Skip to main content

একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকালো, সারদা দেবীর উপর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা বই, 'পরমাপ্রকৃতি' এরকম কিছু একটা নাম। সঙ্গে লেখা এই বইটা পড়ে জানুন, কে এই করুণাময়ী পরমাপ্রকৃতি। সঙ্গে একটা হোয়াটসঅ্যাপের নাম্বার।

মোবাইলটা বন্ধ করে একটা বই হাতে নিয়েছি, হঠাৎ মেসেজ ঢুকল,

"শীতকালে কুয়াশার মধ্যে যাতায়াতের সময় সতর্ক থাকুন। ছিঁড়ে পড়ে থাকা বা নীচু হয়ে ঝুলে থাকা বিদ্যুতের তার বিপজ্জনক, স্পর্শ করবেন না।"

বিদ্যুৎ বিভাগের মেসেজ। কি দরদী মেসেজ। মস্তিষ্কের কোষগুলো তখনও 'করুণাময়ী' শব্দটা থেকে বেরোতে পারেনি, এরই মধ্যে বিদ্যুৎবিভাগ থেকে মেসেজ ঢুকল। দরদী মেসেজ। যেন জয়রামবাটি থেকে কোনো একজন ভক্ত বেরোচ্ছেন, মা তাকে কথাগুলো বলছেন। অবশ্য ঐতিহাসিক দিক থেকে কথাটা খাটবে না, কারণ ওই সময়ে জয়রামবাটিতে বিদ্যুৎ বলতে আকাশ থেকে নামা বেয়াড়া গোছের বিদ্যুৎই ছিল। এমন ধাতু বেয়ে গড়িয়ে আসা বিদ্যুতের সংযত স্রোত ছিল নাকি!

তো মেসেজটা দেখে ভাবলাম কত সতর্কবাণী সারাদিন চোখে পড়ে, সামনে স্কুল ধীরে চালান, অ্যাক্সিডেন্ট প্রোন অঞ্চল, ধীরে চালান। ওষুধের প্যাকেটের গায়ে বারবার লিখে দেয়, ডাক্তার না দেখিয়ে খাবেন না, প্রেসক্রিপশন ছাড়া বেচবেন না। আরো কত কত কি! এগুলো কি করুণা না? দরদ না? এই সব সামাজিক করুণা।

আমরা রাতদিন আমাদের ছোটোদের বলে যাচ্ছি, এরকম করিস না, ওভাবে এটা হয় না, এরকম করলে ভুগবি ইত্যাদি ইত্যাদি। বলেই যাচ্ছি। না শুনলেও বলেই যাচ্ছি। পাত্তা দেবে না জেনেও বলেই যাচ্ছি। কারণ? স্পষ্ট নয়। আসল কথাটা কারোর ক্ষতি হোক আমাদের ভালো লাগে না। যতই শত্রুতা করি, যতই কাউকে শাপশাপান্ত করি না কেন, আদতে কারোর ক্ষতি কি সত্যিই ভালোলাগা আনে মনে? আনে না। পীড়াই দেয়। আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি। সাধারণ মনের কথা বলছি। বাংলা সিরিয়ালগুলো যে বিশেষ ধরণের মানব-মানবী জন্ম দিচ্ছে শুটিং এর ফ্লোরে রাতদিন, তাদের কথা বলছি না। আমরা কতবার আফসোস করি, এতবার করে বললাম, শুনলো না। এত করে বোঝালাম, বুঝল না। আবার এও বলি, এতবার করে বলল, আমি কেন শুনলাম না, বুঝলাম না।

একজন মানুষ পাহাড়ে বেড়াতে গেছে। ফাঁকা ফাঁকা একটা গ্রামে গিয়ে উঠেছে। সকালবেলা চুপ করে কফির কাপ হাতে বসে আছে। দূরে। নির্জনে। পাখি ডাকছে। অনেক দূর থেকে কারোর গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। সে চুপ করে শুনছে। আবার শুনছেও না। সে সব বাঁধন আলগা করে দিয়ে নিজের শুশ্রূষা করছে। সংসারে চলতে অনেক আঘাত নিরাময় হওয়ার সময় পায় না, তার আগেই আরেকটা আঘাত এসে পড়ে। সেগুলোতে পট্টি লাগিয়ে মোটামুটি চলনসই করে আবার কাজে নেমে পড়তে হয়। পড়তেই হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে আঘাতগুলো জানান দেয় তার একটু খোলা বাতাস লাগবে। আর যে পারা যাচ্ছে না। তখন সে মানুষটা নির্জনতা খোঁজে। যে করে কোথাও একটা। পাহাড়ি গ্রাম না হলেও, নির্জন সৈকত না হলেও, বাড়ির আশেপাশে কোনো খোলা মাঠ, খোলা আকাশ। নিদেন পক্ষে ছাদ। রামকৃষ্ণদেব সংসারের এইসব চাপা ফোস্কার খবর রাখতেন বলেই হয় তো বারবার মনে করাতেন, ওহে একটু নির্জনবাসে যাও। মনের একটা শুশ্রূষা দরকার।

ওই যে মানুষটা নির্জনে বসে আছে, দগদগে ঘা গুলো আলোবাতাস পাচ্ছে, ও কিন্তু নিজের কথা ভাবছে না শুধু। কোনো মানুষই খালি নিজের কথা ভাবে না। ঘর ভাবলেই যেমন অবশ্যম্ভাবী ভাবে ছাদ আর দেওয়াল এসেই পড়ে, তেমনই মানুষ নিজেকে ভাবলেই অনেকের কথা এসেই পড়ে। অনেক সময় ঘর ভাবলে যেমন মেঝের কথা মনে আসে না, তেমন অনেক সময় নিজেকে নিয়ে ভাবতে গেলে হয় তো নিজের কথাই মনে আসে না। আসে ভালোবাসার মানুষগুলোর মুখ।

নিজেকে নিয়ে নিজের এই যে নির্জনবাস এও করুণা। নিজের উপর নিজের করুণা। সে নিজেকে নিয়ে যতটা গভীরে যাওয়া যাক না কেন। নিজের মধ্যে এতগুলো মানুষ বেরিয়ে পড়বে, এক সময় মনে হবে, এক একটা মানুষের 'আমি' যেন এক একটা পাখির নীড়। সেখানে অনেক মানুষ। তার ভালোবাসায় অনেক বাঘা ধেড়ে মানুষও শাবক হয়ে। সে খড়কুটো জোগাড় করে নীড় সামলাচ্ছে। সবাইকে ভালো রাখতে চাইছে। অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাইছে।

তবে এও সত্য, ভাগ্য এমন নিষ্ঠুরও হয়, নীড়শূন্য হয়। শূন্য নীড় আঁকড়ে কে আর থাকে। যা ছিল মহামূল্যবান আগল, সে সত্যিই হয়ে যায় খড়কুটো। সে মানুষটা তখন ভেসে যেতে চায়। হারিয়ে যেতে চায়। অনেক দুর্ভাগা তো মৃত্যুকেই করুণার আশ্রয় করে বসে। তাকে বারণ করারও কেউ থাকে না। অথচ যে হয় তো চাইছিল তাকে কেউ বারণ করুক, বলুক, আমার নীড়ে একটা ছোট্ট জায়গা আছে তোমার জন্য, এসো।