যখন নিজের ক্ষুদ্র বৃত্তে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে নিয়ে লড়েছি, লড়ে যাচ্ছি, সে অনুভব একরকম। আর এই যে এক লহমায় হাজার হাজার মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাওয়া, সে আর এক রকমের। আবার মনে করিয়ে দেওয়া, কি বালির স্তূপের উপর ঘর বানিয়ে আমাদের 'চিরকালের সংসার' বানিয়ে আছি।
যে মৃত্যু তিলে তিলে চোখের সামনে স্বজনের উপর অধিকার বসায়, তাকে সহ্য করার যন্ত্রণা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস --- ভাষাতীত। ক্রমশ মানুষটার চেহারা বদলিয়ে যায়, তারপর তার ব্যক্তিত্ব। ক্রমে সে প্রায় যেন অন্য দুনিয়ার মানুষ হতে শুরু করে। একটা সময়ে তার নিজের বানানো সংসারকেই, নিজের মানুষদের চিনতে পারে না। আমার চেনা জগতে সে অচৈতন্য। জানি না কোন জগতে সে জেগে উঠছে। চেতনার উল্টোপিঠ বলে হয় কি কিছু? জানি না। সে একদিন চলে যায়। পাশের মানুষগুলো? এতদিনের লড়াইয়ের পর? তারা ক্লান্ত, অবসন্ন। সে দীর্ঘ লড়াইয়ের স্মৃতি কোনোদিন তাদের গভীরের মন থেকে মুছে যায় না। বাইরের মন স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে। কিন্তু একটু নাড়া পড়লেই সে গভীরের মনে ব্যথার পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। সে ঘুমায়নি। পাশের মানুষগুলো বদলে যায়, যারা চলে যাওয়া মানুষটার খুব কাছের ছিল।
আর এই অতর্কিতে এত মানুষের চলে যাওয়ার স্মৃতি? সেও কি যায়?
বিশ্বাসের নিজস্ব রাজত্ব থাকে মনের উপর। সে সেই রাজত্বের উপর শাসন চালায়, কর আদায় করে, জীবনকে এক পথে চালিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে কোনো ঘটনা যখন তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে, তখন সে প্রথমে তাকে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে অস্বীকার করে। ক্রমে ধীরে ধীরে রাজ্য ছেড়ে দেয়। অভিমানে। আবার দিন যায়, আবার এক বিশ্বাস আসে। জমিটা আলগা করে ধরে। জানে যে কোনোদিন ছেড়ে যেতে হবে। মানুষের বয়েস যত বাড়ে, তার বিশ্বাস তত কমে, অভিজ্ঞতা তত বাড়ে। কোন বিশ্বাসকে আঁকড়ে বাঁচব তবে? কোনো বিশ্বাসই নেই।
আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কি! শেষ শ্বাসটুকু পড়া অবধি চ্যালেঞ্জ। তাকে স্বীকার করি, চাই না করি। সে আছেই। হয় আমি তাকে অস্বীকার করছি, নয় তাকে স্বীকার করছি। যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করি, স্বপ্নের ঘোর তত তাড়াতাড়ি কাটে। বিশ্বাস যদি আড়াল হয়, তবে এমন কোনো বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস যদি নম্রতা হয়, তবে আছে, সে আশ্রয় হিসাবে আছে। অবশ্যম্ভাবী চ্যালেঞ্জকে মাথা পেতে নেওয়ার নম্রতা। নম্রতা অর্থে দুর্বলতা নয়। দুর্বল নম্র হয় না, নম্রতার ভান করে। নম্রতা বীরের শৌর্য। আন্তরিকতা তার অস্ত্র। তার রণকৌশল। আন্তরিক না হলে কোনো চ্যালেঞ্জকেই তার সত্যিকারের রূপে দেখতে পাব না। আর নম্র না হলে, কোনো চ্যালেঞ্জকেই সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করতে পারব না। চালাকি আর ঔদ্ধত্য আসলে চ্যালেঞ্জের আগেই হেরে যাওয়া। বাইরে তার যতই আস্ফালন থাকুক না কেন।
রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে আছে এই চ্যালেঞ্জের কথা। একটা গান তার মধ্যে বারবার মনে আসে,
ও নিঠুর, আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে?
তুমি মর্মে আমায় মারবে হিয়ার কাছে ॥
আমি পালিয়ে থাকি, মুদি আঁখি, আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি গো--
কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে ॥
আমি মারকে তোমার ভয় করেছি ব'লে
তাই তো এমন হৃদয় ওঠে জ্বলে।
যে দিন সে ভয় ঘুচে যাবে সে দিন তোমার বাণ ফুরাবে গো--
মরণকে প্রাণ বরণ করে বাঁচে ॥
আত্মশুদ্ধির রাস্তা বলতে গিয়ে গীতা তিনটে শব্দ উচ্চারণ করে --- আসক্তি, ভয় আর ক্রোধ। এই তিনটে থেকে মুক্ত হতে না পারলে বারবার রণক্ষেত্রে হেরে নাস্তানাবুদ হতে হবে। ভয় আর রাগ যে ভীষণ প্রবল, সে তো বুঝি। কিন্তু আসক্তি? তাকে ছাড়িয়ে যাব কি করে? মহাভারতেই এর উত্তর। শুধু যে মহাভারত কেন, যে কোনো সার্থক উপন্যাসেই তার বর্ণনা। হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, পুতুল নাচের ইতিকথা থেকে শুরু করে নি:সঙ্গতার শতবর্ষ, প্লেগ, ফল (পতন), হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস --- সব সব। এই আসক্তি থেকে নিরাসক্তির ধারাভাষ্য। আঘাতে আঘাতে নিজেকে চেনার গল্প। নিজেকে হারানোর আখ্যান। সব আছে। জীবনের মুখোমুখি না হয়ে ত্রাণের পথ আছে নাকি? নেই। মুখোমুখি হতে পারলে জীবন একটাই উপহার দেয়, যার কোনো সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ আমি জানি না, সেটা হল - Wit - বাংলা করলে যা হয় তো হবে 'বিদগ্ধ প্রজ্ঞা'। সেকি ফাঁকি দিয়ে পাওয়া যাবে, না সেকেন্ড হ্যাণ্ড পাওয়া যাবে? সব সহ্য করেই পেতে হবে। অবশেষে ঝলসে গিয়ে। বাইরের আঘাতে জর্জরিত হতে হতে ক্রমশঃ আরও নিজের কেন্দ্রের দিকে যাওয়া --- এই তো আসক্তি থেকে মুক্তির পথ। যে পথ ফকির দেখিয়েছিল অমলকে, ক্রৌঞ্চদ্বীপ যাওয়ার পথ, যেখানে সবকিছু হালকা হয়ে যায় --- ডাকঘরে। ভাগবতে আছে, শুকদেব মৃত্যুপথযাত্রী পরীক্ষিৎকে জীবনের গভীরতম সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ভক্তির মাধুর্যে। এ যুগে ডাকঘর সেই ভাগবত, অমল পরীক্ষিৎ, ফকির শুকদেব।