সৌরভ ভট্টাচার্য
27 June 2019
যখন চারদিকে অত্যন্ত নীচ স্বার্থপরতা, কুটিলতা, ধূর্তামি, সঙ্কীর্ণ পঙ্কিলতা ঘরের দেওয়াল হয়ে উঠতে শুরু করল, মনে হল পালাই। কিন্তু পালাই বললেই কি পালানো যায়, সমাজ তো শুধু বাইরে নেই, নিজের ভিতরেও তার গভীর শিকড়। আর কর্তব্য? সে তো শুধু সমাজের থেকে জন্মায় না, নিজের বিবেকের রসদও তো আছে তাতে। তাই পালানো হল না। কিন্তু পালানোর তাগিদটা নিয়ে দেওয়ালের সাথে মোকাবিলা শুরু হল।
দেওয়াল শুধু যে এরাই গড়ল তা তো নয়! মানুষের অতি-শ্রদ্ধা, অতি-প্রত্যাশাও গড়ল তিলে তিলে। সে প্রতিদিন হিসাব চায়, তার পাওনা মিটিয়ে নিতে চায়। মন নিজেকে নিয়ে নিজের মধ্য একটা আবর্ত তৈরি করে - মিথ্যা মহত্বের আবর্ত। লোভ জন্মায়। তার সাথে জন্মায় হাজার একটা সোনার শিকল। তার প্রতিও নির্মোহ হয় মন একদিন।
মন তখন ছুটি চায়। এতদিন ভাবতাম ছুটি বুঝি পাহাড়ের কোলে, সমুদ্রের সংসার ভোলানো অহর্নিশি গর্জনে, জঙ্গলের গভীরে নিঃসঙ্গতায়। ক্রমে বুঝলাম তা নয়, আমার ছুটি কেবল তোমার কাছে - যে তুমি আমায় দেখেছ আমার সব দোষত্রুটি মিলিয়ে আমার আপন সত্তায়। সেখানে আমি আমিই। কারোর সাপেক্ষে কিছু নই, কারোর তুলনায় কিছু নই। না মহৎ, না নীচ। আমার সত্য স্বরূপটাকে আমি তোমার মধ্যে দেখলাম। তুমিই সেই, যে দাঁড়ালে বিনা আভরণে আমার সামনে, আভরণহীন আমায় গ্রহণ করতে। স্বস্তি পেলাম, ভয়ও পেলাম। কুণ্ঠিত হলাম।
স্বস্তি পেলাম কারণ যা বললাম এতক্ষণ। ভয় পেলাম কারণ, নীড় ভাঙা ঝড় আমি দেখেছি। কুণ্ঠিত হলাম কারণ, নিজেকে এমন আভরণহীন সাদামাটা দেখার অভ্যাসটা চলে গিয়েছিল।
তবু পা বাড়ালাম। নিজেকে বন্ধন মুক্ত করলাম। বললাম, দাঁড়ালাম সামনে তোমার। আমি এমনই। আমি আমিই। সংসারে সহজ সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার সাধনই দুর্লভ, সে সাহস তোমার আছে। এখানে চারদিকে হতে চাওয়ার তুমুল তাগিদ। সঙ্কোচহীন, দ্বিধাহীন, সরল সহজভাবে বাঁচার জন্য যে রসদ প্রাণের গভীরে আছে - তা কেবল মেলে নিজেকে নিয়ে নিজের সমস্ত লোভ বিসর্জন দিলে। জেদ যখন বাইরে ছোটায় তখন তা লোভ। জেদ যখন সমস্ত প্রতিকূলতায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে শেখায়, তখন তা সাধন। শিকড়ের যেমন মাটি লাগে আমার তেমনই তোমার কাছে আসা। তুমিই সেই মাটি।
পাঠক এতদূর এসে ভাববেন, কার কথা লিখে চলেছি? কার উদ্দেশ্যেই বা লিখে চলেছি।
এই দুইয়ের উত্তরই ততটা স্পষ্ট নয়, যতটা কৈফিয়তহীন অনুভবের আকাশটা। সেই আকাশে যে ক্ষণিক রঙের আভা এই মুহূর্তটায় স্পষ্ট হয়ে উঠল, সেই মুহূর্তটুকুই হোক সত্য।
এখানে আজ কাল্পনিক ব্যর্থতার আশঙ্কায় তরুণ প্রাণের আত্মহত্যার মিছিল চারদিকে। বিদ্যালয় আজ আত্মহননের যূপকাষ্ঠ। শিক্ষা আজ বিভীষিকা। এ মিথ্যার কুয়াশাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিই - এতটা শ্বাস আমার বুকে ধরে না। আজ যে ঘটনা, যে মৃত্যুর মাত্র কয়েকটা বিদ্যালয়গুলোতে দেখলাম তা বিশালাকায় ডুবো পাহাড়ের চুড়ো মাত্র। তাদের উদ্দেশ্যে আমার কোনো উপদেশ নেই। কারণ উপদেশের কোলাহলে তারা বধির আজ, প্রতিক্রিয়াহীন। আপনাদের ব্যর্থতার গল্প শোনান তাদের, অসহায়তার গল্প শোনান, আর বারবার বলুন কেমনভাবে বন্ধুত্বের হাত ধরে সে ঝঞ্ঝা কাটিয়ে উঠেছেন। সে বন্ধু যেই হোক না কেন। বয়েস, লিঙ্গ, দেশ, কাল - কিছুই শর্ত নয় সেখানে। একটাই শর্ত - "যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়।"
আমি বারবার বিশ্বাস করেছি, আজও করি - সংসারে সব চাইতে কঠিন, সব চাইতে আবশ্যক সাধন - সহজ হয়ে ওঠার সাধন। নিজের সাথে, পরিবেশের সাথে, সমাজের সাথে। আর তা তখনই সম্ভব - যখন মানুষ সত্য অর্থে বন্ধুত্বের মানে খুঁজে পায় নিজের জীবনে। বন্ধু হয়ে ওঠে নিজের। তার সাথে বন্ধু হয় কোনো বিশেষ একজনের, বা কয়েক জনের। ব্যর্থ হওয়াটা লজ্জার নয়, লজ্জার ভালোবাসতে না পারাটা, নিজেকে, বন্ধুত্বকে, সর্বোপরি জীবনকে। আর কেউ তাকে ক্ষমা করুক চাই না করুক, সে নিজে যেন ক্ষমা করে নিজেকে। নিজের বন্ধু হয়ে ওঠে। সাথে অন্যকেও ক্ষমা করার শক্তি পাবে তখন সে। বন্ধুত্ব ন্যায়-নীতির পরাকাষ্ঠায় গড়ে ওঠে না - ওঠে সহজ সরল শর্তহীন ক্ষমায়। বেঁচে থাকাটা সফল হওয়ার জন্য না, আনন্দে বেঁচে থাকাটাই সার্থকতা।
একজন ধনী মানুষ কয়েকদিন আগে আমায় বললেন, তিনি সপরিবারে প্রতিটা পুজো এখন অনাথ আশ্রমে কাটান। কারণ নিজের সন্তানকে দেখাতে চান, মানুষ কতটা কষ্ট করে বাঁচে। তবেই তো তারা মাটির সাথে নিজের যোগাযোগটা পাবে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম একান্তে, তোর কেমন লাগে পুজোয় কাটাতে সেখানে?
বাচ্চাটা বলল, আগে খারাপ লাগত। এখন ভালো লাগে। ওদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে যে। এখন না গেলেই খারাপ লাগে।