অনলাইনে ঘরে বসে পুজো দেওয়ার ব্যাপারে এইমত আমায় ভাবালো। চাইলে ঘরে বসে পিণ্ডি দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে শুনেছি। সত্যিই কি কৃচ্ছসাধনের সঙ্গে পুণ্য সমানুপাতিক? তার সঙ্গে চিত্তের অবস্থার কোনো সংযোগ নেই? রামকৃষ্ণদেব বলতেন ভাবগ্রাহী জনার্দন। অর্থাৎ ঈশ্বর শুধু মন দেখেন। মেয়েদের উপোস আমি সহ্য করতে পারিনে, বলতেন। তার মানে এই নয় যে দক্ষিণেশ্বরে সব পুরুষকে খালি পেটে আসতে বলতেন।
এককালে সন্ন্যাসীরা পদব্রজে ভ্রমণ করে, যেখানে যা ভিক্ষা পাওয়া যেত তাই খেয়ে সন্ন্যাস ধর্ম পালন করেছেন। এখন সন্ন্যাসীরা বাতানুকূল গৃহে বাস করে, রেলে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ করে, উড়োজাহাজে ভ্রমণ করে যাতায়াত করে থাকেন। মানে যাদের সামর্থ্য আছে আর কি। সৎসঙ্গ, প্রচারটচারও অনলাইনে হয়ে যাচ্ছে। ভিক্ষা, দক্ষিণা সব জায়গাতেই অনলাইনে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তবে? লাইনে দাঁড়িয়ে, না খেয়ে, রোদে ঘেমেনেয়ে নাস্তানাবুদ হলেই ঈশ্বর তুষ্ট হয়ে আমার অ্যাকাউন্টে কিছু পুণ্য ডোনেট করবেন, এ তো ভীষণ মেটেরিয়ালিস্টিক স্পিরিচুয়ালিটি হয়ে গেল না? ভারতের নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থের মূল্য বাড়ালে বিশেষ সুযোগসুবিধা দেওয়ার চল বহুযুগ থেকেই শুরু হয়েছে। সেগুলোকে ভি-আই-পি ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পুণ্য কমে বলে কেউ তো সন্দেহ করে না!
এগুলো সবই বাহ্যিক। এখন বলা যেতে পারে সবই যদি ভাবের খেলা হবে তবে অনলাইনই বা কেন? হলেই বা ক্ষতি কি? সুইগিতে খাবার অর্ডার দিয়ে হোক, কি প্রবীণাকে অনলাইনে পুজো দিয়ে মানসিক শান্তি পাইয়ে দিয়েই হোক, শান্তিটাই কি বড়কথা নয়?
দুটো কথা আছে। এক, পুরোনোর প্রথার প্রতি অযৌক্তিক শুদ্ধতার মোহ। দুই, কৃচ্ছসাধনের তত্ত্ব।
কলাপাতায় খেলে শুদ্ধতা। মাটির প্রদীপ জ্বাললে শুদ্ধতা। ভারতের অনেক মন্দিরে এখনও বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নেই কারণ তা নাকি শুদ্ধতা, ঐতিহ্য নষ্ট করবে। এটা আসলে আমাদের মনস্তত্ত্বের একটা গভীর বৈশিষ্ট্য, আমরা পুরোনো যা কিছুকে ভীষণ শুদ্ধ মনে করি। যেমন আমরা আমাদের শৈশবের অবস্থাকে আমার শুদ্ধাবস্থা মনে করি, যখন আমার চেতনা কামগন্ধহীন ছিল, নানাবিধ জটিলতার বোধহীন ছিল। এই ধরণের বিশ্বাস থেকে আমাদের মধ্যে একটা শুদ্ধতার প্রতি মোহ তৈরি হয়। যার থেকে ঘটে বিকার। যা কিছুকে বিশ্বাস করতে শুরু করি তখন আমরা। যা কিছু পাপ করেও কোনো একটা বিশেষ তিথিতে, বিশেষ নদীতে স্নানকেও শুদ্ধ হওয়ার পন্থা বানাই। মজার কথা সেখানেও অনলাইনের ব্যবস্থা আছে। সারদাদেবী বলছেন, যার আছে সে মাপো আর যার নেই সে জপো। এর গভীরেও তো ওই একই ইঙ্গিত না? আছে মানে ধনসম্পদ, সে দানধ্যান করো, আর যার নেই হরিনামই করো।
আর রইল কৃচ্ছসাধন। এ শব্দটাকে আমি ভীষণ ভয় পাই। গতকাল যে মহাত্মার জন্মদিন ছিল, সেই ভারতের নবযুগের প্রথম আলো রামমোহন রায় আমাদের চিত্তের জড়ত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। জাতপাত, গুরু-অবতার সব কিছু থেকে সরিয়ে এক পরম বিশ্বপিতার বোধ জাগাতে চেয়েছিলেন, উপনিষদকে আশ্রয় করে। আমাদের স্বাবলম্বী করতে চেয়েছিলেন। কৃচ্ছসাধনের নামে মানুষের উপর মানুষ যে কি অত্যাচার করতে পারে, এমনকি নিজের উপরেও পুণ্যের লোভে, সে বোধহয় ধর্মের ইতিহাসের বাইরে এত উদাহরণ আর কোথাও নেই। কৃচ্ছ অর্থে কষ্ট। নিজেকে শাস্ত্রীয় ব্যবস্থায় কষ্ট দিলে আর অন্যকে কষ্ট দেওয়ার পথ সুগম করলেই যদি পুণ্যলাভ হত তবে ভারতের দলিত আর ভারতীয় মহিলাদের যা পুণ্য এতদিনে সঞ্চয় হয়েছে এতদিনে তাতে করে এই ধরাধামই স্বর্গ হয়ে যেত। কিন্তু সে গুড়েবালি। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। এ সব কথারই চূড়ান্ত পরিণাম ওই নির্জলা একাদশী, সতীদাহ ইত্যাদি ইত্যাদি। বলে শেষ করা যাবে না। শাস্ত্রীয় কুসংস্কারে যে যত নীচুজাত হবে তাদের জন্য নিয়মও যে কি সাংঘাতিক হতে পারে তা মনুসংহিতার পাতা উল্টালেই দেখা যেতে পারে।
একবার একজনের অমন ধর্মীয় সংকট দেখা দিয়েছিল। মহাপ্রভুর সময়ের কথা। তাকে পণ্ডিতেরা বিধান দিয়েছিলেন গরম ঘি খেয়ে প্রাণত্যাগের জন্য। কি সাংঘাতিক কথা! মহাপ্রভু বলেছিলেন শুধু নামের মাধ্যমেই হবে। যদিও সেই মহাপ্রভুর কঠোরতাতেই ছোটো হরিদাসকে আত্মহত্যা করতে হয়, এও বাস্তব। সে অন্যপ্রসঙ্গ।
তপস্যার সংজ্ঞা দিতে গীতা বলছেন,
শারীরিক তপস্যা, দেবতা, ব্রাহ্মণ, গুরুজন ও প্রাজ্ঞজনের পুজো, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা।
বাচিক তপস্যা, অনুদ্বেগকর বাক্য, সত্য ও হিতকর প্রিয় বাক্য ও বেদাদি পাঠ।
মানসিক তপস্যা, প্রসন্নতা, সৌম্যভাব, বাকসংযম, মনের নিরোধ ও ছলনারহিত ব্যবহার।
তুলসীদাসও বলছেন সরলস্বভাব, সন্তোষ আর কপটতারাহিত্যই সাধন।
এখন যুক্তি হতে পারে, এগুলো তো সব জানাই, তাও লোকে তো লোকাচার মতে নানা পুজো-আচ্চা করেই থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথা হচ্ছে করুক। মানুষের মধ্যে এ ধর্মবোধ এত গভীরের স্বভাব যে তার থেকে তার মুক্তি নেই। এ বাস্তবকে মেনে নেওয়াই কাণ্ডজ্ঞানের কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে তাকে যতটা সরল, সুবিধাজনক করে নেওয়া যায় ততটাই ভালো নয়কি? সবটাই তো আচার-আচরণ, অনুষ্ঠান সর্বস্ব। আগের সব কিছুই তো শুধু আকার মাত্র, বহিরঙ্গ রেখেই করা হচ্ছে। এর সঙ্গে পুণ্যের তত্ত্ব জুড়ে দেওয়া কি খুব দরকার? শুয়ে বসে, এসি চালিয়ে যে যেভাবেই হোক করুন না কেন, আমাকে তাতে কটাক্ষ করার দরকার কি? অন্তত পুণ্যের মত অমন ভয়ংকর তত্ত্বকে আবার টেনে এনে? এই পুণ্যের চক্করে কি অত্যাচার হয়েছে এ দেশে আমরা কি জানি না? আবার সেই কথা? কেন?
প্রসাদ মানে প্রসন্নতা। এখন হয়েছে মিষ্টিফল। হোক। দুই-ই থাকুক। চিত্তের প্রসন্নতা যে করেই হোক যদি এসে থাকে তবে আর ক্ষতি কি? আর সত্য অর্থে চিত্তের প্রসন্নতা পাওয়া স্বার্থহীন হওয়া ছাড়া আর কি কোনো উপায়ে আছে? পুণ্যায় পরোপকারায়, পাপায় পরপীড়নম - সে তো আদি কথা আছেই। বাদবাকি এসব ছেড়ে যদি কেউ অনলাইনে একটু আচার অনুষ্ঠান করে, আমরা যেন তা সাদরে গ্রহণ করেই নিই। এই গরমে হাঁটুতে ব্যথা, সিঁড়ি চড়ে চড়ে বয়স্কদের ওঠা যে কি সাংঘাতিক দেখেছি তো। না পুরোহিত নেমে আসেন, বা নামার অবস্থায় থাকেন, না দেবতা। তবে? হোক অনলাইনে। যিনি অন্তর্যামী তিনি তো জিমখানার মাষ্টার নন, তিনি অন্তরের আন্তরিকতাই দেখবেন। সে নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। শুধু ওই ধর্মের নামে কৃচ্ছসাধন আর পুণ্য আরহণের গল্পটাকে আর টেনে টেনে বড় না করাই ভালো। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।
(আজকের 'এই সময়' খবরের কাগজের অংশ ছবিতে)