"Without courage, we cannot practice any other virtue with consistency. We can't be kind, true, merciful, generous, or honest."
কথাটা স্বামীজির নয়। মায়া অ্যাঞ্জেলিউ-এর।
এ কথাটা সবাই বলেছেন, জীবনে কোনো না কোনো একটা সময়ে। সাহসের কথা। নির্ভীকতার কথা। অভয়ের কথা।
প্রাণে ভালোবাসা না জন্মালে কেউ অকুতোভয় হয় কি?
ত্যাগ করতে না শিখে কে কবে ভালোবাসতে শিখল? আগে তুমি, আমি পরে। এর বাইরে ভালোবাসা বলে কিছু হয় নাকি?
ভালোবাসা আর ত্যাগ, একই কয়েনের এপিঠ, ওপিঠ। বাকি তো ব্যবসা। লাভ লোকসানের হিসাব।
বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস যখন গাইছেন, "মোর মনে হেন করে/ কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া/ আনল ভেজাই ঘরে"। এ তো সেই ত্যাগের কথা। চরম ত্যাগের কথাও বলছেন অনায়াসে, "বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও/ মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।"
স্বামীজির ত্যাগের আহ্বান এই ত্যাগের কথা বলে। আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যের প্রাণ নেওয়া না। আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকায়। অন্যের প্রাণের বিনিময়েও না। এ ত্যাগ শুদ্ধ ভালোবাসার ত্যাগ। এ ভালোবাসা মানেই ত্যাগ। স্বামীজির এ ভালোবাসা, এ ত্যাগের শিক্ষা বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনুভবের সঙ্গে এক। স্বামীজি আর বৈষ্ণব পদাবলী, শুনলে প্রথমেই মনে হয়, ধুস, তাও কি হয়? স্বামীজির জীবনকে গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, দুই-ই এক। নইলে কীর্তন গাইতে গিয়ে অমন দুচোখের ধারায় ভেসে যায় কেউ? গোপীদের কথা, রাধার কথা বলতে ওভাবে গলা বুজে আসে? স্বামীজির লেখায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে এ সব লেখা। তবে তিনি অগভীর ভাবাবেগের তীব্র নিন্দা করেছেন। ওগুলো মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের "ভাবুকতা ও পবিত্রতা" প্রবন্ধে এ নিয়ে বিশদে ব্যাখ্যা আছে। তখন এক রকমের ভাবলোলুপতা জন্মায়। সে হীন করে মানুষকে। স্বামীজি যখন চিঠিতে লিখছেন, সব ছাড়তে পারো দাদা শান্তির আশা ছাড়তে পারো না…. তখন বোঝা যায় মানুষটাকে ভালোবাসায় পেয়েছে। যে ভালোবাসে সে নিজের শান্তি চায় না, সুখ চায় না। সে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসাকে জয়ী করতে চায়। "মরণেরে করে চির জীবন নির্ভর"... রবীন্দ্রনাথ।
বড় বড় বাণী নয়। স্বামীজির জীবনী মানেই ভালোবাসার কথা। মানুষটা শুধু ভালোবাসার কথা বলতে চাইলেন। তাঁর সব তত্ত্ব ভালোবাসার উপর আধারিত। সারা জীবনের অনুভবের সার যে কবিতাটা, সে-ই কবিতাটাও আমার কাছে বৈষ্ণব পদাবলীর চাইতে কম কিছু নয়,
"ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম—অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?
দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
‘দাও’, ‘দাও’—যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।
ব্রহ্ম হতে কীটপরমাণূ সর্বভূতে সেই প্রেমময়।
মন প্রাণ শরীর অর্পণ করো সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবনে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।"
সেদিন গীতায় কৃষ্ণ যাকে শিক্ষা দিচ্ছিলেন, তিনি তাঁকে বন্ধু জেনে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। উদ্ধব ও অর্জুন দুজনেই ছিলেন বন্ধু। তাই দুটি গীতাতেই বন্ধুর উদ্দেশ্যে বাণী।
এ যুগে স্বামীজি সেই একই সম্বোধনকে নিলেন, "সখা"। সখার প্রতি - কবিতাটার ছত্রে ছত্রে তাই দরদ, আলো। গোটা স্বামীজির হৃদয় এই একটি কবিতায়। আলো। প্রেম। ত্যাগ। সবটাই একটাই কথা। শুধু জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই না, ত্যাগের বিহনেও প্রেম নেই। ত্যাগহীন প্রেম বিকার আনে মনে। সে বড় বালাই। স্বামীজি সাবধান করেছেন।
প্রণাম।