Skip to main content
 
 
 
 
 
 

সুব্বুলক্সমী না শুভলক্ষ্মী? এম এস শুভলক্ষ্মী, আমার বলতে সুবিধা হয়। প্রথম শুনেছিলাম টিভিতে। স্কুলে পড়তাম। অল্প অল্প হিন্দী বুঝতে শুরু করেছি। একটা হিন্দী ভজন গাইলেন, 'মেরে তো গিরিধর গোপাল'। মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে রইলাম শুনে। এমন গলা না হয় হল, এমন ভাব এমন অনায়াসে আসে? তাও মন্দির না, পাহাড় পর্বতের গুহা না, অ্যাতো লোহালক্কড়-আলো-ক্যামেরা ঘেরা শতচক্ষুর সামনে গাওয়া! এমন একাত্ম হওয়া যায়! অভিনয় নয় সে তো বুঝছি, কারণ অত্যন্ত ভালো অভিনয় মনের মধ্যে একটা আনন্দের রেশ রেখে যায়, কিন্তু এ তো তা না, এ তো সামনে থেকে পাশের জগতের উপর পর্দা সরিয়ে দেওয়া আচমকা। 

ক'দিন পরেই একটা লেখা বের হলো ওনার ব্যাপারে টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ঘটনাটা মনে বহুদিন দাগ কেটে রইল। এক দরিদ্র দম্পতি বহু দূর থেকে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে মাদুরাইতে এসে শুনলেন ওনার গান খানিক আগেই শেষ হয়ে গেছে। স্ত্রী কেঁদে ফেললেন। এতটা আশা নিয়ে এতটা পথ আসা তবে বিফলে গেল? মাটিতে বসে পড়লেন কাঁদতে কাঁদতে, শরীরে আর বল নেই যে! স্বামী বললেন, দেখি কি করা যায়। খোঁজ নিয়ে জানলেন উনি কোথায় কার বাড়ি উঠেছেন। গেলেন অত রাত্রেই স্ত্রীকে নিয়ে। কেউ একজন বলল, উনি সবে শুতে গেছেন, ভীষণ ক্লান্ত। স্বামী বললেন, একবার ডেকে দিন, অনেক দূর থেকে এসেছি, অনেক আশা নিয়ে। 
ওনাকে ডাকা হল। উনি এসে সব শুনলেন। তারপর ওনার স্ত্রীকে বললেন, কেঁদো না, বোসো, আমি আসছি। 
এলেন, কয়েকটা গান শোনালেন। রাত্রে সেখানেই থেকে যেতে বললেন। এই হলেন মানুষ শুভলক্ষ্মী।
 
কি আছে ওনার গানে? ওনার নিজের ভাষায়, সঙ্গীতের উদ্দেশ্য হল সঙ্গীতের অতীত যে সত্তা আছে তাকে প্রকাশ করা। কে সে? সে-ই ওনার ভগবান। ফ্রন্টলাইন পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন ভারতরত্ন পাওয়ার পরপরই। কিশোরী আমোনকর সেই জন্যেই বোধহয় ওনার কণ্ঠস্বরকে বলতেন অষ্টম সুর। 
 
'মীরা' সিনেমাটা দুটো ভাষায় হল। উনি অভিনয় করলেন মীরার ভূমিকায়। হিন্দীটা দুর্ভাগ্যবশতঃ আর চোখে পড়ে না, ওই টিভিতেই যে ক'বার দেখা। মহাত্মা ওর কণ্ঠস্বরকে বলতেন, "মীরার কণ্ঠস্বর।" ওর খুব প্রিয় ভজন ছিল 'হরি তুম হরো' নামে ভজনটি। সত্যিই যেন তাই। উস্তাদ আমির খাঁ'কে শুনলে যেমন মনে হয় তানসেনের কণ্ঠস্বর আর গায়কী বোধহয় এরকমই কিছু হয়ে থাকবে। 
আরেকটা দিনের কথা মনে পড়ছে। একদিন বিকাল বেলায় ন্যাশেনাল চ্যানেলে ওনার গান হবে, পেপারে লিখল। খুব উদগ্রীব হয়ে আছি। গান শুরু হল। চমকে উঠলাম ওনার গান শুনে, এ কি গাইছেন উনি? উনি গাইছেন, "আমার মল্লিকাবনে"। আমার অসাধারণ লাগল। (এই নিয়ে যদিও খুব মজার মজার কথা শুনেছি। একটু প্রসঙ্গান্তর হবে যদিও। এখন ইউটিউবের দৌলতে ওনার দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত আর 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা' গানটা পাওয়া যায়। কিছু মানুষের গলায় শুনেছি, 'এ হে এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত হল নাকি!' আসলে হয়েছেটা কি, আজকাল সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেন, তার সঙ্গীতের সঠিক অর্থে তালিম থাকুক চাই না থাকুক। তালিম অর্থে মার্গ সঙ্গীতের কথাই বলতে চাইছি। না হলে শুধু অভিনয় আর আবেগের রসবড়া হয়ে যাচ্ছে গানগুলো। 'বাজে করুণ সুরে', 'ঘোরা রজনী এ', 'অসীম কালসাগরে' ইত্যাদি গানগুলো যথাযথ গাইবার লোক কমে যাচ্ছে। যে জোঁড়াসাকোতে অত বড় বড় তাবড় তাবড় শিল্পী এসে গেয়েছেন, গতবার ২৫শে বৈশাখ শুনে এলুম সেখানে লাইন ও সুরের চ্যুতিতেও নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস চলছে। মাঝ অনুষ্ঠান থেকে উঠে আসতে বাধ্য হলুম। গানটাও যে শেখার জিনিস, চর্চার জিনিস, শুধুই নিজের ভালোলাগাটুকু দিয়ে মাপার জিনিস না, এটা না বুঝতে পারলে কোনো শ্রেষ্ঠ কীর্তিরই যথার্থ উত্তরসূরী হওয়া যায় না। এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝি ততই মঙ্গল। 
তার সাথে এই উন্নাসিক ভাব, "ও গাইবে কি? অবাঙালী, ও কি বোঝে?" এই উন্নাসিক ভাবটা ছাড়তে পারিনি বলেই আজও বাংলার বাইরে সে অর্থে রবীন্দ্রনাথের গানকে পৌঁছানো গেল না। যিনি রবীন্দ্রসংগীত গান না, তাঁর ধারা পৃথক হতেই পারে খানিক। তাতে 'গেল গেল' রব তুললে তো সবই গেল। একটা ক্ষুদ্র পরিসরেই আটকে থাকল। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো ধারাবাহিক কাজ হল না। 'গীতাঞ্জলী' বলে একটা অনুষ্ঠান হল, বড় বড় শিল্পীরা গাইলেন হিন্দীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তবু সবার মনে হল, সেই 'অতিভালো'টা যখন হল না, তখন আর কি হল!) 
শুভলক্ষ্মীর কর্ণাটকি সঙ্গীতে অবদান নিয়ে কিছু বলার নেই। খোদ রাষ্ট্রসংঘের সভাঘরে ওকে দক্ষিনী সঙ্গীত গাইবার আমন্ত্রণ তো আছেই, সাথে সাথে বিদেশের বহু জায়গায় ওর সঙ্গীত পরিবেশন, ভালোবাসা, ওকে ঘিরে উৎসাহ দেখার মত। (অবশ্য ওনার সমসাময়িক আরেকজন দক্ষিণী কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পীর নাম করতেই হয় - ডি কে পোট্টমল, অসামান্যা এই মহিলা শিল্পীর কণ্ঠস্বরের সাথে উত্তর ভারতের গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গল'র অদ্ভুত মিল আছে, কি অক্লান্ত লড়াই এনারা করেছিলেন সেই শুদ্ধ ধারাকে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য)।
শুভলক্ষ্মীর কণ্ঠে অসামান্যভাবে জেগে উঠেছে বিভিন্ন মরমী সাধকের পদাবলী। দক্ষিণের ত্যাগরাজের অসামান্য সব রচনা (যার মধ্যে 'ভাবয়ামী রঘুরামম্', আর 'বন্দমু রঘুনন্দনম্' আমার অত্যন্ত প্রিয়)। এ ছাড়া তুলসীদাস, মীরা, সুরদাস, কবীর তো আছেনই। আমার প্রিয় কয়েকটা পদাবলী বলি ওনার কণ্ঠে এদের। তুলসীদাস - 'তু দয়াল দীন হুঁ'; মীরা - 'মেরে তো গিরিধর গোপাল'; সুরদাস - 'হে গোবিন্দ রাখো শরণ' (এই গানটার শেষে একটা বিস্তার আছে, যা আকুতি ছাড়া আর কিছু না, গায়ে কাঁটা দেয় যতবার শুনি); কবীর - 'ভজ রে ভাইয়া রাম গোবিন্দ হরি'।
একবার ওনার একটা ক্যাসেট কিনলাম, 'বিষ্ণু সহস্রনামম্'। এক পিঠে বিষ্ণুসহস্রনামম আর অন্য পিঠে শঙ্করাচার্যকৃত বিখ্যাত রচনা 'মোহ মুদগর' ভজ গোবিন্দম। আশ্চর্য হলাম, উনি শুরু করছেন শ্রীরামকৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্র দিয়ে - 'ওঁ স্থাপকায় চ ধর্মস্য।' কারণ শ্রীরামকৃষ্ণদেব ওনার নারায়ণ।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ রায়ের গানের সাথে ওনার গান মিশেও একটা আশ্চর্য মাধুর্য তৈরি করত। 'মোহে চাকর রাখো জী' গানটাতে তো শেষে কীর্তনের অংশটুকু সম্পূর্ণ দিলীপ রায়ের গায়কীকেই মনে পড়ায়। 
ভজনের বর্তমান অবস্থা দেখুন। ডি ভি পালুস্কর যে অসাধারণ ধারা ভজনের প্রবর্তন করলেন, তা শুভলক্ষ্মী হয়ে যশরাজ হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সেই গানগুলোতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মারপ্যাঁচের থেকে দরদটা অনেক বেশি থাকত। আকুতিটাতে দেখনদারি ছিল না। তবে এ অভাব দক্ষিণে নেই। আজও জয়শ্রী, উন্নিকৃষ্ণাণের গলায় ত্যাগরাজ শুনলে অভিভূত হই। পরিবর্তন হয়েছে প্রকাশে, মূলে না। উত্তর ভারতে এই অভাব খানিক ঘটলেও, আমাদের এখানে অবস্থা খুব সঙ্গীন। সেইভাবে ভক্তিসঙ্গীত কই? গাইবার লোক কই? মরমী সঙ্গীত গাইতে হলে অথবা তার রস গ্রহন করতে হলে কি নিজেকে রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ হতেই হয়? তা তো নয়! নিজের মধ্যে একটা রসিক, ভাবগ্রাহী মন থাকতে হয়। তাতে আর কি হয় জানি না, মনের সুস্থতা অনেকখানি বাড়ে দেখেছি। আর আজ ভক্তিসঙ্গীতের নামে যে ধরণের গান তথা গাইবার প্রথা দেখছি, তা আমাদের ঐতিহ্যের পক্ষে খুব একটা অনুকূল নয়। 
শুভলক্ষ্মীর কণ্ঠস্বর ভারতের অনাদি কণ্ঠস্বর। তার অনুভূতি, গভীর অন্তরাত্মার আত্মদানের অনুভূতি। তাঁর উপস্থিতি চিত্তশুদ্ধি ঘটায়। সেইখান থেকেই আবার আমাদের চলার উৎসাহ পাই, দিশা পাই, এই প্রার্থনা।
 
(আজ ওনার প্রয়াণ দিবস)