Skip to main content
সে আছে বলে


বুকের মধ্যে একটা স্পন্দন অনুভব করি। না, হৃৎযন্ত্রের না। তার চেয়েও গভীরে একটা কিছু। বেঁচে থাকার তাগিদ হয়তো। সে স্পন্দন খুব স্বতন্ত্র। আমার নিত্যদিনের যা কিছু, তা তার চোখ এড়ায় না। আমার একটা চিন্তাও তার অগোচর হয় না। সে আছে। তার এই থাকাটুকুতেই আমার প্রতিদিনের হওয়া। একটু একটু করে গড়ে ওঠা। হয়ে ওঠা।
যখন দেখি মাথার মধ্যে হাজার তত্ত্ব নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, মাথাটাকে রীতিমত কুস্তির আখড়া বানিয়ে ফেলেছে, আমি এক ডুবে আমার এই প্রাণের গভীরের গোপন দরজার কড়া নাড়ি। দরজা খোলে। আমি ভিতরে এসে নিশ্চিন্ত হই।
আমার এই প্রাণের গভীরে যে প্রাণের স্পন্দন তাকে কোনো নামে অভিহিত করলাম না। নামে কি আসে যায়!
মাথার মধ্যে কত ধারণার বাসা। পড়ে, শুনে, ভেবে কতরকম ধারণা বয়ে বেড়াচ্ছি। তাই দিয়ে বিশ্বসংসারের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছি। নাম্বার দিচ্ছি, কাটছি, স্তুতি গাইছি। আরো কত কি! একবারও জিজ্ঞাসা করছি না, আচ্ছা এই ধারণাগুলো কি সব সত্যি? কোনো ফাঁক নেই? নেই কোনো অতিরঞ্জন? এরা কি অপরিবর্তনশীল? অমরত্ব লাভ করেছে?
ধারণা মানেই মৃত। কোনো এক সময়ে, কোনো বিশেষ মানসিকতায় তৈরী হওয়া একটা ছাপ। সময় এগিয়েছে, ধারণার উৎস পাল্টেছে, কিন্তু আমার ধারণাগুলো আর পাল্টালো না। কি করে পাল্টাবে? ওগুলোর ওপর আমার যে ভয়ংকর আসক্তি! আমার বাইরের শরীরটা যেমন হাত-পা-নাক-চোখ-মুখ নিয়ে তৈরী হয়েছে, তেমন আমার মনের শরীরটা হাজার ধারণা দিয়ে তৈরী। এত সহজে ছাড়া যায়! সে যে মানসিক মৃত্যুতুল্য। অগত্যা চলুক।
এই ধারণার পাঁচিলে ঘিরে আমার প্রাণের সেই গভীর স্পন্দন। সে জীবিত, তাই সে আঘাত করে। যার প্রাণের শক্তি যত বেশি তার আঘাত তত বেশি। সে তখন শুধু নিজের মৃতপ্রায় ধারণাগুলোকে সমূলে উচ্ছেদ করেই ক্ষান্ত হয় না, সমাজের অচলায়তনের ভিত ধরেও নাড়া দেয়। সে যুক্তির জোরে না, প্রাণের গভীরে যে স্পন্দনের কথা বলছিলুম, তার জোরে। সে আলোকিত না, সে নিজেই আলো। আলোর বুকের মধ্যে যেমন আলোকিত করার স্বাভাবিক শক্তি থাকে, প্রাণের গভীরের সে অস্তিত্বের বুকে তেমনই মানুষকে উদার পথে, আলোকিত পথে, জ্ঞানের পথে নিয়ে চলার, পথ দেখানোর তার স্বাভাবিক শক্তি থাকে। তা তাড়িয়ে নিয়ে যায় না, হাত ধরে বন্ধুর মত নিয়ে যায়। পাগলের মত তাকে কামড়ে, আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করলেও সে ছাড়ে না। তার সে শক্তি যুক্তির জোরে না, প্রেমের জোরে। যা সেই প্রাণের স্পন্দনের আরেক নাম, আরেক দিক।
সে শুধু বলে, নিজেকে মুক্ত করো। বুঝব কি করে নিজেকে মুক্ত করছি? সে বলে, ওই ফুলের দিকে তাকাও, দেখো সে কুঁড়ির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে প্রকাশিত করেছে। তুমিও নিজেকে প্রকাশ করো।
হতে পারে আজ হিংসা, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, লোভ চারিদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে কোনোদিন তারা শেষ কথা হতে পারে না। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস সে কথা বলে না। যাতে সবার শুভ, যাতে সবাই আলোকিত, যাতে সবার মঙ্গল, তার পথ চিরকালের মত আটকে রাখা যায় না! যুদ্ধ বাধবেই।
প্রাণের সেই গভীরের স্পন্দনের কাছেই মাথা নীচু করি। মাথা নীচু করি তাঁদের সামনে যাঁরা এই স্পন্দনের মূর্ত রূপ। প্রতিদিন একটু একটু করে আমার বুদ্ধি, যুক্তি, ইচ্ছাকে এই স্পন্দনের অনুকূল করে তোলাই সাধনা। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতেন, 'বড় আমি'কে 'ছোট আমি'-র পায়ে সঁপে দেওয়ার সাধনা। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, 'কাঁচা আমি'কে 'পাকা আমি' করা। যীশু বলতেন, বীজকে নষ্ট করে গাছকে জন্ম দেওয়ার কথা। আর বাউল? বাউল বললেন, মনের মানুষের খোঁজ করা।


(ছবিঃ সুমন দাস)