Skip to main content

কতটা অসহায় লাগে তার মাপ পরিমাপ হয়কি ? একটা মহামারী পেরিয়ে এলাম, তাও মৃত্যুর খবর সহজ তো হল না। আজ যখন শুনলাম একজন প্রাক্তন ছাত্রের বাবা হঠাৎ চলে গেছেন, শুনে তো মনে হল না এই কয়েক বছর ধরে কত মানুষ তো চলে গেলেন। এই তো আজও ছাদে উঠলে বাড়িগুলো হাতে গুনে গুনে বলা যায়, এই বাড়ি, ওই বাড়ি…. মহামারীতে সব চলে গেলেন। কিচ্ছু সহজ হল না। শুধু জীবনের স্থায়িত্বের উপর আস্থাটা আরো দুর্বল হল, আর আসক্তি আরো বেড়ে গেল। জীবন পদ্মপাতায় জলের মত চঞ্চল, সত্যি। কিন্তু পদ্মপাতায় জলের মত নিরাসক্ত হলাম কই? হতে চাইলামই তো না। চাইও না।

পুরীতে বেড়াতে গেলে প্রায়ই বিকেলে সমুদ্রের ধারে বালিতে বসে থাকতাম। সমুদ্রের পর সমুদ্রের ঢেউ। ওসবে অত মন টানত না। মন টানত তীরের মানুষগুলো। চেয়ারে বসে যারা। ঘুরে বেড়াচ্ছে যারা। কেনাকাটা করছে যারা। বিক্রি করছে যারা। সবাই। উদাস চোখে প্লাস্টিকের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকা মানুষগুলোর মুখ। চোখগুলো সমুদ্রের চেয়েও গভীর। মানুষের চোখের গভীরতার কাছে মহাকাশের অসীমত্ব আর সমুদ্রের গভীরতা দুই-ই তুচ্ছ। মানুষ প্রথমে আঁকড়াতে যায়। তারপর ধীরে ধীরে যখন বুঝতে পারে সে কিছুই ধরে রাখতে পারবে না, অসহায় হয়, ক্ষুব্ধ হয়। একদিন আর অসহায় লাগে না। বোঝে সমুদ্রের ঢেউ যেভাবে সত্যি, সমুদ্র সেভাবে নয়। নিজেকে ঢেউয়ের মত লাগে। ওঠাপড়া কোনোটাই নিজের ইচ্ছায় নয়। তার নোনতা স্বাদ, তার আকার কোনোটাই মৌলিক নয়, এই সাগরের থেকেই জন্মানো। সাগরেই লীন হবে। সে কোথাও কোনোভাবে বিশেষ নয়। মাঝে মাঝে ক'টা বড় বড় ঢেউ ওঠে না যে তা নয়, অবশেষে তাদের পরিণামও তো এক।

তবু নির্বোধ মন প্রশ্ন করে কেন? কেন এ প্রবল নিষ্ঠুরতা? তবে কি সংসারে কার্যকারণ সূত্রের বাইরে কিচ্ছু নেই? এত এত হাজার হাজার মানুষ যে চক্ষের নিমেষে মারা গেল, তার কার্যকারণ সূত্র আছে, কিন্তু মানবিক ব্যাখ্যা কি? কিচ্ছু নেই? ভাগ্যের হাতে, প্রকৃতির হাতে এমন পুতুল আমরা? কেন?

কারোর কাছে কোনো উত্তর নেই। নির্বোধ মন বোঝে না, এই 'কেন' প্রশ্নটাই অবান্তর। 'কি করে' তার ব্যাখ্যা আছে, 'কেন' এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।

মনের গভীরে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়। শৌখিন শূন্যতা নয়! যে শৌখিন শূন্যতা একটা আর্থসামাজিক নিশ্চিত সুরক্ষিত জীবনে, শৌখিন বৌদ্ধিক বিষাদ থেকে জন্মায়। তা নিয়ে 'বুদ্ধিজীবীয়' সভা করা যায়। কিন্তু তাতে মশাল তো ছাই, স্ফুলিঙ্গও ওড়ে না।

এ শূন্যতা, বোধের শূন্যতা। যুক্তির নয়। আবেগের নয়। মানুষের এমনই স্বভাব যে, সে বোধের শূন্যতাকে মেনে নিতে পারে না। তাই কল্পনার রঙে সে শূন্যতাকে ভরিয়ে নিতে চায়। জন্ম নেয় পুরাণ, বা মিথোলজি। যেমন ভূমিকম্প মানে বসুমতীর পাশ ফেরা। গ্রহণ মানে রাহুর গিলে খাওয়া ইত্যাদি।

যুক্তির তৃষ্ণা তথ্যে মেটে। আবেগের তৃষ্ণা আরেক আবেগে মেটে। কিন্তু বোধের তৃষ্ণা? সে যত স্পষ্ট হয়, তার গভীরের শূন্যতাকে তত অনুভব করা যায়। কত দর্শন, কত নীতি, তত্ত্ব যুগে যুগে আসে। বালির ঘরের মত ভেসে যায়। কোন দাঁড়ায়, কোন নিক্তিতে সবটাকে দাঁড় করায় মানুষ? সে খোঁজে সমীচীনতা। পায় না। হাতড়ায়। যত দিন যায় যুক্তির সীমাবদ্ধতার উপলব্ধিতে, আবেগের অসীম মূঢ়তার বোধে নিজের অসহায়তা আরো গভীর হয়। অবশেষে মানুষ শূন্য হাতে সময়ের সামনে দাঁড়ায়। সমস্ত অভিমান, অসহায়তার বোধকে সময়ের হাতে তুলে দিয়ে বলে, কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু বুঝি না, যেদিকে নিয়ে যাবে যাব। আর কোনো গতি নেই।

সময় উদাসীন। কার চাকার রথ সে কেউ জানি না। কেউ কোনোদিন জানবেও না। জানার জিনিসই সে নয়। সে চাকার অনুবর্তী হয়ে মনে প্রাণে এটুকুই প্রার্থনা জন্মায়, সম্পদে-বিপদে, সুখেদু:খে চাকাটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাই, নিজের মনের ঘূর্ণিতে নিজের বুদ্ধিকে বিহ্বল করে বিভ্রান্ত যেন না হই। ঝুলন সাজিয়ে কালবৈশাখীর ভয়ে যেন না বাঁচি। কালবৈশাখীকে ঠেকাতে পারব না জানি। কিন্তু সে কালবৈশাখীও তো সে রথের চাকার একটা আবর্তন মাত্র, সবটাই ধ্বংস নয়, বিষাদ নয়, অন্ধকার নয়। একমাত্র সময়ই জানে সত্য কি, আমরা জানি সময়ের ক্ষুদ্রতম অংশকে। সময়ের এই রহস্যের গভীরে আমার মূঢ়তার অস্তিত্ব। দুই-ই অসীম। এই বোধটুকুই যা হাতের নাগালে পাওয়া সত্য।