Skip to main content
 
বিগ্রেড মঞ্চ, থুড়ি, বেলুড় মঠের মঞ্চ থেকে স্বামীজির স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণের ভাষণ শুনলাম। ডিজিটাল ইন্ডিয়া, CAA বিষয়ে সমস্ত 'যুবা ভাই' সমস্বরে হাত তুলে প্রধান নেতৃত্বের সহযোগিতায় আছে জানিয়ে দিল। পাশে বসে দুই পূজ্যপাদ ( পাদ মানে পা, অবশ্য পা যদি পূজ্য হয় অপর অর্থটিই বা হবে না কেন?), পূজ্য নিতম্ব ঠেকিয়ে আসনে, স্থিতপ্রজ্ঞ। স্থিতপ্রজ্ঞ মানে কি? আহা, যারা সুখে দুখে, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীতে ভেদ করেন না, যারা স্বামীজির সেই অমোঘ বাণী - বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, মন্ত্রীকূল সেবে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর, পালন করেন তারা হলেন স্থিতপ্রজ্ঞ।
       যা হোক, প্রতিষ্ঠান আর প্রটোকলের নানা বাধ্যতা আছে নাকি। আমাদের তেমনই বুঝানো হয়। আমাদের না বুঝে উপায়ও নেই। সব দিক রেখে সবাই চলছে। আবার তেনারাই আশাও রাখছেন কেউ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের আর কেউ সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে।
       তবে আজ স্বামীজির জন্মদিন কিছু লিখব না? নিশ্চয়। আসলে কি জানেন, আমি যেমন পঁচিশে ডিসেম্বর, সেই মহাপ্রাণের জন্মদিন পোপের ভাষণ শুনি না, কোনো চার্চে যাই না, তেমনই কোনো আদর্শকে কোনো প্রতিষ্ঠানের জোরে বাঁচিয়ে রাখা যায় বিশ্বাস করি না। কোনো আদর্শ যদি একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে না বেঁচে থাকে তবে সে প্রতিষ্ঠান আসলে একটি মিউজিয়াম। সে মিউজিয়ামের সামগ্রী মূল্যবান নিশ্চয়, কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক।
       গোটা স্বামীজিকেই দশখণ্ড রচনাবলীতে ধরা আছে। কোত্থাও যাওয়ার দরকার নেই। কারোর সাথে আলোচনার দরকার নেই। স্বামীজির অনুভবে সমস্ত ধর্মের সার চিত্তশুদ্ধ হওয়া। মনের মধ্যে চালাকি, স্বার্থপরতা, সঙ্কীর্ণতা, মতলব ইত্যাদি থাকলে বুঝি চিত্তশুদ্ধ হয়? কোনোদিন না। বারবার বলছেন নিঃস্বার্থপরতাই ঈশ্বর। তা এই ঈশ্বরের বিশ্বাসে আস্তিক নাস্তিক হওয়ার জন্য আগের দিনের সংজ্ঞাগুলো ত্যাগ করলেই হয়।
       স্বামীজির যুক্তি, বিচার-বুদ্ধি, প্রখর স্মৃতিশক্তি ইত্যাদি ছাপিয়ে একটা কারণেই স্বামীজি স্বামীজি - একজন প্রাণখোলা প্রেমিক মানুষ, তাঁর তীব্র আবেগ, মানবিকতা, অনুকম্পা। এগুলো এমনই সাংঘাতিক ছিল যে সময়ে সময়ে তিনি নিজের সুক্ষ্মতম বিচারকেও ভাসিয়ে দিতেন। মনে নেই সেই ঘটনাগুলো?
 
১) ছোটোবেলায় ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল বলে ঘরের জামাকাপড় সব জানলা দিয়ে সাহায্যপ্রার্থীকে দিয়ে দেওয়া।
২) যে বেলুড়মঠ এত সাধ্যসাধনা করে তৈরি করা, সে মঠ বিক্রি করে দিতে চাইছেন ত্রাণের অর্থের জোগাড়ের জন্য।
৩) তখন তিনি বিশ্ববিখ্যাত। একদিন মঠে বসে ব্রহ্মচারী গুরুভাইদের সাথে শাস্ত্র আলোচনা করছেন, গিরিশ ঘোষ এসে ঢুকলেন। কিছুটা ব্যঙ্গ করে স্বামীজিকে এক অভাবগ্রস্থ, দারিদ্রপীড়িত, অসহায় রমণী ও তার সন্তানদের অবস্থা বর্ণনা করে বলছেন, আছে তোমার ওই বেদ বেদান্তে এর কি কিছু সমাধান?
       স্বামীজির মুখের ভাব বদলে গেল। তিনি উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন। গিরিশ একজনকে বললেন যা গিয়ে দেখে আয় নরেন কি করছে?
       বিবেকানন্দ ঘরে দরজা দিয়ে কাঁদছেন। জানলা দিয়ে সে দৃশ্য দেখে এসে যখন বলা হল তখন গিরিশ ঘোষ বলছেন, এই জন্য নরেন নরেন, তাকে ভালোবাসি তার এই মহানুভবতা, অনুকম্পাময় এত বড় হৃদয়টার জন্য, তোদের এই শাস্ত্রজ্ঞানের জন্য না।
 
       এরকম উদাহরণ কত কত কত ছড়িয়ে। এক রমণী তাঁকে অন্য রকম কিছু ইঙ্গিত করায় তিনি তার বস্ত্র চুম্বন করে সজল চোখে বলেন, মা এ বেশে কেন?
       উদাহরণ থাক, এই হৃদয়টার জন্য সমস্ত বুদ্ধি, বোধ, ইচ্ছা, বাসনা সেই মানুষটার পদপ্রান্তে বসতে চায়। সুক্ষ্ম বিচার কে চায়? তার ছড়াছড়ি। কিন্তু এই প্রেম, এই উদারতা, এই ভালোবাসা... এগুলোর তো ছড়াছড়ি হয় না? সংসারে বেশিরভাগ ভালোবাসার নীচেই ছোটো করে লেখা - শর্তাবলী প্রযোজ্য। স্বামীজি বলতেন প্রেম ত্রিকোণ যুক্ত। এক কোণ নিঃস্বার্থপরতা, এক কোণ, বাসনামুক্ত, এক কোণ, সে নিজেই নিজের লক্ষ্য। তবে? এর মধ্যে হিসাব কই? এর মধ্যে স্বার্থের ছায়া কই?
       গতকাল এক হলিউডের নায়কের রবীন্দ্রনাথের "চিত্ত যেথা ভয় শূন্য" কবিতা আবৃত্তি শুনলাম বিদেশের মাটিতে। সে কবিতায় এক লাইন আছে, "যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে", এই কথাটা বড় একটা কথা। সে বাক্য কৌশলের ধার ধারে না। সে এক প্রাণ থেকে উচ্চারিত হয়ে আরেক প্রাণে অনুভূত হয়। তাকে বোঝাতে সুক্ষ্ম তত্ত্ব লাগে না।
       আগে অনুভব, পরে বাকি কিছু। কথামৃতে এক গপ্পো আছে। পোদো বলে একজন এক পরিত্যাক্ত মন্দিরে ঢুকেই শাঁখ বাজাতে লেগেছে। সবাই ভেবেছে মন্দির বুঝি আবার খুলেছে। সবাই পুজোর উপকরণ নিয়ে এসে দেখে পোদো নোংরা মন্দিরের এক কোণে দাঁড়িয়ে শাঁখ বাজাচ্ছে। সে মন্দিরে দেবতা অবধি নাই। তখন সবাই বলে, " মন্দিরে তোর নাইকো মাধব, পোদো, শাঁখ ফুঁকে তুই করলি গোল"।
       আমাদের পোদো চাই না, স্বামীজিকে চাই। স্বামীজি কোনো তত্ত্ব নয়, রোমা রোলার ভাষায় গসপেল অব ম্যানকাইণ্ড, মানবিকতার ভাষ্য। সে অনুভবের কাছে নতিস্বীকার করি। আমাদের ছোটো ছোটো অনুভব সে মহাসমুদ্রের দিকে এগোক, যে অনুভবে নিজেকে মনে হয়, "দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল"।
       সে সম্বল তো তুমি স্বামীজি, হ্যাপি বার্থ ডে।