সৌরভ ভট্টাচার্য
4 August 2019
একদিন বন্ধুত্বকে নিয়ে অনেক দর্শন, অনেক বৌদ্ধিক আলোচনা করেছি। এখন সে সব পুরোনো কথা। বন্ধুত্ব দিবসটা ঠিক কিরকমভাবে উদযাপন করতে হয় তাও জানি না। আসলে কোনো দিবসই ঠিক কিভাবে উদযাপন করতে হয় তা জানি না।
অ্যারিস্টটলের মতে তিন ধরণের বন্ধুত্ব হয় --- প্রয়োজনের, আমোদের আর প্রাণের। শেষেরটির অস্তিত্ব স্থায়ী হয় বলাই বাহুল্য। আমাদের তুলসীদাসজীও বন্ধুত্বের অনেক গুণগান গেয়েছেন। কিন্তু উদযাপন হয় কি করে? এ বলা আমার পক্ষে খুব শক্ত।
প্রথম কথা বইকে আমার কোনোদিন বন্ধু বলে ঠিক মনে হয়নি। যদিও এ নিয়ে স্কুলে প্রবন্ধ লিখেছি। বন্ধু বলতে মানুষকেই চেয়েছি চিরকাল, তাই চেয়ে আসছি। হয়ত যদি বেশি বয়েস অবধি টিকি, আশেপাশের মানুষ সব সরে যায়, তখনও কি বলতে পারব বই আমার একমাত্র বন্ধু? না, বলতে পারব না। হয়ত অশক্ত শরীরে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকব, রাস্তায় হাঁটা মানুষ দেখব, জোর করে কথা বলতে চেষ্টা করব। তবু মানুষকেই চাইব।
একটা গান আছে, 'জয় শঙ্খ গদাধর' তার একটা জায়গায় আছে 'অন্তিম বান্ধব দেহি পদম্'। এই গানটা নিয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে। কালের নিয়মে এক প্রখ্যাত মানুষের সাথে আলাপ, তিনি নানা দর্শনে পণ্ডিত, দেশে বিদেশে তাঁকে যেতে হয় নানা বিষয়ে আলোচনা করতে। একবার তাঁর একটা স্কুলের উদবোধনে তিনি আমায় ডেকেছেন, অবশ্যই স্নেহের বশেই ডেকেছেন, কারণ ওনার আশেপাশে হাঁটার কোনো যোগ্যতাই আমার সেদিনও ছিল না, আজও নেই। আমি ওনার বাড়ি দুপুরের দিকে গেছি। বিকালে অনুষ্ঠান। হঠাৎ করে শ্রাবণের আকাশ ঝেঁপে এল বৃষ্টি। আমি আর উনি একটা মন্দিরের চাতালে। শিব মন্দির। বৃষ্টিতে মানুষ অনেক না বলা কথা বলতে পারে। বৃষ্টি মানুষকে সাহসী করে। কৃত্রিম নৈতিক আড়াল সরিয়ে আসল মানুষটা হুস্ করে বেরিয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় চিরকালের নীরব প্রকৃতি মুখরা হয়ে ওঠে।
আমায় বললেন, "জয় শঙ্খ গদাধর গানটা জানিস?"
"জানি। মায়ের কাছে, দিদিমার কাছে অনেকবার শুনেছি।"
"গাইতে পারিস?"
"আপনার সামনে?"
ভয়ে ভয়ে গাইতে শুরু করলাম। সামনের দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগল আমার চোখের সামনে। সাদা-কালো সিনেমায় দেখা মহাপ্রভু এসে দাঁড়ালেন আমার মানসলোকে। শ্রীবাসের আঙিনা ফুল দিয়ে সাজানো। চারপাশে মহাপ্রভু'র পার্ষদেরা। খোল করতাল বাজছে। আর যেন কোথাও নেপথ্যে মল্লারের সুরে বেজে চলেছে বৃষ্টির ধারাপাতধ্বনি। লোকে লোকারণ্য শ্রীবাসের আঙিনা। নবদ্বীপের সমস্ত একা মানুষ, তৃষিত মানুষ, অসহায় মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে; এক মুহূর্তের জন্য দেখে নিতে চায়, এক ঝলক দেখে নিতে চায় সেই স্বর্গীয় মুহূর্তের ক্ষণিক চিত্র। আঙিনায় আর লোক ধরে না। বাইরে রাস্তায় সার দিয়ে মানুষ সাষ্টাঙ্গ প্রণামে শুয়ে, ধুলোতে শুয়ে। শোবে না? এই ধুলোতে হেঁটে গেছেন যে তিনি। কে তিনি? 'অন্তিম বান্ধব দেহি পদম্'।
চোখ মেললাম। বৃষ্টি পড়ে চলেছে অঝোরে। আর তিনি? তিনি বাচ্চাদের মত মন্দিরের চাতালে লুটিয়ে কাঁদছেন। আমি একবার ভাবলাম থামি। পরক্ষণেই মনে হল, না থাক, থামলে ওনার কান্নার যেন সুর কেটে যাবে। কিন্তু এমন কান্না কেন? ওনার তো কোনো অভাব নেই। অর্থ, খ্যাতি, নাম, যশ --- কি নেই ওনার? তবু এমন বুক ফাটা কান্না কিসের জন্য!
ওই যে, অন্তিম বান্ধব দেহি পদম্। বাবা-মা, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-পুত্রী --- সব ছাপিয়ে এই কান্না। এক পরম বন্ধুর জন্য কান্না। যে দরদী। যে আমার জন্যই আমাকে বোঝে। আমার জন্যেই আমাকে চায়। তার ভালোবাসায় আমি অমরত্ব পাব। আমার মধ্যে অমর হয়ে থাকার কোনো সম্পদ নেই, আমার এই কান্নাসিক্ত ভালোবাসাটা ছাড়া।
সারাদিন চলতে ফিরতে অনেক মানুষ দেখি --- জানলায়, দরজায়, রাস্তায়, প্ল্যাটফর্মে --- “no one to anyone”. আমার কান্না পায় দেখলে। কি সাংঘাতিক একাকীত্ব। কি যন্ত্রণা। কাকে বলবে? কে শুনবে? আমাদের যে অনেক তাড়া! শুনেছি কোনো কোনো দেশে মানুষ নিজের দেহটা দান করে যায় আজকাল এইটুকু ভরসায় যে মারা গেলে কেউ নিতে আসবে! এই একাকীত্বের ভয় আমাদের সবার ভিতর। একাকীত্ব নিয়ে অহংকারী মানুষ দেখেছি আমি। সে ভীষণ রকম অভিমান একটা। তারা সবার দ্বারা পরিবৃত হয়ে একটা একাকীত্ব নিয়ে বাঁচতে চান।
মানুষ এই একাকীত্ব থেকে বাঁচার জন্য একজনকেই খোঁজে, মানুষকে। কোনো সংজ্ঞাহীন যে সম্পর্কে মানুষের নিজেকে উজাড় করা সুখ, সেই সুখ বন্ধুত্বের পরম সুখ। সেখানে নিয়ম নেই, রাখঢাক নেই, শর্ত নেই, শুধু প্রাণের তাগিদ আছে। সে তাগিদ বয়েসের সাথে কমে না, বাড়ে। বয়েসের সাথে সাথে অভিমানগুলো বেড়ে যায় শুধু তাই তাদের এমন একটা কঠিন আচ্ছাদন বাইরে। যখন সে ভাগ্যের দোষেই হোক, কি কালের নিয়মেই হোক, কোনোমতেই কাউকেই নিজের আঙিনায় পায় না, তখন সে চায় ঈশ্বরকেই সেই পরমবান্ধব রূপে। কিন্তু শর্ত একটাই, সে যেন মানুষের রূপ ধরে আসে, মানুষের আবেগ নিয়ে আসে। তাই সব দর্শন শেষ হলে কবিতার শুরু হয়, কারণ সব তত্ত্বের শেষে একজন তৃষিত একলা মানুষ কাঙালের মত দাঁড়িয়ে থাকে, বন্ধুর জন্যই কেবল – অন্তিম বান্ধব।