গল্পটা পুরুষতন্ত্র, ধর্ম, রাজনীতি, কুসংস্কার, আবেগ, দুর্নীতি ইত্যাদি যাই বলো না কেন, ব্যাপারটা অত জটিল কিছু নয়। মোদ্দা কথাটা হল, কে ডমিনেট করবে আর কে ডমিনেটেড হবে। যে ডমিনেট করবে, সে দুষ্টু, খারাপ, লোভী, অবিবেচক ইত্যাদি তকমা পাবে। আর যে ডমিনেটেড হবে সে বেচারা, নিরীহ, নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ ইত্যাদি তকমা পাবে। যে ডমিনেট করে, মানুষ তাকে মনে মনে ফুলচন্দন দিয়ে, যে ডমিনেটেড হচ্ছে তাকে সমবেদনা জানায়। দুমুখো ঢ্যামনা সাপ। মানে আমরা!
যে ডমিনেটেড হচ্ছে সে চায় সব ঠিক হোক। তার কিছুটা মানে সেও ডমিনেট করুক। আর যে ডমিনেট করছে সে চায় এ অনন্তকাল চলুক। মোদ্দাকথা এই উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে আর বুধোর পিণ্ডি উধোর ঘাড়ে। এই তো হল গল্প।
তবে কে কখন ডমিনেট করবে, এর উত্তর কেউ দিতে পারে না। দিতে গেলেই সে মহাভারতের কালের চাকা ঘুরতে শুরু করবে, ম্যায় মহাকাল হুঁ। নে ঠেলা সামলা এবার।
আরে স্বগ্গে এরকম প্রায়ই হয় না? এই অসুররাজ চলে এলো, আবার দেবতারা তাদের খেদিয়েটেদিয়ে আসনে বেশ গোছ করল বসল। আবার গেল গেল.. আবার অসুর চলে এলো। আবার দেবতা। এই তো হল কথা। মাঝখান থেকে একে তাকে গালাগাল দিয়ে লাভ নেই বুঝলেন, মায় রাশিয়া আর চীনের দিকে তাকিয়ে বুঝেছেন না? ও সার কথা হল যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।
তবে উপায়? উপায় আছে আবার নেইও। 'নেই' বললে তো খেলাই শেষ। যদি বলো উপায় কি? আমি বলব, দুটো। একটা মিছিমিছি উপায়। একটা সত্যিকারের উপায়।
আগে বলি মিছিমিছি উপায়ের কথা। মিছিমিছি উপায় হল, মনকে প্রবোধ দাও। যে ডমিনেট করছে, সে হল দুষ্টুলোক। মানে তুমি ভাবলে পুরুষতন্ত্র চলে গিয়ে মহিলাতন্ত্র এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কি অমুক পার্টি গিয়ে তমুক পার্টি এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কি ধর্ম গিয়ে বিজ্ঞান এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কি করোনা গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কি বৃষ্টিগেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে...... উফ বাবা রে বাবা.... কিচ্ছুতেই "সব ঠিক" হবে না দাদা। কাঁধের ব্যথা হাতে যাবে, হাতের ব্যথা কোমরে, কোমরের ব্যথা পায়ে। এবার কি ভাবছেন? পায়ের ব্যথা মাটিতে? ধুস! পায়ের ব্যথা আবার মাথায় কি ঘাড়ে চাপবে। মোট কথা ঘুরেফিরে আবার সেই 'ধুর ভাল্লাগে না' তে ফিরতে হবে।
তবে এই হল মিছিমিছি উপায়ের কথা। সারা পৃথিবীজুড়ে বিশ্বকে ঠিক রাস্তায় আনার জন্য, মানুষকে সুবোধ করার জন্য কম বই লেখা হল? মায় সব বই জোগাড় করলে চীনের পাঁচিল গোষ্পদ তুল্য হবে গা। তারপর আলোচনা তো কত হল। কত খাবার, কত মদ, কত ধোঁয়া উড়ে গেল তার ঠিক ঠিকানা নেই। কি হল? লবডঙ্কা। জেলে কি কম মানুষ ভরছে? অপরাধ কি কমে যাচ্ছে? বলি বিশ্বের কথাটাই ধরেন, দূষণে আর উষ্ণায়নে তার প্রাণটাকেও যাচ্ছেতাই রকমে রগড়ে রগড়ে কি অবস্থা করেছি আমরা! এদিকে দেখো কত কত বই লেখা হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ নিয়ে। কত কত হাইফাই আলোচনা। এই সমুদ্দুরের মধ্যে সেঁধিয়ে, তো উই আকাশে উঠে। বাবা রে বাবা। কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।
আসলে দাদা এও ডমিনেটের ইচ্ছা। দেখো আমি কত ভালো, দেখো আমি কত জ্ঞানী, দেখো আমার কত টাকা। দেখছ না? এসো আমি তোমার বন্ধু হই। বন্ধু হয়ে ডমিনেট করি। একে কি নাম দেওয়া যায়? একে নাম দেওয়া যায় ধরো অ্যানেস্থটিক ডমিনেন্স বা সিইডো ফ্রেণ্ডলি ডমিনেন্স বা ডমিনেন্স অব বেনিফিট?
যা হোক আমার তো কাজ নাম দেওয়া নয়। ওসবের জন্য ডিগ্রীধারী মোটা মাইনে করা লোক আছে। আমার মত আত্মপোষা (আসলে আমার ছা নেই কিনা, তাই মিথ্যাটা বললুম না, ছাপোষা আর হই কি করে?) মানুষের আর কি কাজ বলো? তো এরকম মেলা টাইপের ডমিনেন্স আছে। প্রথমে মনে হবে উইন উইন সিচুয়েশান হচ্ছে। তারপর মনে হবে যে উঁহু, কোথায় যেন কি গোলমাল হচ্ছে। এই যেমন ধরো, আমি মার্গারেট দিদার 'দ্য টেস্টামেন্ট' বইটা পড়ছি। কি ভালো লেখনী দিদার। কিন্তু হলে কি হবে, দিদার চোখে যদি একটাও ভালো পুরুষ পড়ছে গো! আমি অবিশ্যি অর্ধেক পড়েছি সবে। খুব ভালো বই। কি কথার বাঁধুনি দিদার। কিন্তু হলে কি হবে গা, মায় ডেন্টিস্ট থেকে শুরু করে সব পুরুষ যেন ওই অঙ্গটির তৃষ্ণা নিবারণ আর ক্ষমতাবাজী ছাড়া আর কিছুই জানে না। এও এক ধরণের প্যাসিভ ডমিনেন্ট আইডিয়া দিদা মাথার মধ্যে ঢুকাচ্ছে কিনা? দুর্দান্ত লেখার হাত বলেই ওসব করতে হবে? বলি সব কি তাই দিদা? অমন একপেশে ভাবনা কি ভালো? তুমিও যে ডমিনেট করতে চাইছো পাঠকের মাথায় এক আইডিয়া দিয়ে!
তো এই হল কথা। ডমিনেশন চলবেই। যে কোনোভাব হোক হবেই। এর থেকে ত্রাণের জন্য যতই আইনকানুন বানাও, তার ফাঁক দিয়েও ওসব হবেই। না যদি হত তবে হিরো বলে কোনো শব্দই এই যুগে তৈরি হত না। হিরো মানেই তো আমি আছি সর্বহারাদের দলে...ইত্যাদি ইত্যাদি। কে জানে কি মতলবে মানুষ হিরো হয়?
যাক গে, তবে আসল উপায় কি?
সে ভীষণ কঠিন। হয় বৈরাগী হও, নয় সিনিক-উদাস-পাগলা গোছের একটা কিছুর সংমিশ্রণ হও। সব মায়া বলো, না হয় সব লীলা বলো, না হয় সব অ্যাবসার্ড বলো। প্রথমটা বলেছিল শঙ্করাচার্য, দ্বিতীয়টা রামানুজ আর শেষটা কাম্যু। হ্যাঁ হ্যাঁ বুদ্ধিজীবী মহোদয়গণ আপনাদের দেশের কাম্যু। আপনারা তো আবার ভুল করে ভারতে জন্মে সারাদিন বুদ্ধিটাকে দুই হাতে ধরে জ্বলে গেল.. সব জ্বলে গেল... করে ছুটে বেড়ান কিনা! যত্তসব আদিখ্যেতা।
যা হোক সবটা খোলামেলা বলে দিলুম। নরেন অবশ্য আগেই বলেছিল, এ জগত হল কুকুরের ল্যাজের মত। যতই সোজা করতে যাও না কেন, শেষে সব এক। বাইরেটাই বদলায়, সময়ের জেনেটিক্স একই থেকে যায় কত্তা! নরেন বলল, ও সুখ বাড়ালেই দুঃখ বাড়বে। রেশিও একই থাকবে। তবে কিছু নিয়ে একটা মেতে থাকা ভালো। যেমন কেউ বিশ্বাস করেন সব লোক সিগারেট মদ ছেড়ে দিলেই সব সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। কেউ ভাবেন নিরামিষ খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। হয় না কি আর? কিছু হয়। তবে হরেদরে কেস একই থেকে যায়। নইলে এত্ত এত্ত যন্ত্রপাতি, যানবাহন আবিষ্কার করেও মানুষ বলে সময় নেই! ভাবুন দাদা ভাবুন….
ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়... আমি এই গানটা বরং গাই…. ডমিনেন্স সিন্ড্রোমের এর চাইতে ভালো গান আমি শুনিনি… "দু তিন দিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে... সেই কর্তারে দেবে ফেলে কালাকালের কর্তা এলে"… আহা কি লাইন! কি ব্যাখ্যা!
আপনারা বুদ্ধিজীবীরা এ সব গান নিয়ে তো গবেষণা করেন না... লোরকা, নেরুদা ছাড়া তো কতাই শুনিনা মুখে… যা হোক মায়া কাটা মন... মায়া কাটা... সবই মায়া... জয়গুরু...