Skip to main content

কিছু মোহ মানুষ বড় হলেও ছাড়তে পারে না। তার মধ্যে একটা, ভয়ের প্রতি মোহ। ছোটোবেলা থেকে বাবা-মা, শিক্ষক, গুরুগম্ভীর আত্মীয়,পাড়ার দাদা-জেঠু-কাকা, নানা দেবদেবী প্রমুখদের ভয় পেতে পেতে, ভয়ের উপর একটা দুর্বলতা জন্মে যায়। সে ভয় পেতে চায়, ভয় দেখাতে চায়, ভয় নিয়ে ব্যবসা করতে চায়। যে কোনোভাবেই হোক ভয়ের নাগাল পেরিয়ে বাঁচতে চায় না। ভয়ও তাই ছাড়তে চায় না।

কোভিড নিয়ে মিডিয়া থেকে শুরু করে বহু তথাকথিত বিজ্ঞ মানুষকেও দেখে আসছি ঘুরে ফিরে সেই এক ফর্মুলা ব্যবহার করে যাচ্ছেন। মানুষকে ভয় দেখালেই মানুষ বশে আসবে, এ বিশ্বাস মনের মধ্যে এমন গেঁথে বসে আছে না! ভাবাই যায় না যে ভয়ের ছড়ির জোর যতটা ভাবা যায় আসলে ততটা নয়। ভয়ের ভয় কেটে গেলে আসল মানুষটা নিজের খোঁজ পায়। সত্যের জোরে, সত্যের আলোয় কোনটা মঙ্গলজনক আর কোনটা অমঙ্গলকর সেটা সে অনুভব করে। কিন্তু মানুষকে সত্যে আনার ধৈর্য আর ভয়ের চাবুক চালানোর তাৎক্ষণিক লোভ, এই দুটোর মধ্যে ভয়ের চাবুকই জিতে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।

সিগারেটের গায়ে ভয়ংকর ছবি দেওয়া হল। তাতে কি সিগারেট বিক্রি কমল? কিন্তু ভয়ের তত্ত্ব নিয়ে যে মোহ, সে জিতল। সে তার জায়গা করে নিল। বেতের ভয়ে যে ছাত্র পড়া করে আসে সে তদ্দিন সার্থক হয় না, যদ্দিন না পড়াশোনাটা তার স্বাভাবিক বোধে সহজ হয়ে আসে। মারের ভয়ে পাশ করানো যায়, শিক্ষিত করে তোলা যায় না সত্য অর্থে।

এমনকি দুর্ভাগ্য এতটাই যে WHO এর মত সংস্থার আধিকারিকেরাও এই এক মিথে বিশ্বাস করেন দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞানের মানুষ যারা, তারা ভয়ের ভরসায় সাবধানবাণী শোনাচ্ছেন। ভয়ের সুরটা চড়ছে। সত্যের সুরটা ঢেকে যাচ্ছে। আদতে লাভও কিছুই হচ্ছে না। হু হু করে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। শুধু যে অজ্ঞ, সাধারণেরা আক্রান্ত হচ্ছেন তা তো নয়, চিকিৎসক থেকে শুরু করে বহু জ্ঞানীগুণী, বিশিষ্ট, বুদ্ধিজীবী মানুষেরাও আক্রান্ত হচ্ছেন।

এই অতিমারীর নিজস্ব যে ভয়ের একটা স্বাভাবিক সীমা আছে তাকে বিকারের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। কি বীভৎস, রুচিহীন, সংযমহীন উচ্চারণে, দৃশ্যায়নে এক বিভীষিকার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। শুধু কোভিড বলে নয়, বন্যা ঝড়ের উগ্ররূপ দেখিয়ে মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টির জন্য কতরকম কৌশলের সাহায্য নিচ্ছেন তথাকথিত সাংবাদিকেরা সে সত্যও উঠে আসছে।

আতঙ্ক তৈরি করা আর সত্য পরিবেশন করার মধ্যে যে বিবেচনাগত পার্থক্য আছে সে বিষয়টা নিয়ে ভাবাটা হয় তো এই চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার যুগে অর্থহীন হয়ে গেছে। সব বিষয়ে প্রতিযোগিতার প্রথা আমাদের দিন দিন কিভাবে নিঃস্ব করে যাচ্ছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কে কত কম ইঞ্চি হার্ট কেটে আপনার চিকিৎসা করে দেবে সে নিয়েও রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় বোর্ডে বিজ্ঞাপন চলছে। ডাক্তারেরা বা ডাক্তারের পোশাক পরা মডেলরা দাঁড়িয়ে পোজও দিচ্ছেন সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা এতটাই দৈন্য এত গর্বের সঙ্গে আমাদের এনে দেয়। সাংবাদিকতা আর আতঙ্কাবাদিতা তো কখনওই এক নয়! একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। সৌরভের আক্রান্ত হওয়ার দুদিন পর যখন সৌরভের মেয়েও আক্রান্ত হল তখন একটা বাংলা খবরের কাগজ লিখল, "ছারখার হল সৌরভের পরিবার"। কি সাংঘাতিক বিশ্রী অতিকথন!

ভয় মানুষের মোহ। স্বভাব নয়। বিকার। ভয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুদিনের জন্য ফল পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সে-ই ভয়ই যখন ব্যাকফায়ার করে তখন তাকে সামলানো দায় হয়। কোভিড ফ্যাটিগনেস নাম দিয়ে যাকে চালাচ্ছি, আদতে সে কি? আদতে তা মানুষের আদিম অকুতোভয় সত্তার গর্জন। যাক সব শেষ হয়ে, তবু আমি ঘরে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব না। এ ভাব মঙ্গলজনক নয়, কিন্তু এ অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া। মানুষ বেপরোয়া হয় এই ভয়ের অতি ব্যবহারের অত্যাচারেই।

পাঠক এতদূর পড়ে বলবেন, কিন্তু এ তো আইডাল অবস্থার কথা। বাস্তবে তা হয় না। আমি বলি বাস্তবে যা হয় সেটা ভয়ের ছড়িতেও হয় না বেশিদিন। ফাঁস আলগা হয়ে গিয়ে আরো দ্বিগুণ ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা যায়।

উপায়? আমার মনে হয় শিক্ষা। একই কথা বারবার বলে যাওয়া। বারবার, বারবার বলে যাওয়া। ভয় বা ত্রাসের মোড়কে নয়। ধৈর্য আর সদিচ্ছার জোরে। বিজ্ঞানের যে স্বাভাবিক বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের জোরে। মানুষ মানবেই। ধৈর্য ধরতে হবে। বারবার একই কথা বলতে বলতে ফল ফলেই। গায়ের জোরে ফলাতে গেলে দুদিন পর আরো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

কিন্তু ওই যে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের মোহ। ভয় আর শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে নাকি এক অদৃশ্য যোগাযোগ আছেই। যে মাদুলির ব্যবসা করে, ধর্মের ব্যবসা করে তারা সবাই কিন্তু এই ভয়টাকেই উপজীব্য করে নেয়। সুতরাং আমার মধ্যে যদি এক রত্তিও এই ভয়ের ক্ষমতার প্রতি অন্ধ মোহ থাকে, তবে আমি যেন নিজেকে ওই জ্যোতিষ, বাবাজীদের থেকে আলাদা করে না দেখি। আমিও একই কাজ করছি, আমার মত করে।

ভয় উপায় নয়। উদ্দেশ্য আর উপায় যেখানে আলাদা সেখানেই মানুষ দুর্নীতিগ্রস্থ। ভয় তাই কখনওই উপায় নয়। বারবার ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া, বারবার ঠিকটা বলে যাওয়া, ক্রমাগত বলে যাওয়া, এইটাই রাস্তা। একমাত্র রাস্তা বলে আমার মনে হয়।