Skip to main content
 
 
ওগো মানব,
   তুমি তো পান্থশালা
প্রতিদিন দ্বারে তব
   অতিথি নিত্য নব
 
কখনও আনন্দ, কখনও বিষাদ, কখনও ক্ষুদ্রচিন্তাভার
কখনও ক্ষণিক জাগরণ
এ সবেই তো অতিথি তোমার
 
ডাকো, ডাকো সবে
    আপ্যায়নে না রেখো ত্রুটি
  যদি বা দুঃখ আসে রাশি রাশি
সমস্ত ঘর তছনছ করি
  ভাসায়ে নিয়ে যায় যাবতীয় আসবাব সব
     শূন্য করি গৃহ
তবু, ওগো তবু, সসম্মানে গ্রহণ করো সে সবে,
   হয় তো সব শূন্য করি
      পথ রচি গেল তারা
          আগামী আনন্দের
            জানি না তো!
 
অশুভ চিন্তা, লজ্জা, দ্বেষ
না ফিরায়ো, এলে দ্বারে
  তারাও অতিথি তোমার
প্রসন্নমুখে জানাও আমন্ত্রণ
      ভিতরে আসিবার
 
কৃতজ্ঞ থাকো
যে কেহই আসুক,
মনে রেখো
   এ সবের আগমনের হেতু যিনি
      তিনি তোমার বোধের অতীত
 
       এ কথাগুলি রুমির। রুমির সাথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, এই কথাগুলো আমার চেনা। বহুকাল আগে পড়া, আরেক কবির। নৈবেদ্যের ৩২ নম্বর কবিতা,
 
নির্জন শয়ন-মাঝে কালি রাত্রিবেলা
ভাবিতেছিলাম আমি বসিয়া একেলা
গতজীবনের কত কথা; হেন ক্ষণে
শুনিলাম তুমি কহিতেছ মোর মনে--
"ওরে মত্ত ওরে মুগ্ধ, ওরে আত্মভোলা,
রেখেছিলি আপনার সব দ্বার খোলা;
চঞ্চল এ সংসারের যত ছায়ালোক,
যত ভুল, যত ধূলি, যত দুঃখশোক,
যত ভালোমন্দ, যত গীতগন্ধ লয়ে
বিশ্ব পশেছিল তোর অবাধ আলয়ে।
সেই সাথে তোর মুক্ত বাতায়নে আমি
অজ্ঞাতে অসংখ্য বার এসেছিনু নামি।
দ্বার রুধি জপিতিস যদি মোর নাম
কোন্ পথ দিয়ে তোর চিত্তে পশিতাম!'
       চমকিয়ে উঠলাম। এমন মিল! মিল তো বটেই। রবীন্দ্রনাথ যখন রুমির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, তখন আমার মন আরো পিছিয়ে গেল, আরেক মহাকবির কথা মনে পড়ল, ব্যাসদেব, গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের বাইশ ও তেইশ নম্বর শ্লোক মনে পড়ল,
       রথের সারথী বলছেন অর্জুনকে, দেখো প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও মোহ চিত্তে আবির্ভূত হলে তিনি না তো তাদের দ্বেষ করেন, না তো নিবৃত্তি আকাঙ্ক্ষা করেন। তিনি উদাসীন। তিনি অবিচলিত। তিনি মনে মনে জানেন, এসবই ত্রিগুণের বশে চিত্তে এসেছে, আবার সময় হলে চলে যাবে। তিনি চঞ্চল হন না তাই। প্রভাবিতও হন না। তিনি সুখ-দুঃখ, প্রিয়-অপ্রিয়, নিন্দা-স্তুতি, মান-অপমান, শত্রু-মিত্র ইত্যাদি সবাইকে সমচিত্তে গ্রহণ করেন।
       রুমি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, এই কথা। রুমি, রবীন্দ্রনাথ, ব্যাসদেব তিনজনেই মাঠে পা ছড়িয়ে বসে। অমাবস্যার রাত। তারা উঠেছে আকাশে। রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করে গাইছেন,
 
আজি যত তারা তব আকাশে
        সবে মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে॥
নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া, মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে,
   তব নিকুঞ্জের মঞ্জরী যত আমারি অঙ্গে বিকাশে॥
দিকে দিগন্তে যত আনন্দ       লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ,
   আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।
       আজি কোনোখানে কারেও না জানি,
       শুনিতে না পাই আজি কারো বাণী হে,
নিখিল নিশ্বাস আজি এ বক্ষে বাঁশরির সুরে বিলাসে॥
 
       আমি বলতে যাচ্ছিলাম, এ গান তো আমি জানি, দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় শুনেছি, গাইতেও পারি। কিন্তু বললাম না। রুমি মাথা নেড়ে ইশারা করে বললেন, উঁহু কথা বোলো না।
 
       আমি দূরে একটা ছাতিমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসলাম। আমার অতীত জীবনের একটা একটা ভুল, ব্যর্থতা, বিশ্বাসঘাতকতা --- সব মনে পড়তে লাগল। দূরে ওনারা তিনজন বসে, আবছা গান আমার কানে আসছে। আমি মনে মনে গাইছি। হ্যাঁ, সমস্ত কিছুকেই গ্রহণ করতে হয়। সমুদ্রে স্নান করতে গেলে বড় ঢেউকে মাথা পেতে নিতে হয়, তার সাথে সংঘাতে যেতে নেই, তাকিয়ে এড়িয়ে চলার জো নেই।
       হঠাৎ শুনি এক মহিলাকণ্ঠে, আমার পাশেই যেন। তারার আলোয় ভালো করে মুখের দিকে তাকালাম। পিঠের উপর খোলা চুল, চশমাটা হাতের মুঠোয় ধরা, হাঁটুদুটো জোড়া করে তার উপরে রাখা মাথা... আমি চিনি তো... নবনীতা দেবসেন...
       আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কথাগুলো আমি বারবার আমার ভ্রমণ কাহিনীগুলোতে বলেছি না? জীবনের সবটা নিতে হয়, সবটা নিয়েই জীবন। ভালোবাসার বারান্দায় যেমন ভোরের আলো পড়ে তেমনই তো চড়া রোদের আলোও পড়ে, আবার ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় যেমন সে ভাসে, তেমন শ্রাবণের অমাবস্যাতেও তো ভেসে যায় বল, দুই ভেসে যাওয়া কি একরকম?
       ভোর হল। ঘরের জানলার পর্দা উড়ে উড়ে বাইরের ঝলমলে সকালটা দেখাচ্ছে। উঠতে হবে, পাশ ফিরতেই হাত লাগল কিসে গীতবিতান। জানি না আজ দরজায় কোন অতিথি।