলাপ বলতে গেলে গলাটাকে নগ্ন করতে হয়। না হলে সেগুলো বড্ড কৃত্রিম শোনায়।' এই কথাটা বুঝতে আজও চেষ্টা করছি।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রথম শুনলাম ওর কণ্ঠে – ‘উদাসীন’। আমার কাছে একটা ধ্রুবতারা হয়ে গেল। কি সাহিত্যবোধে, কি জীবনদর্শনে। তার আগে বহু মানুষের গলায় বহু কবিতা শুনেছি। মনে হয়েছে, বাঃ সুন্দর আবৃতি করলেন তো! কিন্তু উনি যখন বললেন, সেটা তো আর শুধু কবিতা বলা হল না, কবিতাটা কোনো অতিরিক্ত অলঙ্কার ছাড়াই সম্পূর্ণ আটপৌরে বেশে আমার মধ্যে প্রবেশ করল। ‘পৃথিবী’ কবিতাটা অনেকের গলায় শুনেছি। মুগ্ধ হয়েছি। শম্ভু মিত্র'র গলায় যখন শুনলাম, কবিতাটার শ্বাস-প্রশ্বাস আমার গায়ে লাগতে লাগল। এত জীবন্ত! তবে এও দেখেছি, অনেক বাচিক শিল্পী ওনার কবিতা বলাটাকে একটু তাচ্ছিল্য করে দেখেন। কারণটা আজ বুঝি, চেষ্টা করে গলা, ভঙ্গী আয়ত্ত কিছুটা করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও ওই বোধের গভীরতায় কি আসা যায়? যে বিশ্বাসে ওই স্বরক্ষেপণ হয়, তা কি শুধু অভ্যেস? অগত্যা চালাও নিন্দা!
একবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি ফিরে ফিরে রবীন্দ্রনাথের কাছে আসেন কেন? কি অসামান্য উত্তর দিলেন, 'যাঁর চিন্তা যে কোনো বিষয়ে আমার থেকে শতগুণ এগিয়ে তাঁর কাছে ফিরে যাব না?' আসলে সত্যিই তো, উনি তো রবীন্দ্রনাথকে চিন্তা করতেন না, রবীন্দ্রনাথে বাস করতেন।
বারবার বলতেন, মনে করাতেন, 'শিল্পীর প্রথম দায়িত্বই হল তাকে সৎ হতে হবে। নিজের সাথে, সমাজের সাথে। তবেই সে যা অভিনয় করবে তা সত্য হয়ে উঠবে। যা বলবে, তা বিশ্বাসের সাথে বলতে হবে। অভিনয়টাকেও সৎ করতে হয়।' বলতেন, 'একটা গান কেমন হবে তা যেমন আমি নেচে দেখাতে পারি না, ঠিক তেমনই একটা নাটক কেমন হবে তা আমি গেয়ে দেখাতে পারি না, নাটক করেই দেখাতে হয়।'
একবার কোনো এক নাটকে ডাক্তারের চেম্বার দেখাতে হবে। তা নানা মুনি নানা মত। উনি নাকি একটা কাপড়ে লাল ক্রস এঁকে একটা টেবিল আর চেয়ার করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, 'লোকে ডাক্তারের চেম্বার কেমন হয় সেটা দেখতে নাটকটা দেখতে আসবে না, আসবে একটা গল্প দেখতে।' কি আত্মবিশ্বাস! বলেছিলেন, 'আমি যদি অভিনয় করতে না পারি স্টেজে পর্দা টানব, তাও না পারি টর্চ দেখিয়ে লোককে আসন দেখাব, তা-ও না পারি তো টিকিট বিক্রি করব – তবু নাটক ছাড়ব না।'

তবু কেন নির্বাসনে গিয়েছিলেন? বলতেন, 'দেখো, মানুষ জীবনে যখন খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়, তখন শুধু একটা কারণে তো নেয় না, অনেকগুলো কারণ থাকে।'
কিছু কারণ আমরা আজ অনেকেই জানি। সে কথা থাক। বড় অভিমান ছিল বলেই না অমন নিঃশব্দে চলে গেলেন, পণ করিয়ে গেলেন কাছের মানুষদেরকে, তাঁর দেহ দহনের আগে কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়। পায় নি। কোথাও তাঁর মরদেহ শুইয়ে সেই সরকারী-অসরকারী শোকজ্ঞাপন হয়নি।
আজ এই লেখাটা লিখতে বসে বুঝলাম মনের কত গভীরে সেই কণ্ঠ, সেই উপলব্ধ সত্যগুলো বাসা বেঁধে আছে, তাঁরই মত নিঃশব্দে। ‘উদাসীন’ কবিতাটার মতই-

"হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি,
     ছুটি নে কাহারো পিছুতে ।
মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই
                কিছুতে..."

[ওনার জন্মদিন (২২অগাস্ট ১৯১৫) উপলক্ষ্যে আমার অতিক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি]

[ছবিঃ ইন্টারনেট]