Skip to main content

সন্ধ্যাবেলা, ২৫ শে জানুয়ারী। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দু’হাতে দুটো ভারী ব্যাগ, নিজের সমস্ত জীবনীশক্তিটুকুকে এক করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। মুখে শ্রমের চিহ্ন আছে, বিষণ্ণতা নেই। গুণগুণ করে গাইছেন, “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে”। তাকে পাশ কাটিয়ে সাইকেলে আরেক মধ্যবয়সী অবাঙালী একজন “ম্যায় চরণ কি দাসী” গাইতে গাইতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। আরেকটু এগোলাম। মাইকে বাজছে ‘বন্দে মাতরম’, এ আর রহমানের সুর।
প্রতিটা টুকরো ছবি আমার ভারতবর্ষ। কোন বৌদ্ধিক ধারণা নয়, কোন ঐতিহাসিক স্মৃতির দলিল নয়, জীবন্ত প্রাণবন্ত ভারতবর্ষ। আরো প্রাচীনকালে উপনিষদ ঘোষণা করেছিলেন, সম্বোধন করেছিলেন, “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”... শোন জগৎবাসী, হে অমৃতের পুত্রগণ, তোমার অন্তরে শায়িত সেই পরমপুরুষকে না জানলে সবটাই ব্যর্থ। ভারতবর্ষ জগৎবাসীকে যে কথাটা শুনিয়েছিল, বা যুগে যুগে শুনিয়েছে সেটা এইভাবে মানবজীবনকে সার্থক করার সাধনার ডাক দিয়ে। আরো সঞ্চয়, আরোও সঞ্চয় – এ পথ কোনদিনই ভারতবর্ষে অন্তরাত্মার ভাষা হতে পারেনি। সে নিজের আত্মার মধ্যে জগতাত্মাকে অনুভব করবার প্রয়াস পেয়েছে, দেশের সাধনাকে জগৎ সাধনা করে দেখেছে। তাই মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে যে আদর্শ সারা জগৎ দেখল, মহাত্মা তাকে নিজে বললেন, “এ আদর্শ হিমালয়ের মত প্রাচীন।” তা ঠিক এ আদর্শ নিজের ভিতরে সবার সাথে যুক্ত হওয়ার সূত্রটাকে আবিস্কার করার আদর্শ তথা সাধনা। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মানুষ এক কোথায়? সেন্সাস রিপোর্টে? না, মৈত্রীতে।
প্রতিদিনের জীবন যাপনে মলিনতা দীনতা নেই একথা বলা হয়নি কখোনো। আছে। আকরিক থেকে সোনাকে পৃথক করাকে জ্ঞান বলা হয়েছে। আকরিককে শুধুমাত্র শিলা হিসাবে জানাকে অজ্ঞানতা বলা হয়েছে। আকরিকের থেকে সোনা বার করার পদ্ধতিকে বলা হয়েছে সাধনা। যদি বলি এটি কোন বিশেষ ধর্মমত তবে ভয়ঙ্কর মিথ্যে কথা বলা হয়। মানুষের বাইরে যেমন একটা বিজ্ঞান আছে, অর্থাৎ কিছু সূত্র আছে, তেমনই মানুষের নিজের সত্তার একটা সূত্র আছে, একটা বিশ্বজনীন নিয়ম আছে। সে নিয়ম হল – প্রকাশের তাগিদ, সব তুচ্ছতা দীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা। যা সে জন্মসূত্রে মানুষ পায়। যদি না পেত তবে অগ্রগতি, অভিব্যক্তি, উন্নতি শব্দগুলো নিতান্তই প্রহসন হত। মহত্ত্ব বস্তুটা সঠিক যে কি মানুষ জানে না। তার নানা রূপ কল্পনা করেছে যুগে যুগে। কখনো ঈশ্বর, কখোনো ধর্ম, কখোনো নীতি, কখনো বা মত (-ism) ইত্যাদি নানারূপে সে মহত্বর দিকে ইঙ্গিত করেছে। সে বারবার বলেছে আমি যা আমি তাতে সন্তুষ্ট নই। আমাকে এগোতে হবে। আরো বড় হতে হবে। আরো অর্থপূর্ণ হতে হবে। সার্থক শব্দটা অর্থকে স্বীকার করেই তৈরী হয়েছে। যার বিপরীত শব্দ নিরর্থক। 
তবে এ কোন অর্থ? মানুষের জীবনের কি তবে কোন নির্দিষ্ট অর্থ আছে? ‘নির্দিষ্ট’ শব্দটার সংকীর্ণ অর্থে নেই। কিন্তু ‘নির্দিষ্ট’ শব্দকে নির্দেশসূচক শব্দ বললে আছে। সে ক্রমশ আরো এগোতে চায়, উন্নত হতে চায়। মহত্বকে লাভ করা যায় না। দীনতার বিরুদ্ধে, ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করাকেই মহত্ত্ব বলে। তাই এক অর্থে খ্রীষ্ট থেকে মহাত্মা আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও চিরকালীন দৃষ্টিতে ব্যর্থ নয়। তাই মহাত্মার দেশমুক্তির পথ আজ বিশ্বের বহু অগ্রণী মানুষের আদর্শ, অন্যতম অবলম্বন।
আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রজা অর্থে যদি মানবতন্ত্রের দিকে তাকাই তবে বোঝা যায় এ গণশক্তির মূল উৎসটা কোথায়। সেই বিশ্বব্যাপী সঙ্গীত লহরীতে যোগ দেওয়ার জন্য তার চিত্ত আকুল। আমি মানি কি না মানি, আত্মত্যাগের যে আনন্দ, স্বার্থত্যাগের যে সার্থকতা, যে আনন্দ সে আনন্দই মানুষকে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও মহৎ কাজে সাহস জুগিয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও যোগাবে। মহৎ কাজ বলতে শুধু বড় কাজ বলতে চাইছি না। সংসারে যে মানুষটা উদয়-অস্ত পরিশ্রম করে একটা পরিবার প্রতিপালন করছেন। নীরবে নিজের দায়িত্বটুকু সমাধা করে, নিঃশব্দে বিদায় নিচ্ছেন, সেও কম বড় কাজ নয়। নানা শোকে-দুঃখে নিজের কর্তব্যে এমন অবিচল থাকার ক্ষমতা মানুষ কোথায় পেত, যদি না নিজের ভিতর সে সর্বসহা অস্তিত্বে বিশ্রাম পেত? 
চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কার্য হয় না – একথাটা সম্পূর্ণ অর্থেই বাণী। যা শুধু পথই দেখায় না, বিপদসঙ্কুল ঘূর্ণাবর্ত থেকে দেহকে না আত্মাকে রক্ষা করে। অতীন্দ্রিয় আত্মা নয়, আত্মসন্মানকে রক্ষা করে। একমাত্র যে সন্মান মানুষ নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে করতে পারে, যা তার জীবনে পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান, আশীর্বাদ।