সৌরভ ভট্টাচার্য
6 June 2020
কারণ বাবার বেঠিক হওয়ার ক্ষমতা নেই। বাবার পছন্দ, বাবার বিচার, বাবার সিদ্ধান্ত – সব সময় নির্ভুল। ঈশ্বর বাবাকে এ ক্ষমতা দিয়েছেন। সবার ভুলের উপর বাবার নিষ্ঠুর নির্ভুল কটাক্ষ। বাবার চোখ কোনো ভুল এড়িয়ে যায় না। বাবার উপস্থিতি ভয় আর নিশ্চিন্ততার একটা মিশ্র উপস্থিতি। বাবার সাথে ঈশ্বরের মতের অনৈক্য হয় না। হতে পারে না। ঈশ্বর বাবাকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। বাবার শারীরিক অসুস্থতা ছল। বাবা কখনও অসুস্থ হন না। ঈশ্বর বাবাকে অসুস্থ করেন না। বাবা ভ্রান্তিহীন।
মা ভুল। মা কখনও কখনও ঠিক। সে উদাহরণ খুব অল্প। মায়ের সব ঠিক বাবার সাথে ঠিক। মায়ের কয়েকটা ভুল বাবার ঠিকের বিপরীতে। বাবার মেনে নেওয়াতে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। নইলে কবে মড়া পাখির মত খাঁচার ভিতর থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়ে যেত।
বাবার ভালোবাসা পাহাড়ে ওঠার রাস্তার মত বাঁকা বাঁকা। উঠে যেতে হয়। তবে পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছিয়ে নিজেকে সার্থক মনে করা যায়। বাবার ভালোবাসায় প্রতিটা মোড়ে বাঁকে পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে এগোতে হয়। বাবার ভালোবাসাও বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল। ঈশ্বরের ভালোবাসার মত জেদি। বাবার ভালোবাসা বর্শার ফলার মত একমুখী। বুকে বিঁধে থাকলে উপড়ে ফেলতে নেই। সহ্য করতে হয়। বাবার উদাসীনতাও ভালোবাসা। ঈশ্বরের মত। বাবার তিরস্কারেও শিক্ষা। বাবার সাথে অমত হওয়া মানে খাদের ধারে চলে আসা। তারপর বাবার ক্ষমা। সমস্ত আত্মবিশ্বাস পুড়িয়ে ফেলা ক্ষমা। সমস্ত আত্মসম্মানকে অঞ্জলি দিলে ক্ষমা। ঈশ্বরের মত বাবা একমুখী, সহমতী ভালোবাসা চান।
মায়ের ভালোবাসা পুকুরের মত সবুজ। ওতে শরীর খারাপ হয়। বৃদ্ধি-বিকাশ আটকে থাকে। মায়ের মতামত চিত্তাকর্ষী বহুমূল্য গোলাপের পাশে গজিয়ে ওঠা ঘাসের মত। মাড়িয়ে যেতে সুখ। মাড়িতে গেলে মায়েরও সুখ – এমনভাবেই মাকে ভাবতে হয়। মা মানেই ভুল। সারিবদ্ধ ভুল। বাবার উষ্ণ আড়ালে বাঁচা ভুল। মায়ের ভালোবাসা বাড়তি। বিছানায় চাদরের নীচে থাকা নরম তোশক। মায়ের ভালোবাসা অলিতে গলিতে জমে থাকা ছাওয়ার মত। সিঁড়ির নীচে ঠাণ্ডার মত। আসল অঙ্ক করার জন্য রাফ খাতার মত। আসলে মা মানেই রাফখাতা। হিজিবিজি। অর্থহীন। দিনে দিনে অন্ধকারে ডোবা। অবহেলাতেও মাথা তোলা ভালোবাসা। তারপর ইচ্ছামত মাড়িয়ে গেলেও ঈশ্বরের চোখে না পড়া অস্তিত্ব।
বাবার মেরুদণ্ডের হাড়ে বানানো ছেলের মেরুদণ্ড। পরিণত। বাধ্য। মা’কে তাড়া দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। মা’কে প্রশ্রয় দিতে নেই। মা মানে ভুল। মা মানে জড়পদার্থের প্রাণের অভিনয়। অভিনয়কে আসল বলতে নেই। আখেরে তাতে মায়েরই ক্ষতি। আসলে তাহলে সংসার যাবে আটকে। আসলে তাহলে কঠিন হলেই মায়ের মুক্তি। আসলে তাহলে মা’কে ছাড়িয়ে বাড়তে পারাতেই যুক্তি।
বাবা মায়ের মুক্তির আয়োজন করছে। মানুষটার ত্যাগে ঈশ্বর নাওয়াখাওয়া ছেড়েছেন। একজন পুরুষ একজন অসুস্থ নারীর জন্য নিজের জীবনের কয়েকটা রাত কাটিয়ে দিল ঘুমহীন। সূর্য পরেরদিন দেরিতে উঠল লজ্জায়। রোদের মধ্যেও সে কয়েকটা দিন কেমন একটা কিন্তু কিন্তু ভাব। একজন পুরুষ ক্রমশ মহাপুরুষ হয়ে উঠছে। আয়োজন হচ্ছে সম্বর্ধনার দেবলোকে। দেবতার মধ্যে ঈর্ষা। একজন পুরুষ ক্রমশ দেবতা হয়ে উঠছে। মহানগরের প্রতিটা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে ‘লাইভ বুলেটিন’। একজন নারীকে মুক্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে একজন পুরুষ নির্বাপিত হচ্ছে – একে বলে নির্বাণ।
বাবার মেরুদণ্ডে বানানো সন্তানের মেরুদণ্ড। উপেক্ষা করতে শিখেছে ধার্মিকের মত নারীকে। নারীর যন্ত্রণার প্রকাশ আছে, অস্তিত্ব নেই। পুরুষের যন্ত্রণার অস্তিত্ব আছে, প্রকাশ নেই। এ তত্ত্ব শিখেছে সে। যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠের সামনে চলে রাজনীতি, ক্রীড়ানীতি, সংগীত সাহিত্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার। নির্ভুল বিচার। একজন মৃত্যুপথযাত্রী মোহ কবলিত নারী শূন্য দৃষ্টে তাকিয়ে দেখে নিজের বানানো সংসার। দুর্বলতাকে যে বুঝেছে সত্য। অনিত্যকে যে জেনেছে নিত্য। এক একটা নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মাকে যে জেনেছে পুত্র-কন্যা-স্বামী। হায় রে মূঢ়! আত্মাকে কি তোমার স্নেহের আশায় এ মায়াময় নশ্বর জীবনলীলায় প্রবেশ করে? প্রতিবাদ কি ছিল না তবে কোনোদিন সে নারীর? ছিল। তবে মূল চলচ্চিত্রে সে অংশটুকু বাদ গেছে সম্পাদকের কাঁচিতে। ঈশ্বরের সম্পাদক।
প্রদীপ নিভে গেল। নিভুক, মশাল নয়। সূর্য নয়। ঘরের কোণে জ্বলে থাকা প্রতিভাহীন এক ক্ষুদ্র দীপ নিভে গেল। যে দীপের সলতে থেকে তেলের ভার বহন করেছে একজন পুরুষ। একজন জ্ঞানী, নির্মোহ, নির্ভুল, আত্মগত, সমাজ-জীব উদ্ধারক পুরুষ। দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। ঈশ্বর সংসারে কয়েক মাস যাবৎ ছুটি ঘোষণা করলেন। আনন্দলহরী বেজে উঠল। শোকের এত রূপ! শোকের এমন আমেজি চেহারা! হয় হয়। কর্তব্য সুচারু রূপে সমাধা হলে পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে ওঠে। পুরুষের জীবন আত্মত্যাগের কর্তব্যের ধারাপাত। ত্রুটিহীন। আত্মক্ষমাহীন। পুরুষকে ক্ষমা করে ঈশ্বর। নারীকে ক্ষমা করে পুরুষ।
এ সব তত্ত্ব সন্তান শিখে গেল। প্রথম থেকে শেষ অবধি সে পুরুষ। তার মেরুদণ্ডে বাবার মেরুদণ্ডের বীজ। সমস্ত অন্তর দিয়ে বাবাকে বিদ্বেষ করতে করতে সে নিজে বাবা হল। কেন বিদ্বেষ জানতে ইচ্ছা করে না। কেন বাবাকে অসহ্য লাগে, নিজের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েও বুঝতে পারে না। বুঝতে চায় না। অনেক রাতে ছায়ার মত মায়ের শরীরটা সমস্ত আচ্ছন্ন চেতনা জুড়ে জেগে থাকে। ঘুমাতে চায় না। ঘুমাতে দেয় না। নিজের সন্তানকে বুকে টেনে নিয়ে শোয়। বাবার নির্ভুল অকরুণ চোখদুটো অসহ্য লাগে। এখন সে পুরুষ বৃদ্ধ। অশক্ত। ছেলে বাবার সেবা করে। তার স্নায়ুতে স্নায়ুতে বিদ্বেষ। বৃদ্ধ চোখ এখনও আনুগত্য দাবী করে। তার নিজের তরুণ চোখ সদ্যজাত নিজের সন্তানকে বশ্যতায় অবশ করতে চায়। তার সমস্ত বিদ্বেষ ঘিরে জেদ। জেদের বিপরীতে আরেক অবুঝ নির্বোধ, কে সে? যেন মায়ের মত ব্যর্থ হতে চায়। আবার পরক্ষণেই মোহ কেটে যায়। নাকি মোহ এসে জোড়ে?
ঈশ্বর দু’জন। মোহ দু’রকম। আকাশ অনেকগুলো। হৃদয় বহুরূপী। বাতাসে শ্বাসবায়ু আর বিষ। মাথাতে অবোধ ছুটির লালসা। জিভ হরবোলা।
মাঝে মাঝে বাবার মেরুদণ্ড খুলে বিছানায় রাখে। একা একা পর্যবেক্ষণ করে। নিষ্ঠুরতা মানে কি বিবেক? বিবেক কি কর্কশ? জানলা দিয়ে দক্ষিণের বাতাস ঘরে ঢোকে। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে কে যেন সামনে এসে দাঁড়ায়? সে কি পুরুষ না নারী? সে বুদ্ধ না মা? সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জলে ভরে আসে। ঘুমন্ত ক্ষুদ্রপ্রাণের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে – আমায় সহনশীল করো, আমায় সহনশীল করো। প্রার্থনা করতে করতে মনের মধ্যে সংশয়, যেন ঈশ্বর বাবার ঘরে বাবার সাথে বসে দাবার গুটি সাজাতে সাজাতে তাকেও নিজের দলে আনার চক্রান্ত করছে। তবে কার কাছে প্রার্থনা? প্রার্থনা বন্ধ। তারাভরা আকাশের নীচে দাঁড়ায়। স্ট্রীট লাইটের আলোর থেকে নিজের দৃষ্টিকে আপ্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করে, দেখতে চায় ধ্রুবতারা। নিজের চেষ্টায়। ভোর হয়ে যায়। শুকতারা বলে, আবার কাল এসো। শিখিয়ে দেব।