“Christ furnished the spirit and motivation while Gandhi furnished the method” - Martin Luthar King
মার্টিন লুথার কিং এসেছেন ভারতবর্ষে। ফেব্রুয়ারী মাসের ঠাণ্ডায় এসে নামলেন ভারতে, ১৯৫৯ সাল। দশ তারিখ। থাকলেন এক মাস। থাকতেই হবে তো। এ তো তীর্থক্ষেত্রে আসা। মহাত্মা গান্ধীর কাছে আসা। তীব্র যন্ত্রণা বুকে। নিজের মানুষদের অত্যাচারিত হতে আর দেখতে পারছে না।
সদ্য বাস আন্দোলন শেষ হয়েছে। কালো চামড়ার মানুষ সিট ফাঁকা থাকলেও বসতে পারবেন না বাসে। কারণ তা সাদা চামড়ার জন্য সংরক্ষিত। সে আন্দোলন শেষ। বই লিখলেন সেই আন্দোলন নিয়ে। ১৯৫৮ সাল। বইয়ের নাম Stride Toward Freedom. সই করছেন বইয়ে। ঘিরে আছে অসংখ্য অনুরাগী। একজন মহিলা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনিই কি কিং?
মার্টিন উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।
ব্যস, কিছু বোঝার আগেই ছুরি বিঁধে গেল বুকে। হৃৎপিণ্ডের যে ধমনীকে মহাধমনী বলে, যে একটা বাঁক তৈরি করে জন্ম দেয় অনেকগুলো ধমনীর, সেই বাঁক ঘেঁষে চলে গেল ছুরি। ডাক্তার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, আপনি যদি হেঁচে দিতেন সেই সময়ে তবে নিজের রক্তের প্লাবনে নিজেই ডুবে মারা যেতেন।
মারা যাননি। কিন্তু মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেই মনে হয়েছিল, আর না, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু এত গোপনচারী, এত অনিশ্চিত, এত অতর্কিতে আসা অতিথি? আর দেরি নয়, ভারতে যেতেই হবে। বারবার নানা কাজে আটকে যাচ্ছে ভারতে যাওয়া। আর দেরি নয়। সেদিনের কথা মনে পড়ল। চার্চে একজন মহাত্মা গান্ধী সম্বন্ধে বলছেন। তিনি সদ্য ভারত থেকে ফিরেছেন। শ্রোতার আসনে বসে মার্টিন লুথার কিং। নিজের স্বজাতির অপমান দেখতে পারছেন না আর, কিন্তু উপায়? লড়বেন কি ভাবে? প্লেনে সপরিবার বসে আছেন। প্লেন খারাপ হল। গোটা প্লেনে একমাত্র তারাই নিগ্রো পরিবার। প্লেন কর্তৃপক্ষ থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা হল পাশের এক হোটেলে। সবাই ঢুকছে। দারোয়ান বাধা দিল লুথার কিং আর তার পরিবারকে। কি অপমান, পিছনে যেখানে ময়লা সেখানে খেতে হবে!
একবার বোম পড়ল। বাড়িতে বাচ্চা আর স্ত্রী। লুথার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে করতে ফিরছেন, কি হবে? গিয়ে কি ওদের মৃত দেখবেন? না। বেঁচে আছে ওরা। গভীর রাত, লুথার কাঁদছেন। হে ঈশ্বর, এ গুরুভার বইবার শক্তি কই? তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি। হে ঈশ্বর আমি দুর্বল। আমি পারলাম না। আমি ছেড়ে দিলাম সব।
লুথার কাঁদছেন। অসহায়ের মত কাঁদছেন। রাস্তা কই? হঠাৎ বুকের মধ্যে কে যেন জেগে উঠল। কার ভাষা? কার চোখে পড়ে গেল চোখ? কার সে নয়ন পরে নয়ন যায় গো ঠেকি... মহা আপন সেকি!
চার্চে বক্তা বলে চলেছেন মহাত্মা গান্ধীর কথা। আবেগে গলা ধরা আসছে। এও সম্ভব! এও সম্ভব! আইনস্টাইন বলছেন, আগামী দিনের মানুষ বিশ্বাস করবে না, এরকম একজন মানুষ রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে হেঁটে গেছেন এই মাটিতে।
লুথার কিং পুরো ভাষণ শুনতে পারলেন না। উঠে এলেন। সোজা বাজারে গেলেন। মহাত্মা গান্ধী সংক্রান্ত প্রায় আধডজন বই কিনে বাড়ি ফিরলেন। ডুবে গেলেন। রাস্তা পেলেন। লিখলেন, -
“The intellectual and moral satisfaction that I failed to gain from the utilitarianism of Bentham and Mill, the revolutionary methods of Marx and Lenin, the social contracts theory of Hobbes, the “back to nature” optimism of Rousseau, the superman philosophy of Nietzsche, I found in the nonviolent resistance philosophy of Gandhi.”
ভারতে তো আসতেই হবে। দেখা করলেন পণ্ডিত নেহেরু সহ নানা জ্ঞানী-গুণী তথা গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারিকদের সঙ্গে। ভারতের সমস্যা দেখলেন। বুঝতে চেষ্টা করলেন। ভীষণ দরিদ্র বেশ কিছু গ্রাম দেখবার সময় জানতে পারলেন একটা শব্দ - অচ্ছুৎ। কেরালার এক স্কুলে সস্ত্রীক গেছেন লুথার কিং। স্কুলের স্যার তাদের পরিচয় দেওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীদের বললে, ইনি আমেরিকা থেকে এসেছেন, ইনি জাতে অচ্ছুৎ। চমকে উঠলেন কিং, তিনি কি সত্যিই অচ্ছুৎ? ভেবে দেখলেন, তাই তো! তার ছেলেমেয়েরা সাদা চামড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে পারে না। প্রতিপদে তাদের ছোঁয়া, তাদের অস্তিত্বকে মাড়িয়ে যাচ্ছে যারা, তাদের চোখে সত্যিই তো তারা অচ্ছুৎ।
২২শে ফেব্রুয়ারী। কিং সস্ত্রীক বসে কন্যাকুমারিকার একটা পাথরের উপরে। সূর্য ডুবছে পশ্চিমাকাশে। অন্ধকার নামছে ধীর পায়ে। তিনটে সমুদ্রের সঙ্গমস্থলকে বিস্ময়ের চোখে দেখছেন লুথার। কি অপরূপ সৌন্দর্য! কি রূপ প্রকৃতির! কয়েক দশক আগে এই একই জায়গায় এসে বসেছিলেন আরেক বিশাল হৃদয় মানুষ। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ থেকে ভারতাত্মার দাস বিবেকানন্দ’র জন্ম হয়েছিল এখানে। ভারতের মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন মানবাত্মার মুক্তির পথ। “মানুষকে পাপী বলাই শ্রেষ্ঠ পাপ”। “নিঃস্বার্থপরতাই ঈশ্বর”। এমন সব বাণী মানুষের অন্তরের কোন জ্যোতিকে দেখে উনি বলেছিলেন? সে তিনিই জানেন।
অন্ধকার হল। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই পুব আকাশ জুড়ে উঠল বিশালাকায় শ্বেতশুভ্র চাঁদ। অন্ধকারে ঈশ্বরের প্রসন্ন হাসির মত চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ল তিনটে সাগরের বুকে। কি গভীরভাবে শান্ত হল ক্ষণিকের জন্য লুথারের হৃদয়। কেউ কোনো কথা বলছেন না। শুধু সমুদ্রের আওয়াজ আর ঘরে ফেরা পাখিদের ডাক। এই প্রশান্তির মধ্যে এক গভীর উপলব্ধি জন্মালো মার্টিন লুথারের চিত্তে। তিনি স্ত্রীকে বললেন, দেখো, সমস্ত অন্ধকার হলেও যেমন চাঁদের আলো এই অন্ধকারকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তুলল, তেমনই ঈশ্বরের করুণায় সব অন্ধকার, সব অত্যাচার সব কেটে যাবে তুমি দেখো, এ কি গভীরতম সত্যের উপলব্ধি হল আজ আমার!
লুথার কিং এই উপলব্ধি নিয়ে ভারত ছাড়লেন। বিস্মিত হলেন নেহেরু প্রমুখ মানুষদের সঙ্গে কথা বলে। তিনি ভাবলেন, ভারতেও বৈষম্য আছে, বর্ণবিদ্বেষ আছে। কিন্তু দেশের প্রমুখ নেতারা এর বিরোধিতা করছেন, এমনকি নীচুস্তরের জনপ্রতিনিধি যিনি তিনিও পর্যন্ত বিরোধিতা করছেন। কিন্তু আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিরাই বিশ্বাস করেন, এবং গর্বের সঙ্গে বিশ্বাস করেন যে এই পৃথকীকরণের নীতি দেশের জন্য ভালো। বাস আন্দোলনের পর পরই এক সাদা চামড়ার বৃদ্ধা বাসে উঠে দেখেন সামনের সিটে কিং বসে আছেন। তাকে পিছনের সিটে বসতে বলা হলে তিনি বললেন, আমি মরে যাব সেও ভালো, কিন্তু একজন কালো চামড়ার পিছনে বসব... থু!
কি ঘৃণা!
ভারতে জন্ম হয়েছে চারটে ধর্মের। প্রাচীন ধর্ম সনাতন, তারপর বুদ্ধ, জৈন ও শিখ। নানা উত্থান-পতনের পর সহাবস্থানের সূত্রও আবিষ্কার হয়েছে। গয়া আর কাশীতে বৌদ্ধ আর হিন্দুধর্মের যে সহাবস্থান আজ আছে, সে সহাবস্থান শান্তির। বুদ্ধগয়াতে হিন্দু যাচ্ছে, নানকের মন্দিরে হিন্দু যাচ্ছে, জৈন মন্দিরে হিন্দু যাচ্ছে। কোথাও কোনো বাধা মনে হচ্ছে না। প্রতিটি ধর্মের অনেক সঙ্কেত, প্রথাতেও মিল আছে। কয়েক দশক আগে এই দর্শন, আদর্শের কথা বলতেই গিয়েছিলেন সেই মানুষটা শিকাগোতে এবং যিনি যে বাণীর জোরে সে দেশে সর্বজনবিদিত হলেন সেও কি এই অহিংসার বাণী নয়? গান্ধীর ধর্মের আদর্শ, সর্বধর্মের মিলনের আদর্শ। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মধ্যেও একই সুর, একই ঐক্যের কথা শোনালেন বিবেকানন্দ, গান্ধী যা হয় তো এতটা স্পষ্ট করে তারা নিজেরাও বলতে পারেননি। লুথার বিস্মিত হচ্ছেন। এত বড় দেশ। এত বড় গণতন্ত্র। অনেক অনেক সমস্যা। কিন্তু সে সমস্যাকে অতিক্রম করার জন্য কি নিদারুণ তপস্যা! বিবেকানন্দ বলছেন এত প্রাচীন একটা জাতের খুঁত বার করতে একটা পাঁচ বছরের শিশুও পারবে, কিন্তু সংস্কার তো করতেই হবে। সেই সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। নিন্দার পথে নয়। এই সেই বিবিধের মাঝে দেখো মিলনমহান!
লুথার ভারতকে এই অন্তরের আলোতে দেখে বললেন, এত এত মতের, সম্পদের, ধনের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কেউ কারোরটা কেড়ে নিচ্ছে না, এক অখণ্ড শান্তি কিভাবে দেশের গভীরে বয়ে চলেছে? অশান্তি জন্মালেও সে সেই নিজের শক্তিতে তাকে মিটিয়ে নিচ্ছে! এই কি সেই শক্তি, সেই সত্য? অহিংসা! যে মন্ত্রে দীক্ষা নিতে তিনি মহাত্মার দ্বারে এসেছেন আজ! সেই মন্ত্রেই ভবিষ্যতে জন্ম হবে সেই যুগান্তকারী ভাষণের - I have a dream. এ স্বপ্ন সংস্কারের। চিত্তের সংস্কার বন্দুকের শাসনে হয় না, হয় ভালোবাসায়। চিত্ত প্রভুর আসন। অহংকে বিসর্জন দেওয়ার সাধনের ক্ষেত্র সে। তবেই জন্মাবে যা মহৎ, যা শ্রেয়, যা শান্তির। যার মূল কথা - অহিংসা।