Skip to main content
 
একজন পরিচিত মানুষ আমার, হঠাৎ বললেন, "আচ্ছা দাদা যদি শোনো আমি আর নেই, কি হবে? ভাববে আমার কথা? কষ্ট পাবে?" বলেই সে হো হো করে হেসে উঠল। তার সাথে আমার মাত্র কয়েক বছরের পরিচয়। যদিও তা এখন আত্মীয়তায় পরিণত হয়েছে, তবু কানে বাজল কথাটা। হাতের কাজ থামিয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। সে হেসেই চলেছে, তার হাসি মুখের ওপর দুটো নিঃসঙ্গ চোখ; বুঝলাম কথাটার মানে কি।
       ভাবনাটা মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল, "আচ্ছা দাদা, হঠাৎ যদি শোনো কাল আমি নেই"...
       আমিও মৃত্যুর কথা, নিজের না থাকার কথা বলেছি। কার কাছে বলেছি? প্রিয়জনদের কাছে বলেছি। যে মানুষের আমার থাকা, না থাকায় কিছু যায় আসে, তার সামনে বলেছি। এটা মানবিক দুর্বলতা। এ আছেই। একমাত্র মানুষই হয়ত এমন জীব যে বৌদ্ধিক স্তরে জানে সে মৃত্যুঘেরা দ্বীপে বাস করছে। যে দ্বীপের মাটি ক্রমে ক্রমে ডুবে যাচ্ছে সাগরে। সে হারিয়ে যাবে। এ নিশ্চিত। তার সেই না থাকাকে সে হয় তো একটু আস্বাদান করে নিতে চায় কারোর ব্যথায়, কারোর শূন্যতা বোধে! সেই ব্যথা, শূন্যতাই তো সে তখন, না থাকা সে। তাই সে এ কথা বলে কোথাও একটা স্বস্তি পায়, সুখ পায়। তাই সে নিজের মৃত্যুর কথা ভাবে, প্রিয়জনের কাছে বলে। একেবারে দেখাশোনার আড়াল হয়ে যাওয়ার অবশ্যম্ভাবী দুঃখটাকে সে মাঝে মাঝেই সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেখে সে কতখানি সত্য, খাঁটি, কতটা মূল্যবান বাস্তবিক।
       তবে এ কথা সেই বেশি বলে, যে বঞ্চিত, যে উপেক্ষিত। যে মানুষটার কথা বললাম সেই মানুষটার কথাও তাই। সংসারে তার কর্তব্যের শেষ নেই, তার সন্তানের কাছে, স্বামীর কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের নানা অযৌক্তিক, অমানবিক, নিষ্ঠুর একপেশে প্রথা-রীতির কাছে; সব শেষে এক শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা। অবশেষে সেই নিঃসঙ্গতাকে সরিয়ে প্রতিদিনের সকালকে নতুন করে আটপৌরে সংসারে আহ্বান জানানোর কর্তব্য, নিজেকে টিকিয়ে রাখার দায়। সহানুভূতি নেই, সুক্ষ্ম বিচার আছে, প্রতিদিন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হাজিরা দেওয়ার আছে। সেখানে কত বিচারক, কত আইন, কত নালিশ তার বিরুদ্ধে - সে একা। সে একা সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা সে নিঃসঙ্গ।
       আমি এমন মেয়েমানুষ সংসারে অহরহ চলতে ফিরতে দেখি। 'মেয়েমানুষ' কথাটায় প্রগতিশীলেদের যদি আপত্তি থাকে মার্জনা করবেন, আমি এই শব্দতেই ওদের দেখতে জানি। কি অকৃতজ্ঞ, একপেশে, পক্ষপাতদুষ্ট একটা পুরুষশাসিত সমাজ প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে তার রাজস্ব আদায় করে চলেছে দেখলে একটা অসহায় অসহ্য রাগ জন্মায়। সমাজের যে সিঁড়ি অবধি আলোবাতাস এসে পৌঁছায় না, হাজার একটা উন্নয়নমূলক আলোচনা এসে পৌঁছায় না, সেখানে তারা কতটা মুক্ত? তাদের আবেগ, তাদের ভালোবাসা, তাদের সেবা, তাদের ত্যাগ, এমনকি তাদের মহানুভবতাকে জলের দরে বিকোতে দেখি। যেন মেলায় পাঁপড়ভাজার দোকান; খুচরো পয়সায় কিনলেও হয়, না কিনলেও হয়। বাকি আর যা কিছু মেলায় তা দ্রষ্টব্য, বাহবা পাওয়ার, শুধু ওই পাঁপড়ভাজাটুকু ছাড়া, ওটা তো হয়েই থাকে। কি অসম্ভব থ্যাংকসলেস জীবন। যে মানুষটা সেলাই শিখল দাদাদের স্কুলের খরচ বাঁচাতে স্কুলে না গিয়ে, গরীব বাবার পয়সা বাঁচিয়ে, সেই বিধবা হয়ে দাদার গলগ্রহ হয়ে অন্ধকারের রাস্তায় বাঁচার পথ নিয়েছে। অধিক উপার্জনশীল ভাসুরের নানান সুখের ফরমায়েশ মাথা নীচু করে মেনে নিতে হয়েছে কম উপার্জনশীল স্বামীর লজ্জার মাশুল দিতে। এ সব গল্প শরৎচন্দ্রের নয়, আমার দেখা। এরকম ঘটনায় ভরে গেছে দুই চোখের পাতা, মাথা, বুক।
       এমনই একজন মানুষ আমার সামনে দাঁড়িয়ে তার সাধের, স্বপ্নের মৃত্যুর কথাটা টেনে নিয়ে এসে পরোক্ষভাবে বলে গেল, সে যেদিন থাকবে না, আমি যেন সেদিন তার অনুপস্থিতিজনিত অসুবিধার কথা না ভেবে, শুধু তার অভাবটাকেই যেন সম্মান দিই, কষ্ট পাই। সে তাতেই শান্তি পাবে। তার আপনজনেদের উপেক্ষা, উদাসীনতায়, শুধুই প্রয়োজনীয়তার তকমায় বেঁচে থাকার অভিমানটুকু তাতেই যেন বিরাট সান্ত্বনা পাবে। সে ধন্য হবে।
       নতুন বছর নিয়ে আমার কোনো আবেগ নেই। তবু এইটুকু কথা বলি, যদি কোনো মানুষ, সে যেই হোক, যে অর্থনীতির, যে লিঙ্গের, যে ভাষার, যে ধর্মের হোক না কেন, সে যদি তা খুব আবেগ নিয়ে নিজের না থাকার গল্প বলে, তবে জানবেন সে তার দুরতিক্রম্য নিঃসঙ্গতার হাত থেকে বাঁচার এর চাইতে সম্মানজনক আর কোনো পথ পায়নি বলেই বলছে। একটু ভালোবাসা, একটু গুরুত্ব চাইছে মানুষ হিসাবে। খুব বেশি কিছু নয়, এইটুকুই। আপনার কাছে সে একটা প্রশ্রয় চাইছে, জীবনে যে পূর্ণতা পায়নি, মরণে সে যেন আপনার আন্তরিক স্মরণে তা পূর্ণ হয়, এই তার সাধ। এ নিঃসঙ্গতা, উপেক্ষা মেয়েদের মত আমাদের সমাজে হয় তো রাস্তার কুকুরগুলোও নয়। খুব রূঢ় শোনালেও, এক এক সময় তাই মনে হয়। রীতিনীতিরগুলোতে অভ্যাস হয়ে গেছে বলে যেমন পশুদের নগ্নতা চোখে বাধে না, তেমনই সমাজের এই নিষ্ঠুরতা চোখে পড়ে না।
       মানু্ষের নিঃসঙ্গতাকে তার আশেপাশের মানুষের আদমশুমারীতে মাপবেন না অনুগ্রহ করে। মনে রাখা যাক, মেলাতেই মানুষ নিঃসঙ্গ হয় বেশি, জঙ্গলের চাইতে। তাকে অনুভব করবেন তার সংবেদনশীলতার উপরে। তবেই তার এই অযৌক্তিক আবদারের একটা খেই মিলবে। "তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে" আসলে "তবু মনে রেখো" র উল্টোদিক, একই কথা, অন্যভাবে বলা। এইটুকুই আমার নতুন বছরের আবদার। ভালো থাকবেন সবাই। অনেক শুভেচ্ছা রইল।