“ছেলেদের ছোটোবেলা থেকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখাতে হয়।’’
এই কথাটার মানে বড্ড অস্পষ্ট। সম্মান করতে কি শেখানো যায়? কাউকে বাইরে থেকে একটা সম্মান করার ম্যানারিজম শেখানো যায়। কিন্তু আদতে সম্মান তো ভীষণ আন্তরিক আর পার্সোনাল জিনিস, ওটা শেখানো কী করে যায় কাউকে?
যেমন নম্রতা। নম্রতার ম্যানারিজম বা ভানটুকু শেখানো যায়। কিন্তু নম্রতাটা তো ভীষণ আন্তরিক আর পার্সোনাল জিনিস, ওটা কি শেখানো যায়?
সম্মান করতে শেখাটা ভীষণ পরোক্ষ শিক্ষা বলে আমার মনে হয়। আমি কী পরিবেশে বড় হচ্ছি, সেই পরিবেশে বন্ধ দরজার পিছনে মেয়েদের সঙ্গে পরিবারের লোকজন কেমন ব্যবহার করছেন, কী ভাষায় কথা বলছেন, সেটা ভীষণ ম্যাটার করে বলে আমার মনে হয়। আমি যদি দেখি বাবা মাকে কথায় কথায় অসম্মান করছেন, বাড়ির আরো বড়রাও কথায় কথায় বাড়ির মেয়েদের অসম্মান করছেন, তখন আমাকে যতই উপদেশ শিক্ষক, মহাপুরুষের বাণী, সিনেমা, সমাজের হোতারা দিন না কেন, আমার কাছে ওটা একটা অর্থহীন, লোক দেখানো স্টেটমেন্ট ছাড়া কিছুই নয়। অন্তঃসারশূন্য ম্যানারিজম।
আসল হল আমার পরিবেশের, আমার চারপাশের লোকের আচরণ। প্রথম আমার পরিবারের। আমার মনে হয় যেখানে যত অ্যাবিউজার জন্মেছে তারা এমন পরিবেশে বড় হয়েছে যেখানে মেয়েদের সম্মান নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা অনেকেরই নেই। আসল সমস্যাটা তাদের শৈশবের।
আসলে শিশুদের যতটা সরল, একমাত্রিক বলে আমাদের মনে হয়, আদৌ তা নয়। একজন ভণ্ড মানুষের ভণ্ডামিটা সে দারুণভাবে বুঝে যায়, আর কপি করে নেয়। আমি এমন পরিবার দেখেছি আপাতভাবে মনে হবে মেয়েদের যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয়, গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কদিন সে পরিবারের সঙ্গে থেকে দেখেছি সেটা আসলে একটা মুখোশ। আদতে সেখানে খুব সুক্ষ্মভাবে একটা পুরুষতন্ত্র চলে। মজার কথা হচ্ছে পরিবারের বাচ্চাগুলোও ধীরে ধীরে সে চাতুরীটা শিখে নেয়। কেউ কেউ বড় হয়ে অতটা চাতুরী রাখার মত কৌশলবিদ না হওয়ায় তার রুক্ষতাটা সবার সামনে ধরা পড়ে যায়। আশেপাশের মানুষ বলে তোর পরিবারে তো এমন কাউকে দেখিনি….তুই কী করে এমন হলি….?
আমি অবাক হয়ে যাই কী ওপরসা দৃষ্টিতে ভুলে থাকে মানুষ। কী সহজে সাদা-কালোয় বিচার করে নেয় মানুষ। একটু তলিয়ে, নেড়েঘেঁটে ভাবার অভ্যাসটাই হয়নি যে আমাদের। শেখানো বুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম আওড়িয়ে যাচ্ছি। একই কাঁচে দেখতে দেখতে কাঁচটা যে ঘষা কাঁচ হয়ে গেছে, সে বোধটাও রাখছি না।
মেয়েদের সম্মান করতে শেখো, বললেই আমার মনে হয় যেন, সম্মান করা বা না করা নিয়ে আমার যেন কোনো চয়েস আছে। না, আমার কোনো চয়েস নেই। আমার এটা স্পষ্ট দেখার আছে, বোঝার আছে। আমার চয়েস না এটা। এটাই সত্য। তার ডিগনিটিটাকে নিজের ডিগনিটি দিয়ে দেখতে শেখাটা আমার বোধবুদ্ধির সুস্থতার লক্ষণ। সেটা শেখানো যায় না, সেটা একজন সুস্থ মানুষ সুস্থ পরিবেশে বড় হলে আপনিই চারপাশ থেকে ইম্বাইব করে নেয়। ওভাবেই তার সুস্থ জীবনের ভিত গড়ে ওঠে।
কিন্তু আমরা যতটা মৌখিক শিক্ষায়, বাইরের শিক্ষায় ভরসা রাখি, ততটা আচরণের শিক্ষায় ভরসা রাখি না। মুখের ভাষা স্থান-কাল অনুযায়ী বদলানো যতটা সহজ, আচরণ না যে। কিছুক্ষণ অভিনয় করা যায়। তারপর? তাই এই আচরণের দিকটাকে আমরা গুরুত্ব কম দিই, আর ভাবি আমার মহামূল্য যুক্তিবান বাণীর আলোতেই আমার সন্তানের বিবেক দীপ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবে। কাঁচকলা হবে। আমার আচরণ যদি আমার বাক্যের অনুরূপ না হয় সে বাক্য বন্ধ্যা। তার দ্বারা কোনো কাজই হয় না।
প্রথম কথা এটাই, শেষের কথাও এটাই, কাউকেই সম্মান করতে শেখাটা আমার কোনো চয়েস না। ওটা কোনো ম্যানারিজম না। ওটা আমার মধ্যে যদি স্বাভাবিকভাবে না জন্মায়, না আসে, তবে বুঝতে হবে আমার পার্সোনাল লাইফে কোনো গুরুতর সমস্যা আছে। আগে তার সমাধানের রাস্তা যেন খুঁজি।
আর রইল সম্মান আর মহিলার উপর নিপীড়নের যোগাযোগ। সেও খুব স্পষ্ট বলে আমার মনে হয় না। আমি সদ্য ঘটে যাওয়া কল্পনাতীত ঘটনাটা ছেড়েই দিলাম। রাস্তাঘাটে, ট্রেনেবাসে মহিলারা যে বিকারের শিকার হন সেটা সেই পুরুষেরা তথাকথিতভাবে “মেয়েদের সম্মান” করতে পারে না বলে করছে, এ যুক্তিটা আমার অতি-সরলীকরণ মনে হয়। অনেক অ্যাবিউজারই ভীষণ সুইট-মাউথ, জেন্টল হয় লোকালয়ে। তাদের স্বরূপ বেরোয় গোপনীয়তায়।
আমার যেটা মনে হয়, সেই সব পুরুষেরা প্রথম যেটা খুইয়ে বসে সেটা আত্মসম্মানবোধ। কাউকে সম্মানের কথা পরে আসে। কেন খুইয়ে বসে? কারণ তার প্রবৃত্তির তাগিদ এমনই হয় যে স্বাভাবিক বিবেক-বিবেচনা বোধ কাজ করে না তখন। তার সমস্ত আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ওই প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে তখন।
এই আত্মনিয়ন্ত্রণও একটা অভ্যাস। যার ভিত্তি আত্মসম্মানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। আমি বাইরের প্রেস্টিজের কথা বলছি না। আমি তার পার্সোনাল জীবনের আত্মসম্মানের কথা বলছি। যেখান থেকে কোনো দুষ্প্রবৃত্তি মাথায় এলেই সে বলে, আমাকে এটা মানায় না….ছি ছি….একি ভাবছি আমি!
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এই শতাব্দীপ্রাচীন মানব সমাজেই এই দুষ্প্রবৃত্তিকে উৎসাহ দেওয়ার অনেক রাস্তা আছে। অনেক গোপন রাস্তা আছে। আমরা তাদের দেখেও দেখি না। আমরা ভাবি ওর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?
নানা ঘটনা মনে করিয়ে দেয় আমাদের সম্পর্ক আছে। আমরা হঠাৎ করে উঠে পড়ে সমাজসংস্কারে লাগি। পাহারার পর পাহারা বসাই। আবার আমাদের শৈথিল্য আসে। পাহারা কমে। আবার একই খেলা শুরু হয়।
সত্যি যদি কোনো শিশুকে সত্যিকারের কোনো শিক্ষা দিতেই হয়, তবে আসল শিক্ষাই হল তাকে নিজেকে সম্মান করতে শেখানো। ঠিক-ভুল, ভালো-মন্দের মধ্যে সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে, নিজেকে সম্মান করতে, নিজের মর্যাদাকে নিয়ে সোজা রাস্তায় চলতে শেখে যেন সে। এ খুব কঠিন কাজ কিছু না। কিন্তু এতে আশু গ্ল্যামার নেই, বা বাহবা নেই বলে আমাদের এই আসল শিক্ষা দেওয়াটাই অবহেলিত থেকে যায়। নিজেকে সম্মান করতে শিখলেই অন্যকে সম্মান করাটা আপনিই এসে যায়। তাই দয়া করে কোনো শিশুর আত্মসম্মানকে নষ্ট করবেন না। ওটা সে নিয়েই জন্মায়। তার সেই জন্মলব্ধ আত্মসম্মানবোধকে আলোকিত আর সচল করে তোলাটাই বাইরের শিক্ষক করতে পারেন। কিছু নতুন করে যোগ করার কোনো দরকার নেই।