Skip to main content

হু এর সংজ্ঞায়, জননগত স্বাস্থ্য বলতে দৈহিক, মানসিক, সামাজিক সুস্থতা বোঝায়। সমাজে যারা আর্থিকভাবে, শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে তারাও যেন সঠিকভাবে জননগত স্বাস্থ্যের পরিষেবা পায় সেটা দেখার।

কিন্তু এই সামাজিক দিকটাকে ভাবার জন্য অনেকগুলো দিক আছে। তার একটা প্রধান হল ধর্মীয় সংস্কার। মানুষের মধ্যে একটা ধর্মীয় সংস্কারজাত শুদ্ধতার বোধ আছে। যেটা হাইজিনগত নয়। মনের ভাবনাগত। সেই ভাবনার একটা দিক জন্ম দেয় ভায়োলেন্সের। কাজে ভায়োলেন্স পরে হয়, আগে হয় ভাবনায় ভায়োলেন্স। ভায়োলেন্স মূলক কাজকে শাস্তি দেওয়া হয় ঠিকই অনেক ক্ষেত্রেই, কিন্তু ভাবনাকে পাল্টাতে পারে সঠিক শিক্ষা।

সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের শুরু হয় পুরুষের অবচেতনে লালিত, আমি উন্নত, এ ভাবনা থেকে। সমাজের ইতিহাসে মেয়েদের উপর সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের তথ্য ঘাঁটলেই পাওয়া যায়।

মেয়ে মানেই অশুদ্ধ। নরকের দ্বার। এসব ভাবনা নানাভাবে আছেই। এখানে একটা জিনিস খেয়াল করার, ধর্মীয় শুদ্ধতার ভাবনা একটা ক্ষমতায়নের উপায়। আমি তোমার থেকে বেশি শুদ্ধ মানে, আমি জগত স্রষ্টা ও পালকের বেশি কাছাকাছি। ফলে আমি বেশি ক্ষমতাশীল। হাইজিনের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক নেই, যোগ্যতা অর্জনের সম্পর্ক আছে। কিন্তু ধর্মীয় শুদ্ধতা বোধের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। প্রভাবের সম্পর্ক আছে।

হাইজিন মানে যোগ্যতার সম্পর্ক অর্থে, একটা সদ্যজাত বাচ্চাকে ছোঁয়ার অধিকার তখনই জন্মায় যখন আমি আমার হাতটা সাবান দিয়ে ধুয়ে নিয়েছি। এখানে আরেকটা জিনিস খেয়াল করার যে এই যোগ্যতা অর্জন সার্বিকভাবে মঙ্গলের। কোনো মানুষ, পরিবার, পাড়া যদি হাইজিন পালন করে তবে তা সবার জন্য ভালো।

কিন্তু ধর্মীয় শুদ্ধতার সুবিধাটা ব্যক্তিগত। আমি যত শুদ্ধতা অর্জন করছি, আমি তত স্রষ্টার কাছাকাছি যাচ্ছি। অর্থাৎ আমি বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হচ্ছি।

ধর্মের ইতিহাসে মেয়েদের অশুদ্ধ করে দাগিয়ে দেওয়ার কারণ এটাই, তাদের ক্ষমতাকে কমিয়ে আনা। তাদের তাই নিজের শুদ্ধতাকে কায়েম রাখতে এত চেষ্টা। এবং এই শুদ্ধতার ধারণার বীজ ওই যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্ষণ তাই এক আদিম অস্ত্র। সেটা যতটা না শারীরিক ভায়োলেন্স, তার থেকে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে ওই শুদ্ধতার বোধকে ধুলোয় মিশিয়ে একজন মেয়েকে সম্পূর্ণ অসহায় করে তুলতে।

দিন বদলিয়েছে। কিন্তু মনের গোপনে এই ধর্মীয় শুদ্ধতার প্রতি আসক্তিটা যায়নি। যার মূল যৌন জীবনের সঙ্গেই। আজও অনেক মানসিক বিকার এই অযৌক্তিক পাপবোধ তথা অশুদ্ধবোধ থেকে জন্মায়। যার বাইরের প্রকাশ কোনো না কোনোভাবে ভায়োলেন্স। ধর্মীয় অনেক আচারও এই ভায়োলেন্সরই নামান্তর। মোড়কটা শুদ্ধতার। এবং দেখা যায় তার বেশিরভাগই মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য। অনেক প্রকার OCD এই ধর্মীয় শুদ্ধতার প্রতি অযৌক্তিক আসক্তি থেকে জন্মায়। প্রথমে জন্মায় অযৌক্তিক ভয়। ক্রমে সেই ভয় ডালপালা মেলে হয় ভায়োলেন্স। ভয় নিজেকে রক্ষা করতে সব সময়ই ভায়োলেন্সকে ব্যবহার করে। সে কুকুর হোক চাই মানুষ। ভয় আর ভায়োলেন্সের যোগাযোগ আদিম।

পুরুষ পেশীর জোরে যৌনতায় প্রিভিলেজড। তাই শুদ্ধতাবোধেও প্রভিলেজড। সে নির্ধারণ করে দেয় শুদ্ধতার মাপকাঠি। যা ক্ষমতায়নের আরেকটা অস্ত্র। আপাতভাবে যা সফট অস্ত্র।

আজ এই যৌনতার ভায়োলেন্স আরেক দিকে বইছে। আমরা বেশ কিছু দশক ধরে সবাই জানতে পারছি মানুষের যৌনতা বৈচিত্র্যময়। এবং সে সবকটাই স্বাভাবিক ও সুস্থ। আমরা এখন এগুলোকে হেনস্থা করার নানা উপায় খুঁজছি।

দুদিন আগে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় পড়লাম, চলন্ত ট্রেনে এক মহিলার প্রসবযন্ত্রণা উঠেছিল। কোনো "সাধারাণ" মানুষ এগিয়ে আসেননি। এসেছেন "ট্রান্সজেন্ডার" মানুষেরা। এবং তারা প্রসব করিয়ে দেওয়ার পর কিছু আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটাও খুব নম্রভাবে প্রত্যাখান করেন সদ্যজাত বাচ্চাটির বাবা।

খবরটার মধ্যে ওই "আমরা ওরা" ভাগটা স্পষ্ট ছিল। ভাষায়। মানুষের দুটো শরীর হয়। চামড়া ঢাকা রক্তমাংসের শরীর আর ভাষার শরীর। আমাদের ভাষার ভায়োলেন্সকে ঢাকা খুব শক্ত। কারণ আমাদের ভাবনার ভাষায় ভায়োলেন্স। আমরা জানি আমরা শুদ্ধ, ওরা অশুদ্ধ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে খেলাটা বদলে গেল। শুদ্ধতার দ্বন্দ্বটা নারী-পুরুষ না হয়ে মেজরিটি বনাম মাইনরিটি হয়ে গেল। এবং সেই এক মূল, যৌনতা। তাদের অন্য রকম। তাই তারা অশুদ্ধ। "ওদের হাতে খাওয়া যায়? ওদের পাশে বসে খাওয়া যায়".... ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। সংশয়। আপাত ভাবে নিরীহ। কিন্তু ভীষণ সাংঘাতিক।

অনেক লিখে ফেললাম। আবারও বলি, এই ধর্মীয় শুদ্ধতাবোধটা আসলে যৌনতার বোধজাত। পুরুষের পেশীর প্রিভিলেজে কখনও পুরুষ বেশি শুদ্ধ, কখনও মেজরিটির জোরে মেজরিটি বেশি শুদ্ধ, মাইনরিটি অশুদ্ধ। এবং আবারও বলি, এই শুদ্ধতা ক্ষমতায়নের একটা অস্ত্র। সামাজিক ক্ষমতায়ন। পশুর যেমন আছে জঙ্গল, আমাদের তেমন আছে সমাজ। লড়াই তো চলবেই দখলের। তার অস্ত্র এই "হোলিয়ার দ্যন দাও" এর লড়াই।

এই সম্বন্ধে সচেতন হওয়াই এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রাস্তা। মনে রাখার আছে, আমাদের ভাবনায় ভায়োলেন্স আছে বলেই আমাদের কাজে ভায়োলেন্স আছে। আমাদের ভাবনা বদলাবে শুদ্ধবুদ্ধি আর সৎসাহসের প্রয়োগে। একদম গ্রাউণ্ড লেভেল থেকে।

শেষে একটা কথা দিয়ে শেষ করি। আমি অনেকবার ধর্ম শব্দটা লিখলাম। এখানে অবশ্যই তা প্রচলিত অর্থে। একটা প্রাতিষ্ঠানিক আচারবিচার অর্থে। ধর্ম যেখানে জাস্টিস আর সৎ জীবনের প্রেরণাদায়ক সেখানে সে আলাদা। কিন্তু সে অন্য আলোচনা। সেখানে সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে দেখতে শেখাটাই মূল সত্য।