Skip to main content
 
চারটে কৌশল। ভালো থাকার। মনকে ভালো রাখার। বুদ্ধধর্মে একে বলে 'ব্রহ্মবিহার'। কথাটা শক্ত। ব্রহ্ম অর্থে আনন্দ বুঝে নিলে হ্যাপা নেই। গুরুদেব বলেন, সত্যকে পাই নিয়মের মধ্যে আর আনন্দকে পাই সৌন্দর্যের মধ্যে। চিন্তার জলে ভাবের স্রোত। অববাহিকা আমার হৃদয়, মানে আমি। ডুবছি আর ভাসছি। বিরাম নেই। কখনও আবার নিজের তৈরী ঘূর্ণিতে ফাঁসছি। ত্রাহি ত্রাহি রব। নানা মানুষের সম্ভার নিয়ে সংসার। এত বিচিত্র গতিতে হাল ঠিক রাখি কি করে? সেই নিয়েই কথা। এর মধ্যেই ভালো থাকার একটা প্রাচীন কৌশল নিয়ে খানিক কথা বলার ইচ্ছা।
 
 
১) মৈত্রী 
------------
        সোজা কথায় বন্ধুত্ব করার ইচ্ছা। যেমন শুনেছিলাম না, অভিসার মানে ততটা যাওয়া নয়, যতটা যেতে চাওয়া - এও খানিক সেই ধারায়। ততটা বন্ধুর সংখ্যা না যতটা আমার মধ্যে বন্ধুত্বের ইচ্ছা। বন্ধুত্বটা কার সাথে? সারা পৃথিবীর সব মানুষের সাথে? না। দস্তয়েভস্কি বলছেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ 'The Idiot'-এ, 'একজন মানুষের চাইতে মনুষ্যত্বকে ভালোবাসা ঢের সোজা', তাই তো, সেখানে তো আর প্রতিপদে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। নিজের ভাবে মনুষ্যত্বের রূপ বানিয়ে মনে মনে ভাববিলাসে থাকলেই হল। তারপর ভীড় ট্রেনে, টিকিটের লাইনে, প্রতিবেশীর সাথে জমি ভাগাভাগিতে স্বরূপ বেরিয়ে পড়বে ক'দ্দুর মানবপ্রেম হয়েছিল।
        তবে বন্ধুত্বটা কার সাথে? সজ্জনের সাথে। যার কাজে কথায় অনুকম্পায় সুহৃদ হয়ে বাঁচার ইচ্ছা আছে। তার সাথে। বন্ধুত্ব কি দেবে? বন্ধুত্বই দেবে। এখানে বুদ্ধ একটা ফেঁকড়ির কথা বলে রেখেছেন অবশ্যি। বন্ধুত্ব আর মৈত্রী'র মধ্যে একটা ফারাক আছে। মনে রাখতে হবে যে আলোচনাটা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য মনের শান্তি, স্থিরতা। তাই ফেঁকড়ির কথাটাও বলে রাখা। বন্ধুত্বের মধ্যে যে আসক্তির ভাব আছে মৈত্রী'র সে দায় নেই। তাই আমাদের মধ্যে যে চিপকে-চিপকি বন্ধুত্ব আছে, যেখানে মান অভিমানের গল্প আছে সেখানে এ তত্ত্বের কথা হচ্ছে না। সে তো থাকবেই। কিন্তু তাদের সংখ্যা আর কত? আর তাদের জন্য কোনো টিপস কারোর থেকে জানতে হয় না। হিংসা-অহিংসা, মারধোর , গালাগাল সব চলে সেখানে। আহা, সে যে মথুরা, বৃন্দাবনের কেস। সেখানে বুদ্ধ বাবাজির কি কাম? আমাদের কথা হচ্ছে, আমাদের সেই অন্দরমহলের বৃত্ত ছাড়ালে যে মহৎ জগৎ, সেখানে মনের সাথে বোঝাপড়ার গল্প। তো সেইখানে দরকার মৈত্রী - সজ্জনের সাথে। ভাবটা বড় কথা, ঘটনাটা নয়, বুদ্ধের মতে।
        কিন্তু সজ্জনের সাথে তো এমনিই মনের স্থিতাবস্থা থাকে। তার জন্য এই ভাব অভ্যাসের কারণ কি?
        আছে। 'আমিও কি কম ভালো মানুষ? বরং সদগুণে হয়ত ওর থেকে বেশিই হবে' - এই হল ক্যাঁচাল। ইগো ঘটিত চাটনি। ঝাল চাটনি। তারে ভাগানোর কথা বুদ্ধ বলছেন। যাও, গিয়ে বন্ধুত্ব করো, এবং মনে মনে বন্ধুত্বের ভাব পোষণ করো।
 
 
২) করুণা 
---------------
        চারপাশে বহু অসুস্থ, দরিদ্র, উৎপীড়িত, দুর্দশাগ্রস্থ মানুষ আছে। তাদের প্রতি ভাব থাকবে করুণার। বুদ্ধের মত এমন। কথা হল, এরকম মানুষ আমার চিত্তবিকলের কারণ হবে কেন? আমি তো যথেষ্টই দয়ালু এদের প্রতি! তবে?
        বুদ্ধ বলছেন, সমস্যা আছে। তুমি এরকম অবস্থায় কোনো মানুষকে দেখলেই ভাবো, আমার এরকম হবে না তো? হে ঠাকুর এরকম যেন আমার না হয়!
        ব্যস, চটকে গেল তোমার মানসিক স্থিতি। মনের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক, আগাম অশুভের আশঙ্কা। বুদ্ধ বলছেন, এ ভাব প্রশ্রয় দিও না। তোমায় দুর্বল করবে। তুমি মনের মধ্যে করুণার ভাব রাখো। চিন্তারা সুষ্ঠ হবে। ভয়রহিত হবে। ওই যে বললাম, চিন্তার জলে ভাবের স্রোত। স্রোতের অভিমুখ বদলাও।
 
 
৩) মুদিতা 
--------------
        এ হল ঈর্ষার প্রতিষেধক। অন্যের প্রাপ্তিতে, উন্নয়নে আন্তরিক তৃপ্তিলাভের অভ্যাস করা। নইলে জীবন পুড়ে খাক হয়ে যাবে। রাসেল মহাশয় ওনার 'Conquest Of Happiness' বইতে গোটা একখান চ্যাপ্টার রেখেছেন Envy -র উপরে। এ বড় আজিব মনোভাব; মানে এই ঈর্ষা, বা অসূয়া, বা পরশ্রীকাতরতা। কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না। অমুকের এটা হয়েছে শুনলেই রাতের ঘুম গেল। সে কি করে পেল? আমি কেন পেলুম না? আমার ভাগ্য কেন এত রূঢ়, নির্দয় আমার প্রতি? হে ঈশ্বর তুমি কেন এমন পক্ষপাতিত্ব করো? ইত্যাদি ইত্যাদি...
        বুদ্ধ বললেন, কারোর সৌভাগ্যে খুশি হও। অভ্যাস করো। ভাব বদলাও। অভিনন্দন জানানোর আগে নিজের চিত্তকে বড় করো, তাকে অভিনন্দিত করার আগে নিজে অভিনন্দিত হও। আনন্দিত হও। দেখো প্রফুল্ল হবে মন। চলতে ফিরতে হাল্কা লাগবে। যে কোনো কারোর সৌভাগ্যে আর মুষড়ে পড়তে হবে না মনে মনে। ভিতরে ভিতরে গুমরে মরার চাইতে ঢের গুন ভালো নয় কি যে ভাবের স্রোত বদলে ফেলা?
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই একটি ভাব যদি মন থেকে উপড়ে ফেলা যায় মনের প্রায় ৯০ শতাংশ শক্তির অপব্যয় বন্ধ হয়ে যায়। বহু অযৌক্তিক তুলনার কাঁটাঝোপ থেকে বেরিয়ে খোলা মাঠে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। তাই বুদ্ধ বলছেন, প্রসন্ন হও। যদি তুমি অন্যের আনন্দে সামিল হওয়ার কৌশল শিখে গেলে, তবে তোমার জীবনে আনন্দের, উৎসবের আর অভাব হবে না। কুচুটেমি ছাড়ো। ঝাঁপ দাও আনন্দ সাগরে।
 
 
৪) উপেক্ষা 
----------------
        সংসারে গোলমেলে মানুষের অভাব নেই। দুর্বিপাক, দুর্ভাগ্য তো পায়ে পায়ে। সবসময় কি তার থেকে বের হওয়ার পথ থাকে? থাকে না। সেক্ষেত্রে মহৌষধি হল - উপেক্ষা।
        আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আজকের দিনে। মানে এই বাজারি সভ্যতায়। রাতদিন প্ররোচনা আর কৃত্রিম অভাবের হাহুতাশের আবহাওয়ায় সুস্থ বাঁচতে গেলে। কথাটা হল কতটা উপেক্ষা করা যায়? 
        উপেক্ষা মানে কি উদাসীন কিম্বা নির্লিপ্ত থাকা? না। অমন নেগেটিভ কথা না। ভাবটা পজিটিভ। উপেক্ষার অ্যান্টিবায়োটিক। নির্লিপ্তি বা উদাসীন হয়ে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে থাকা নয় কো।
        তা বলে কি সব অন্যায় সহ্য করব?.... সব মেনে নিতে হবে?.... অমুক আমাকে ঠকিয়ে তমুক করে নিল, আমি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব?....
        হ্যাঁ তাই। আমার খুব কাছের এক বন্ধু একবার বলেছিলেন, সারাক্ষণ সজারুর মত কাঁটা ফুলিয়ে বেঁচে থাকা যায় না... আগাছায় জল না দিলে সে উপেক্ষাতেই মরে। কথাটা মনে খুব ধরেছিল। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, অনেক ঝুটঝামেলা একটু উপেক্ষা করলেই এড়ানো যায়। গায়ে পড়ে অশান্তি আসবে না তা বলছি না, কিন্তু গায়ে মাখব কি মাখব না - সেটুকু স্বাধীনতা নিজের মধ্যে অর্জন না করলে তো বিপদ। মনের খাতায় FIR জমতেই থাকবে, মনের বোঝা বেড়েই চলবে, আর আমি আমার সদবুদ্ধির নাকে তেল দিয়ে 'জ্বলে গেলাম, পুড়ে গেলাম, মরে গেলাম' করে দাপিয়ে বেড়াব... বলি কত কষ্ট করে যে মহিলা আমায় দশ মাস পেটে ধরে, নিয়ে, খাইয়ে, পড়িয়ে বড় করেছেন, সেকি এই জন্যে?
        উপেক্ষা সাধতেই হবে। 'চারদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি / ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি'
 
 
 
        এর পুরো প্যাকেজের বিস্তারিত রূপ জানতে হলে গীতবিতান তো রইলই। পাতা উল্টিয়ে, মনকে দু' ঝিনুক সে অমৃত পান করালেই হল। মন তো কত্তা আমার, তাকে যেমন মানুষ করব তেমনই হবে। লাভ-ক্ষতির চাইতে বড় কথা স্বস্তিতে বাঁচতে দেবে না গা! এমন ট্যুরে এসেছি, চারদিকে কত কিছু! কিছুই দেখা হবে না! অমন বেয়াদপ ছেলে নিয়ে ঘোরা যায়? তাই শুদ্বোধনের ছেলেটার কথা কিছু বলে রাখলাম। বড় ভালো মানুষটা ছিলেন তো। তা তিনি কি আর আপনার আমার খারাপ চাইবেন? সেই আর কি...