Skip to main content

        মনের উপর বোধের নিয়ন্ত্রণ থাকবে - এমন কথা ছিল সভ্যতার মূলে। কিন্তু সভ্যতা বলতে কি বোঝানো গেল? বলা হল যা মার্জিত, যা ভদ্র। ভদ্র অর্থাৎ মার্জিত। যা দোষমুক্ত। দোষ কি? এই কথাটার মীমাংসা হয়ে ওঠেনি এখনও। যদি একমাত্রিক আলোচনায় আসা যায় তবে একটা দোষের সংজ্ঞা দাঁড় করানো যায়। যার চূড়ান্ত নিদর্শন - ধর্ম। ধর্মের মধ্যে সব কিছুর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আছে, যে সিদ্ধান্তগুলো মেনে চললে এই জীবনে ও পরজীবনে পুরষ্কারের আশা আছে। বেশিরভাগ মানুষ এই চূড়ান্ত নির্দেশের দাস হয়ে বাঁচতে চায়, প্রাচীনযুগেও চেয়েছে, আজও চেয়ে চলেছে। মানুষের গুরু, দেবতা, নেতা, শাসক ইত্যাদি কোনো না কোনো রূপে একজন চূড়ান্ত কাউকে চাই। যার উপরে কিছু থাকবে না আর। আসলে বেশিরভাগ মানুষই ধার্মিক হয়েই জন্মায়। ধার্মিক মানে আমি নীতিবান বা নৈতিকরূপে উৎকৃষ্ট মানুষকে বোঝাচ্ছি না। আমি বলতে চাইছি চরমবাদী মানুষ, যে সবকিছুর একটা একমাত্রিক ব্যাখ্যা চায়। সমস্ত সমস্যার একটাই সমাধান সূত্র খোঁজে। ঈশ্বরকে বা ঈশ্বরপ্রেরিতকে তুষ্ট করা। কারণ মানুষের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের মূল নিহিত। ধর্মবিশ্বাস মানে বিনা চিন্তায় কাউকে একজন অথোরিটি মেনে আত্ম-স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে, একটা কাল্পনিক নিশ্চিন্ততায় দিন কাটানো। ঈশ্বরের তুষ্টি আর ক্রোধের উপর তার জীবনের সব সুখ দুঃখের ব্যাখ্যা তখন। কিন্তু কাজটা যেহেতু অতটা সোজা নয়, তাই ঈশ্বরের তুষ্ট-রুষ্ট হওয়ার গতিবিধিকে রহস্যময়, বোধের অতীত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে।
        হয় মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নয়ত কারোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে ভালোবাসে। দ্বিতীয়পক্ষের মানুষ নিয়েই সংসার। তার নিজের সব চাইতে বড় দায় হল তার আবেগ। সংসারকে বায়ুশূন্য কল্পনার চেষ্টা করা আর মানুষকে আবেগশূন্য ভাবার চেষ্টা করা একই কথা। আবেগ তার দায় কেন? কারণ আবেগ যতটা শক্তিশালী ততটা প্রজ্ঞাবান নয়। আবেগের মন্ত্রণায় বহু ক্ষতির সাক্ষী মানুষের ইতিহাস। কাম-ক্রোধ-লোভ ইত্যাদি যে ষড়রিপুর কথা যে আছে, সে আবেগেরই এক একটা তীব্ররূপ। তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আস্তিক জানে ঈশ্বর কিছু আবেগ পছন্দ করে আর কিছু আবেগ পছন্দ করে না। সেই অনুযায়ী সে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য তা পেরে ওঠে না। বিবেকযন্ত্রণায় ভোগে। বিভিন্ন ধর্মীয় পুরুষেরা সেই বিবেক যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য নানা বিধান দেন। সুক্ষ্ম শোষণপদ্ধতির উদ্ভাবন হয়। অলক্ষ্য শাসকের, ধর্মীয় পুস্তকে লিখিত বিধানের খেসারত দিতে হয় তাকে, তাও একটা নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসের পরিমণ্ডলে জন্মানোর দরুন।
        এতো গেল ধর্ম আর সভ্যতার বোঝাপড়া। না চাইলেও ধর্ম আর রাজনীতি থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবমুক্ত থাকা কারোর পক্ষেই অসম্ভব। তবে যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম - সভ্যতা। ভদ্র হওয়া। মার্জিত হওয়া, দোষমুক্ত হওয়া। কেউ কেউ বলেন সদগুণের আচরণে ক্রমে উৎকর্ষতার দিকে এগোনোর কথা। একই কথা। উৎকর্ষ মানেই হল অপকর্ষ মুক্ত, অর্থাৎ সেই দোষমুক্তি'র কথাই প্রকারান্তরে। তবে দোষ কি? এই থেকেই ধর্মের আলোচনায় ঢুকেছিলাম। বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গীতে দোষ কি? যা বহু পর্যবেক্ষণে ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়, প্রমাণিত - তাই দোষ। খুব সাধারণ উদাহরণ নেওয়া যাক, সূর্যগ্রহণে খাদ্যগ্রহণ নিষিদ্ধ - ধর্মীয় শাসন বলল। বিজ্ঞান তার পর্যবেক্ষণে বলল - হয় না। পর্যবেক্ষণ, মনন আর জিজ্ঞাসা - এই বিজ্ঞানের মূল। বিশ্বাস, আনুগত্য আর একদেশিতা - এই ধর্মের মূল। একটা জিজ্ঞাসা দ্বারা চালিত, আরেকটা ভয় দ্বারা। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, কেউ যদি বলেন, তবে কি প্রেমের ধর্ম বলে কিছু হয় না? না হয় না। কেউ কেউ অপার্থিব মানবপ্রেম দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে তার অনুসারীরা যে সেই একই অনুপ্রেরণায় আন্তরিকভাবে সিক্ত হবে এমনটা ইতিহাসে কোথাও দেখা যায় না। খ্রীষ্ট, বুদ্ধ, মহাপ্রভু'র অনুসারীরা যে যে ধর্মের গোষ্ঠী বানালেন সেই সেই ধর্মের কারণেই বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে শুধু না, বহু মানুষ উৎপীড়িত হয়ে আসছে তাদের সেই মহামানবপ্রেমের গোষ্ঠীবৃন্দের আন্তঃঘৃণার জন্য।
        তবে ধর্ম টিকে রইল কেন? প্রতিটা ধর্মের গঠনগত তিনটে দিক আছে। এক, অলৌকিক গল্প; দুই, নীতির অনুশাসন; তিন, একটা মানবগোষ্ঠী বানানোর ক্ষমতা। এই তিনটে ধর্মের গঠনগত স্তম্ভ। এই স্তম্ভগুলো এক এক ধর্মে আলাদা হলেও, দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে অনেকটা এক। প্রেম, করুণা, সহমর্মিতা, সত্যপরায়ণতা ইত্যাদি সদগুণের প্রতি আনুগত্য দেখানোর কথা সব ধর্মেই আছে। সেই থেকে বহু উচ্চগুণসম্পন্ন মানুষ জন্মিয়েছেনও সব ধর্মে। তাই ধর্মকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে কোনো সভ্যতাই কোনোদিন গঠন করা সম্ভবপর নয়। মনে রাখতে হবে দেশের কয়েকজন মনীষীকে নিয়ে একটা দেশ নয়। সেই দেশের সাধারণ মানুষ নিয়েই সেই দেশের চরিত্র। ঈশ্বরে বিশ্বাস কমবে হয়ত, কিন্তু তার জায়গায় অন্য আরেকজন শাসক এসে বসবে, কারণ সাধারণ মানুষ কোনোদিনই চিন্তায় স্বতন্ত্র হতে চাইবে না। তার একটা না একটা মাথা নীচু করার জায়গা লাগবেই। মানুষের কাছে তার পরিখাহীন স্বাধীনতা বিষম বালাই যে। তাই ধর্মান্ধতার জায়গায় রাজনীতি, বিশেষ কোনো মত বা দর্শন ইত্যাদি নিয়ে মানুষ দল বানাবেই, গোষ্ঠী বানাবেই। কিছু না কিছুর প্রতি তার অন্ধ আনুগত্য থাকবেই। কারণ ওই যে শুরুতে বললাম, মানুষ ধার্মিক হয়েই জন্মায়। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন নানা জিজ্ঞাসায় সংসারের এই অভ্যস্ত অচলায়তনে মাথা কুটে মরবে, উত্তর খুঁজতে চাইবে, পর্যবেক্ষণ আর মননকে আত্মশক্তি বানাতে চাইবে। যুগান্তরের ভিতে দাঁড়ানো এই পাঁচিলটার গায়ে একটা ছিদ্র করতে চাইবে। প্রথম প্রথম চাইবে পুরো সংসারটাকে সেই ছিদ্র দিয়ে বাইরে নিয়ে আসতে। খানিক পরে বুঝবে সে ভুল ছিল, তার মৃত্যুর পরেই সেই ছিদ্র বন্ধ করার জন্য বহু মানুষ সিমেন্ট-বালি নিয়ে অপেক্ষায় আছে। এতো আলোয় তাদের ভয়। সংসার জাগতে চায় না। কারণ সংসার জানে জাগলে সুখ নেই। খুব কম মানুষই বোঝে, সুখটা জেগে ওঠাতেই, জেগে উঠে পাওয়া না পাওয়ার হিসাবে নয়।