সৌরভ ভট্টাচার্য
26 May 2020
যেন আমার দোষ। যেন আমার অপরাধী না হলেই নয়। যেন আমায় বলতেই হবে, হ্যাঁ আমার ভুল ছিল।
দোষ খোঁজার দরকার নেই। রামকৃষ্ণদেব সংসারীকে পাঁকাল মাছের মত সংসারে থাকতে বলেছেন, যাতে গায়ে পাঁক না লাগে। ভালো কথা, কিন্তু পাঁক ছোঁড়াছুড়ি করতে তো বলেননি? আমি নিজেকে পাঁক থেকে বাঁচানোর জন্য অন্যের গায়ে পাঁক ছুঁড়ে দেব, এটা কি খুব ন্যায়ের কথা হল?
ইংরাজিতে একটা কথা প্রচলিত আছে - Toxic Person. এই টক্সিক মানুষ মানে কি? মানে হল যে আরেকজনকে কোনো না কোনো আছিলায় দোষী, অপরাধী সাব্যস্ত করে ছাড়ে। ছাড়ে? না ছাড়ে না, ঘ্যানঘ্যান করেই চলে, করেই চলে। কোনোভাবে কাউকে নীচু, ভুল ইত্যাদি প্রমাণিত না করে সে নিজের মতামত ব্যক্ত করতেই পারবে না। একে বলে টক্সিক মানুষ। এখন এই টক্সিক মানুষের সাথে যে মানুষগুলোর নানাবিধ সম্পর্ক, বোঝাই যাচ্ছে তাদের গতি কিরূপ হবে। আমায় একবার একজন কথায় কথায় বলেছিল, "এই জন্যে তোমার কিছু হল না।" গোত্তা খাওয়া কথা। তার সাথে আমার বেশ দীর্ঘদিনের পরিচয়। আমায় ভালোভাবেই চেনে। তাই কথাটা বেশ ভেবে দেখার মত। একটু ভাবতেই ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হল। সে বেশ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। কিন্তু আমি নই। আমি নেহাতই মাস্টার। তার উপর আমি যদি আমার মতামত স্পষ্ট করে জানাই, এবং সেই মতামত যদি আমার আত্মমর্যাদাবোধ ও উক্ত ব্যক্তির অহমিকাবোধ একে অন্যের বিপরীতে দাঁড়ায়, তবে টক্সিসিটি বাড়বে বই কি! তাই সে বলে বসল, কি জানো, আমার যার সাথেই পরিচয় হয় আগেভাগে তার দুর্বল জায়গাগুলো জেনে নিই, তারপর ব্যাগড়বাই করলেই সেখানে মারি খোঁচা। এই যেমন আমার অফিসে, উনি ফেসবুকে কবিতা লেখেন, তা আমার চাইতে তার লাইকের সংখ্যা ঢের কম, আমি সেদিন অফিসে দেরি করে গেছি বলে যেই না কথা শোনাতে এসেছে, দিয়েছি মোক্ষম - "বলি আপনার লেখায় ক'টা লাইক পড়ে? আমার দেখেছেন?....."
অগত্যা সে এইসব বলে ক্ষান্ত হল। আমিও মানে মানে তাকে বকিয়ে ক্ষান্ত দিলাম সেই যাত্রায়। যদিও সে অনেককাল আগের কথা, আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল। একজন এসে সারাটা দিন হাপিত্যেশ করে জানালো, সে যাকে ভালোবাসে, সে নাকি তাকে ভালোবাসে না, তা না, অস্পষ্টতায় ভালোবাসে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, সে কেমন ভালোবাসাবাসি? সে যা বলল, ঘটনাটা এই...
সে যখন কলেজে পড়াত তখন একখেন ছাত্রীকে তার মনে ধরে। ভালো কথা। মন যখন আছে তখন ধরবেই। হয় ব্রহ্মজ্ঞান, নইলে সংসারজ্ঞান - একদিকে গতি তো হতেই হবে। তা সে মেয়েও নাকি তাকে মেসেঞ্জারে 'হামিটামি' দেওয়া ইমোজি পাঠাত।
এই অবধি যেই না বলেছে অমনি আমার জ্যাঠা মন আমার কাঁচা মনের দিকে ভুরুটুরু কুঁচকিয়ে তাকালো - মানে হচ্ছে, ইয়ে তুমি কাউকে এরকম 'হামিটামি' মার্কা ইমোজি পাঠিয়েছ কি? আজ্ঞে বিস্তর পাঠিয়েছি। আমার কাঁচামন মাথা নীচু করল। না না লজ্জায় নয়, চোখাচোখি এড়াতে।
আবার গল্পে ফেরা যাক। সে বলে চলল, কিন্তু যেই না তার কলেজ শেষ হল অমনি সে কেমন পাল্টে গেল।
আমি মনে মনে ভাবলুম, গেল তো গেল আপদ গেল। আমি বলে এদিকে ঝড়জল, করোনা, ছাত্রছাত্রী নিয়ে সামাল দিতে জেরবার হচ্ছি, ইনি এলেন বৃন্দাবনলীলা নিয়ে। উফ! যেই না ভাবা অমনি কল্পনায় দেখলুম রাস চলছে, সব্বার মুখে মাস্ক বাঁধা.... মায় রাধা অবধি, রাধার মাস্কে একটি শিখীপাখা আঁকা যাতে কৃষ্ণ চিনতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল সব গোপীরাই শিখীপাখা মাস্ক পরে ফিল্ডে নেমেছে। ব্যস, এবার কৃষ্ণ যায় কোথায়? হলেন না হয় তিনি অন্তর্যামী, কিন্তু অন্তরে তো সবারই এক আত্মা শুনেছি, ফলে সেখানেও তিনি যুত করতে পারলেন না। তার মনে পড়ে গেল বালী-সুগ্রীবের মারামারি আগের অবতারের সময়ে, মানে রামের কেসে যা হয়েছিল। কিন্তু এই বার?
উফ্... কি কথায় এসেছি দেখলেন, কথা হচ্ছিল প্রেম রাস নিয়ে আমি চলে এলাম বানর নিয়ে, করোনা-উম্পুন-পঙ্গপালে মাথা কি আর ঠিক থাকে বলুন? যা হোক। তা গল্প হল প্রেমিকা আবার ফিরে এল.. আর শুরু হল বাইপোলার প্রেম।
না না, এই নামটা তার দেওয়া নয়। আমার দেওয়া। বাইপোলার প্রেম কেমন? অনেকটা গেছোদাদার মত। যখন মনে করবে সে তোমায় ভালোবাসছে তখন আসলে সে তোমায় ভালোবাসছে না। আবার যখন মনে করবে সে তোমায় ছেড়ে গেল, হঠাৎ তার ঘামের কি ডিও-র গন্ধ তোমার নাকে, অর্থাৎ সে এসে পড়েছে আবার!
আমি বললুম, তা কয়েকটা হামির ইমোজিতে তুমিও বা এমন টসকে যাচ্ছ কেন চাঁদু?
সে লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ইয়ে মানে শুধুই কি ইমোজি?
আমি ধাঁ করে জানলার দিকে তাকালাম। বাইরে মেঘ করেছে আকাশে, হে বাবা শঙ্করাচার্য, আমায় অদ্বৈতজ্ঞানে অন্তত এই মুহূর্তের জন্য কানেকশান দাও বাবা... আমায় আরো কি শুনে ফেলতে হয়... আমার লজ্জা রাখো বাবা... মোহমুদগরটি দাও বাবা, হয় এর মাথায় মারি নয় নিজের মাথায় মেরে অজ্ঞান হই।
সে আরো বলছে। আমার জানলার পর্দা সজল হাওয়ায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সে বলছে....
কিন্তু সে আমায় বড় অপমান করে...
আমি বললুম, ভালোবেসে? না, না ভালোবেসে?
সে একটু ভেবে বলল, দুটোই।
বললুম, কি বলে?
সে বলল, সে তার মুডের উপর চলে। আমায় না ধরে না ছাড়ে....
আমি বললুম, তা তুমি ধরা খেতে চাও না ছাড়া পেতে...
সে বলল, আমি জানি না।
তাকিয়ে দেখি তার ছলছল চোখ। মানে মনে ব্যথা। সাথে ভালোবাসা। তার সাথে অপমান। তার সাথে সম্পর্কের ভবিষ্যতের কুজ্ঝটিকা।
বললাম, বেরিয়ে এসো।
সে অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, হুম।
সে চলে গেল। তখন বাইরে রীতিমতো ঝোড়ো হাওয়া। আমি ভাবলাম তাকে ডেকে বসতে বলি। বললাম না। যা ঝড় তার ভিতরে। ওকে শান্ত করি আমার এমন ক্ষমতা নেই। একবার ভাবলাম বলি, নিজের মর্যাদা থাকে না যেখানে সেখানে যাকে ভালোবাসা বলছ, সেকি মোহ নয়? মানুষ নিজেকে অপমানিত একমাত্র মোহের বশে করে। সেটুকু না করলেই নয়? সারাদিন কত মানুষকে দেখি অন্যকে সুখী করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি কাউকে কিছুক্ষণের জন্য আনন্দ হয় তো দেওয়া যায়, কিন্তু কাউকে সুখী বা দুঃখী করা কি সত্যিই আমাদের হাতে? সে যে হয় আপনিই হয়, যে না হয় তাকে স্বর্গে রাখলেও বলবে, হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে...
কিন্তু মোহতে বুঝতে দেয় না, মর্যাদা বস্তুটা খাঁটি, ভালোবাসাটি নয়। ও বস্তু নিয়ে বেশি মাতামাতি করলে ভালোর চাইতে মন্দই ঘটে বেশি।
সে বাড়ি ফিরে ফোন করল, আজ ভালোভাবে কথা বলেছে বলে নাকি সে সুখী.... কি আনন্দ...
হায় রে হায়.... বাইরে বেশ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আমি বরং বৃষ্টি দেখি। কারেন্ট নেই। ঝড়ের জন্য। কে কোথায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরে... কিন্তু তবু তো কেউ কেউ ঝুঁকি নেয়... বেশিই ঝুঁকি নেয়...
যাক গে এসব তত্ত্বকথা, আমি বরং কৃষ্ণ তার রাধাকে খুঁজে পেল কিনা দেখি....