Skip to main content

        ডারউইন মহাশয়ের মতে সংগ্রামই হল টিকে থাকার মোদ্দা কথা। কিসের জন্য সংগ্রাম? না অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। আমাদের কিসের জন্য সংগ্রাম? না সুবিধার জন্য। সবার থেকে বেশি সুবিধার মধ্যে আমি বাঁচতে চাই। যে 'বেশি সুবিধা'র কোনো নির্দিষ্ট পরিমাপ নেই, থামার জায়গা নেই। 
        একটি ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। আমায় চক্ষু চিকিৎসক বললেন, আমার বাই-ফোকাল চশমা লাগবে এখন থেকে, কারণ আমি প্রেসবায়োপিয়ায় এসে পড়েছি, চল্লিশ উত্তরণের সাথে সাথেই। অর্থাৎ, আমার চশমার জমি দ্বিধাবিভক্ত হবে, উপরের অংশ দূরের আর নীচের অংশ কাছের। আরো শোনা গেল যে আরেক ধরণের চশমা হতে পারে, তার দাম বেশি; তাতে দূরের, মধ্যের আর নিকটের --- তিনটে পাওয়ার অ্যাড করা থাকবে, তার নাম 'প্রগ্রেসিভ'। ভালো কথা। পরীক্ষার জন্য দুই পক্ষই বানানো গেল। একটা স্বল্পমূল্যর আরেকটা অতিমূল্যর। বেশ বুঝলাম, প্রগ্রেসিভের একটা মজা হল মাঝে কোনো বিভেদক রেখা না থাকায় লোকে বুঝবে না আমার বয়েস হচ্ছে। অর্থাৎ কিনা, 'বুড়োদের মত' চোখের নীচে অর্ধচন্দ্রাকার গোল্লা দেখা দিয়েছে - এমন কথা ভাবানোর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এছাড়াও অনেকেই বললেন প্রগ্রেসিভ বেশ সুবিধার চশমা। অবশ্যই তাই। 
        কিন্তু মুশকিল হল সুবিধা আর সাধের দ্বন্দ্ব। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। প্রগ্রেসিভে লেন্সের সমস্যা হল তার বাইরের পরিধির দিকের দুইপাশে দুটো ব্লার জোন অর্থাৎ অস্পষ্ট অঞ্চল থাকে। মাঝের করিডোর দিয়ে নিজের দৃষ্টি অ্যাডজাস্ট করার অভ্যাস করতে হয়। যত বেশি টাকা দেওয়া যাবে তত সেই করিডোরের অঞ্চল বাড়বে, কিন্তু অস্পষ্ট অঞ্চল শূন্য হবে না, সে থাকবেই। খানিক ঠুলির মত। কাউকে কটাক্ষে দেখা যাবে না স্পষ্ট, সম্পূর্ণ মুণ্ডু তার দিকে ঘুরিয়ে দেখতে হবে।
        তো যেটা বলছিলাম, দ্বন্দ্ব শুরু হল সুবিধা বনাম সাধের। আমি দেখতে চাই গোটা আকাশ, গোটা মাঠ, দিগন্তরেখা। কিন্তু প্রগ্রেসিভ আমায় বলল, দেখো আমি তোমায় কাজের সুবিধা করে দিতে পারি, কিন্তু দেখার সুখটা তো দিতে পারি না। দেখে সুখ আর দেখার সুখ --- দুটো আলাদা কথা। কাজের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে তা হল দেখে সুখ, আর আমি চাইছি দেখার সুখ। আমি আদিগন্ত চেয়ে থাকব, আমার দৃষ্টির সমস্তটা দিয়ে প্রকৃতির মাধুর্যে অবগাহন করব তবেই যে না বেঁচে থাকার সুখ! আমি যে নিতান্তই একটা কাজের মানুষ নই এটা কাকে বোঝাই। তাই অনেকের যা ধর্তব্যের মধ্যেই না, আমার কাছে তা-ই পরম মূল্যবান। আমি যে একবিন্দু দেখা থেকেও নিজেকে বঞ্চিত করতে চাই না, এমনকি তা চোখের কোনার দেখাটুকুও না। আমি যে সারাদিন কম্পিউটার আর চার দেওয়ালের মধ্যে কাটিয়ে দিনযাপন করি - তা তো নয়!
        অগত্যা আমি সব ত্যাগ করে আমার সাধের বাই-ফোকাল চশমায় ফিরে এলাম। জীবনে সুখ বলতে যে দুটো, এক পড়া আর দুই দেখা - সে হতে নিজেকে আর বঞ্চিত হতে হল না। পড়ার চশমা আর দেখার চশমা আলাদা হল। আমি শান্তি পেলাম। হিসেবী বলল, কিন্তু এতগুলো টাকার চশমা?! আমি মনে মনে বললুম, আর আমার গোটাটা দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা? হিসেবী বলল, ঢং! আমি বললুম, হ্যাঁ তো, আমার বেঁচে থাকার ঢং।
        সেই নিয়েই কথা। সুবিধা বনাম সাধ। জীবনে যদি সুবিধাটাকে বড় করে দেখি, তবে সরকারি মতে ডেথ সার্টিফিকেট না বেরোনো অবধি বেঁচে রইলাম সন্দেহ নেই, কিন্তু মনের মধ্যে যে মরে রইলাম, সে খবর কে রাখবে? আমার সাথে আমার বিধাতার যে অংশে একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক সে আমার সাধের সম্পর্ক। সেইখানে আমার বিধাতা আমায় একান্ত মৌলিক করে গড়েছেন। রস নিয়ে তর্ক চলে না। 'তুমি কেন উস্তাদ আমির খাঁ'র বাগেশ্রীতে কঁকিয়ে ওঠো না' বলে তর্ক জোড়া যায় না। সে আনন্দ চিত্তগত। সে উপলব্ধি আত্মগত। জীবনের যে সাধকে সুবিধার উপরে রেখে মানুষ পায়, তাতেই সে নিজেকে পায়। তাই তেনজিং নোরগের পাহাড়ে চড়া আর আমার বাইশ তলায় লিফটে ওঠার মধ্যে একটা পার্থক্য রচনা হয়। আর যারা সাধের গলা টিপে সুবিধার দিকে ঝোঁকে, এমন মানুষের তর্কের রাজ্যে জিততে অসুবিধা হয় না বটে, কিন্তু নিজের অন্তঃকরণের দৈন্যের পীড়া থেকে মুক্তি মেলে কি? তার অন্তরের দৈন্য প্রতি মুহূর্তে বাইরের প্রাচুর্যের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে ফেরে। বাইরে মেলা বস্তু জমিয়ে সবাইকে দেখার জন্য ডাকে। সহজ সুখের সুক্ষ্মতা যত কমে, উত্তেজনার দরকার হয় তত বেশি। শুরু হয় অন্যের ঈর্ষায় নিজের ঈর্ষার সার্থকতা খোঁজা। বৈভব পাঁচিল তৈরি হয়। তার তোষামুদে, সুবিধাবাদীদের সংখ্যা যত বাড়ে, নিজের ভিতরের একাকীত্ব তার তত ভারি হয়ে ওঠে। সাধের ছায়া প্রেতাত্মার মত ঘুমের মধ্যে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তখন ব্যস্ততার মাত্রা বাড়িয়ে পালাবার পথ খুঁজে বার করা ছাড়া আর অন্য কোন পথ থাকে না।
        তবে সাধের উপর আরেকটা শব্দ থাকে, কর্তব্য। একমাত্র এই কারণে যে মানুষ তার সাধকে ত্যাগ করে সে দৈন্যের শিকার হয় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি, কর্তব্যের নামে যাকে সাজানো হয়েছে, আসলে তা সুবিধার প্রতি আনুগত্য। তাই কর্তব্যের নামে যেটা থাকে, তা সমাপনের পর আত্মতৃপ্তির ঔজ্জ্বল্যতাটা চরিত্রে জ্বলে কই? সে কপট কর্তব্যের মূলটা টানলেই সুবিধাবাদীর চেহারা বেরিয়ে পড়ে। আত্মপ্রবঞ্চকের চেহারা হয়ে আসে। যে নিজের সাধকে হত্যা করতে পারে সুবিধার জন্য, সে সব ধরণের অমানবিক কাজ করতে পারে। তার ভালোবাসাও সুবিধার নামান্তর। সাধের না। সাধ ঐশ্বরিক। সুবিধা আসুরিক। তাই প্রথমটায় সাধনা, পরেরটায় চেষ্টা। 
        সাধ মানুষকে পরিপূর্ণতা বোধের দিকে নিয়ে যায়। থামতে শেখায়। সাধ বলে, লোভ না, আমায় পূর্ণ করার দায় তোমায় নিতেই হবে, নইলে তুমি ব্যর্থ হবে যে! 
        সুবিধা বলে, বোকার হদ্দ হোয়ো না, ওসব আবেগ-টাবেগ সমূলে উৎপাটন করে একটা কাজের মানুষ হও দিকিনি, তখন বুঝবে বেঁচে কি সুখ!
        সাধ বলে, তুমি ভিখারি, চিরকালের ভিখারি হয়েই থেকো। তোমার দুর্ভাগ্য তুমি থামতে জানো না, বাধ্য হয়ে থামো, তৃষ্ণা নিয়ে থামো। তাই তোমার থামাটা যন্ত্রণা, সুখ না। আমার সে পথ নেই, আমার চলার প্রথম ধাপ থেকেই আমি পূর্ণতার আশ্বাস, আনন্দ।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার - এই লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে একজন মানুষের নাম যদি না করি। আমাদের টুবলুদা ওরফে সন্দীপ ভট্টাচার্য। বাইরের দিক থেকে তার একটা চশমার দোকান (দূর্গা অপটিক্যাল), কিন্তু আদতে মানুষটা আদ্যন্ত একজন গবেষক। লেন্স নিয়ে এমন অগাধ ভালোবাসা আর জ্ঞান আমি এযাবৎ আর কারোর মধ্যে দেখিনি। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনি সব সময়ে প্রস্তত। আমার উপরোক্ত কাণ্ড-কারখানায় এ মানুষটাকে পাশে না পেলে মুশকিল হত। আমার পাগলামিকে ইনি বেশ গুরুত্ব দিয়ে শোনেন, যে সমস্যার কথা কাজের বাইরের কথা, সেই সমস্যাকেও গুরুত্ব দেন। ফলে এমন বৈজ্ঞানিক রসজ্ঞ মানুষের তত্ত্বাবধানে আমি এ যাত্রায় তরেই গেলুম।]