Skip to main content
 
 
"আমি যাকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তার জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি।"
~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
 
       স্বর্গ আছে, ঈশ্বর আছে, দেবতা আছে, আত্মা আছে, ঈশ্বরকোটি-জীবকোটি আছে... এরকম কথা আমাদের অনেকেই বলেছেন। আমরা বিশ্বাস করতে চেয়েছি। করে পারিনি। কোথাও সে বিশ্বাসের সাথে আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা মুখোমুখি রণংদেহি মূর্তি ধারণ করেছে। বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয়নি, কারণ অবশেষে কিছু প্রত্যক্ষ হয়নি।
       বুদ্ধ সে কথা শোনালেন না। বললেন, দুঃখ আছে। এই কথাটা ক্লাস নাইনের ইতিহাস বইতে পড়ে খুব অবাক লেগেছিল। এ কি এমন কথা যে একে মূল সত্য না আর্যসত্য ইত্যাদি বলতে হবে? জীবন গড়াতে লাগল। ছোটো ছোটো সুখের রেশমী রোঁয়াগুলো খুলে খুলে যেতে লাগল। কিছু পুড়ে গেল, কিছু হারিয়েও গেল। বারবার একটাই কথা সত্য হয়ে কানের কাছে বাজতে লাগল, দুঃখ আছে। বুঝলাম, এ ফাঁকির কথা নয়, ভাবের কথা নয়, বিশ্বাসের কথা নয় অভিজ্ঞতার কথা। স্বীকার করার কথা দুঃখ আছে। যত পোড় খেতে লাগলাম, তত মর্মে মর্মে অনুভব হতে লাগল, দুঃখ আছে। সুখ পেলাম না, মনের মধ্যে একটা প্রবোধ পেতে শুরু করলাম। কারণ একটা আছে। দুঃখের ত্রাতা সুখ হয় না, হলেও সে স্থায়ী হয় না। দুঃখের আসল ত্রাতা সান্ত্বনা। যার আরেক অর্থ প্রসন্নতা। শান্তি। 'সান্ত্ব' শব্দটার অর্থ হল 'শান্তি'। যার ইংরাজি 'কনসোল' শব্দটার উৎস ফ্রেঞ্চ 'কনসোলার', ল্যাটিন 'কনসোল্যারিও' শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ, শান্তি বা আরাম দান করা। 
       দুঃখ আছে। অর্থাৎ আমার সাথেই কেন”... ”আমিই কেন”... ”দুঃখ কেন”... ”এত দুর্ভোগ কেন”... ইত্যাদি কথাগুলো খুব জোরের সাথে মাথা তুলতে পারল না। দুঃখের নিজের ভারের চাইতে তাকে অস্বীকার করা আর তার বিরুদ্ধে ছায়ার সাথে লড়ার মত একটা নির্বোধ লড়াইয়ের হাত থেকে যেন রেহাই দিলাম নিজেকে। সুখ এল না, শান্তির প্রলেপ পড়তে শুরু করল। 
       এর পর বলা হল, এই দুঃখের কারণ আছে। সে কারণ হল তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার পথও আছে। এই হল মূল চারটে সত্য। কিন্তু প্রথম কয়েকটা সত্য যেন নিউ জলপাইগুড়ি নেমে, দার্জিলিং বা কালিপঙ বা গ্যাংটক যেতে পাহাড়ি ঘুরপথে যাওয়ার ধকলের মত। নেওয়াই যায়। কিন্তু শেষ কথাটা? তৃষ্ণা বা বাসনা ছাড়া আমার অস্তিত্ব কই? আমি তো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হতে আসিনি রে বাবা! অনেকে যেমন উদাহরণ দিয়েছেন, এ যেন মাথাব্যথা বলেছি বলে পুরো মাথাটাই কেটে বাদ দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব।
       তৃষ্ণা বা বাসনাত্যাগের তৃষ্ণা বা বাসনা কাউকে টেনেছে বলে আমার আজ অবধি বিশ্বাস হয় না। মানুষকে যা চিরটাকাল টানে সে হল আনন্দ। সুখ আর আনন্দের মধ্যে মূল পার্থক্যই হল, সুখ পরিপূর্ণতার আশ্বাসে বাঁচে না, ক্ষণিকের জন্য বাঁচে; তাই তার এত তীব্রতা, ভয়, আশঙ্কা। সে গদিরই হোক, কি ক্ষমতারই হোক, কি ভোগেরই হোক, কি মতবাদের মত্ততারই হোক, কি অলীক স্বপ্নেরই হোক... কিছুতেই কিছু আসে যায় না। আনন্দ বাঁচে পরিপূর্ণতায়। তাই সে অসামঞ্জস্যকে ছেড়ে দিতেও রাজী হয় নির্মমভাবে। যেমন গান্ধারীর আবেদন’-এ বারবার বলেছেন দুর্যোধনকে ত্যাগ করার জন্য। সেই ছেড়ে দেওয়াকে বাইরের অসম্পূর্ণ দৃষ্টিতে বলে ত্যাগ। যেন খুব নীরস একটা কথা। নবজাত অঙ্কুর কি বীজকে ত্যাগ করার জন্যেই ত্যাগ করে? না তো! তাকে আকাশের আনন্দ, আলোর আনন্দ, বাতাসের আনন্দ অনবরত আঘাত করে করে উদ্বেল করে তোলে না? সেই জন্যেই সে বাইরে আসার জো খুঁজতে বীজকে ত্যাগ করে। তেনজীং নোরগে-ই হোক, কি আইনস্টাইন-ই হোক, কি দ্য ভিঞ্চি-ই হোক --- তারা যে কঠিন তপস্যাকে বরণ করে নিয়েছিলেন সেকি কঠিন বলেই? না কিছু এক অদম্য আনন্দের প্রেরণায়? এনারা না হয় মহাপুরুষ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও কি এর উদাহরণ যত্রতত্র ছড়িয়ে নেই? সুখ যখন বিবশ করছে, আমার আত্মসম্মানের দিকে কালো হাত বাড়িয়ে আনছে, আমার দুর্বলতাকে ব্যবহার করতে চাইছে, পিষে মেরে ফেলতে চাইছে আমার ব্যক্তিত্বকে, স্বাধীনতাকে... আমি কি প্রতিবাদ করিনি? প্রাণের বস্তুকেও ছেড়ে দিইনি স্বস্তির দিকে তাকিয়ে? সেই স্বস্তিই আমার প্রসন্নতা, আমার আনন্দ, আমার নির্জন একাকীত্বের নির্বাণ। নিজেকে বারবার মেরে ফেলে নিজেকে বারবার জন্ম দিয়েছি তো আমিই। কি যন্ত্রণায় অসহ্য রাতগুলো কাটিয়ে কোনো একদিন ভোরবেলায় বলে উঠেছি – ‘আর না। যা হবার হবে’... কিসের জোরে বলেছি সে কথা? আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে একটা বড় হ্যাঁশুনতে পেয়েছি শান্তির দিকে, আনন্দের দিকে, অনাড়ম্বরের দিকে। সেই আমায় জোর দিয়েছে। সেই আমার বোধ। আমার শুদ্ধতা। আমার চৈতন্য। আমার মধ্যে যাই শুদ্ধ তাই চৈতন্য। কারণ আলো কোনোদিন মিথ্যা হয় না। তেমন চেতনা কখনও অশুদ্ধ হয় না। মানুষকে তাই আজ অবধি যা পরম শক্তি দিয়ে এসেছে, তা সুখ না, দুঃখ স্বীকারের আনন্দ।
       আর্নেস্ট হেমিংওয়ে'র কথায় "Man can be destroyed but not defeated." এ সত্যিটা 'Old Man and The Sea'-তে যে প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে তা দুঃখকে জয় করার তাগিদেই। দুঃখ চেতনারও হয়, দুঃখ লোভেরও হয়। বিশ্বের যতগুলো ক্লাসিক সাহিত্য দেখা যায়, সেখানে মানুষ তার লোভের দুঃখকে জয় করে মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণতার আকাঙ্ক্ষার দুঃখকে বরণ করে নিচ্ছে এমনটাই সত্য হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যখন বলছেন মৈত্রেয়ী দেবীকে 'মহৎ দুঃখের' যোগ্য হয়ে উঠতে তখন সে আশীর্বাদ। দুঃখকে এড়িয়ে যদি মানুষের গৌরব থাকত তবে বিশ্ব সংসারে মানুষের রচিত সমস্ত মহাকাব্যগুলো ব্যর্থ হত। 'সুখই মানুষের সবটুকু জুড়ে আছে' - এতবড় মিথ্যাকথা বলতে সমস্ত মহাকাব্য ঘৃণা করেছে বলেই মানুষকে সে দুঃখের মধ্যে বড় দেখতে চেয়েছে। বিলাসিতায় নয় - দহন দানে সে মহৎ। যে দহনদানের শিখাটি নির্বাপিত হলে, সমস্ত তাপটুকু নিঃশেষিত হলে যা থাকে তাকে বুদ্ধ বললেন - নির্বাণ। সে দানের শূন্যতা নয়, পূর্ণতা। আমার সবচাইতে বড় সম্পদ - বোধের সন্তোষ।
 
 
"দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।।
জ্বলতে দে তোর আগুনটারে, ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন জ্বলবে না আর কভু তবে।।
এড়িয়ে তাঁরে পালাস না রে ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর।
মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে,
তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।।" 
~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
 
(ছবি: সুমন)